মুক্তিযুদ্ধের পর এক লহমায় বদলে গিয়েছিল আস্ত একটি দেশ! ছাত্র-যুব সমাজ এগিয়ে এসেছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশটা নতুন করে গড়তে। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছিল ক্লাব সংস্কৃতি। কোথাও সবুজ সংঘ, তো কোথাও কিশোর সংঘ। তৈরি হয়েছিল মুকুল ফৌজ। পাড়ায় পাড়ায় পিটি শেখা, ডাম্বেল নিয়ে চমৎকার ড্রিল, বিজয় দিবসে প্যারেড করার প্রস্তুতি। সপ্তাহে একদিন কোথাও চলত বই পড়া। চলত নানা বিষয়ে আলোচনা, কুইজ প্রতিযোগিতা। ক্লাবগুলির মধ্যে তীব্র রেষারেষি ছিল ফুটবল খেলাকেন্দ্রিক। মারামারিও লেগে যেত। তারপর নানা জটিলতায় একসময় যে ক্লাবগুলিতে জড়িয়ে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, তেমন অনেক ক্লাবে মাতব্বর হয়ে ওঠে জামাত শিবিরের ভক্তরা। একটা দেশ বহু রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু ধর্মের নামে সেই স্বাধীনতার বিরোধীরা সমাজের অন্দরে বহাল তবিয়তে রয়ে গেল। ৪ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানির বিচার আর হল না। তার আগেই ইতিহাসকে উল্টো পথে হাঁটতে বাধ্য করা হল।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ পর্যন্ত একরকম ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ‘নায়ক’, বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদেরই তাঁর প্রধান শত্রু বানিয়ে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশ চলা শুরু করে একেবারে উল্টো পথে। সদ্য স্বাধীন দেশে ফের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলে মহম্মদ আলি জিন্না ও মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্ব। ১৯৭৮ সালের পর হঠাৎ কিছু মানুষের টাকা বাড়তে থাকে। সেই সময় থেকেই হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারটা বড় আকার নেয়। তখন আওয়ামি লিগ নাম মুখে আনাও নিষেধ। মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল— হিন্দুরা সব আওয়ামি লিগের সমর্থক। ভারত বিরোধিতা তখন তুঙ্গে। সেই সময় থেকে বাংলাদেশে হিন্দুরা কোণঠাসা হতে থাকে। কেউ কেউ ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়।
১৯৭৫-এর পর সৌদির রাষ্ট্রদূতের প্রকাশ্য তৎপরতায় ‘জামাত শিবির’ পুনর্গঠিত হয়। হঠাৎ করে মসজিদের ইমামদের মুখ থেকে ‘লোক দেখানো’ হাসি উধাও। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তারা। এদের প্রভাবে ক্লাব-সংস্কৃতি ভুলে কিছু মানুষ ক্রমশ মসজিদমুখী হয়ে ওঠে। শুক্রবার হলে স্নান করে সেজেগুজে জুম্মার নামাজ পড়তেই হবে। মসজিদে নামাজের পর প্রকাশ্যেই জামাত শিবিরের নেতারা মুরগি ধরত (কর্মী জোগাড় করত)। একসময় চতুর্দিকে ঘুষখোর ছেয়ে গেল। মসজিদে তাদেরই আধিপত্য। কলোনির বাসিন্দাদের কেউ কেউ জাপান থেকে গাড়ি আমদানি করল। কীভাবে, তা প্রশ্ন করার কোনও অধিকার নেই। কোরবানিতে কার গোরু কত বড়, সেই প্রতিযোগিতা শুরু হল। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার খোঁজে বাংলাদেশের কিছু মানুষ তখন দুবাই, সৌদি ছুটে গিয়েছে। যাদের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে কোনওভাবেই অংশ নেয়নি, সমর্থন করেনি এবং যারা বিরোধিতা করেছিল, তারা দ্রুত ‘বড়লোক’ হয়ে ওঠে। ফলে সমাজে তারাই নেতা। তারাই সমাজের গতিপথ ঠিক করা শুরু করে।
বাংলাদেশের সামরিক সরকার ‘পাকিস্তানি হানাদার, রাজাকার, বঙ্গবন্ধু, বিপ্লবী’ এসব শব্দ রেডিও-টিভিতে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ভাষার বন্ধনকে ইসলামাবাদের তাঁবেদার শাসকরা ভয় পেত বলেই ধর্মকে বাহন করতে শুরু করেছিল প্রথম থেকেই। ভেঙে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা সমাজ-সংস্কৃতি। জিয়ার সামরিক সরকার পাকিস্তান থেকে নাচিয়েদের এনে যাত্রাপালার মধ্যে অশ্লীল নাচ ঢুকিয়ে দিল। ফলে অশ্লীলতার কারণে মানুষ যাত্রাবিমুখ, আবার সেই একই অভিযোগে মোল্লারা ভালো যাত্রাপালাগুলিও চিরদিনের মতো বিদায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সিনেমায় শুরু হয়েছিল যৌন সুড়সুড়িতে পূর্ণ নাচগান। সিনেমা হয়ে গেল বখাটেদের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ, কাজি নজরুল হয়ে গেলেন অপাংক্তেয়। অপরদিকে সংস্কৃতি জগতের মাতব্বররা সমানে রাজাকার, আল বদর, ধর্ষণ, হত্যা, পাকিস্তান এসবের সঙ্গে ইসলাম ধর্মকে গুলিয়ে দেন। ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। সাংস্কৃতিক শূন্যতার মধ্যে উদ্ভব হয়েছে মাদক, পর্ণ ছবি, ওয়াজ মাহফিলের নামে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। আর খোদ ইসলাম ধর্মের মৌল শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে ওয়াহাবিজমের সূচনা। অপর প্রান্তে তখন প্রগতিশীলতার টানাপড়েন। শাহরিয়ার কবীর লিখলেন ‘একাত্তরের যিশু’। লিখলেন, কেন মুক্তিযুদ্ধে ইমাম, মোল্লা বা দরবেশের কোনও অবদান নেই?
ক্রমাগত দুই মুখী প্রচারের ফলে একটা প্রজন্মের মধ্যে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এগিয়ে আসে কাওমি মাদ্রাসার সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের থেকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিকে এই যাত্রা আরও সংহত ও জোরদার হল ১৯৮১-তে। জিয়ার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে। ১৯৮৮-তে এরশাদ ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় ধর্ম বলে ঘোষণা করলেন। তখন থেকেই ধর্মের বর্মের আড়ালে শক্তিশালী হতে শুরু করে কাওমি মাদ্রাসার হুজুরেরা। এই হুজুরদের বেশিরভাগের সাদাসিধে জীবন যাপন এবং এদের সমস্ত চিন্তাভাবনা ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্ম বিষয়ে কোনও প্রশ্ন এলে বড় হুজুর যা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত। বড় হুজুরেরা আবার করাচি, লাহোর, জেড্ডা, রিয়াধের বড় ভাইদের কথাই চূড়ান্ত মনে করেন। এই মৌলবাদীদের হাত ধরেই ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি-জামাত। উল্টোদিকে একদল উগ্র আধুনিকতাবাদী মুক্তিযুদ্ধের পর পুরনো সব কিছুই ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলেন। কিন্তু পুরনো প্রথা, আচার, ঐতিহ্যের পরিবর্তে নতুন কোনও বিকল্প জোগান দিতে ব্যর্থ হলেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের দগদগে ক্ষত নিয়ে মানুষ নীরবে দেখল তার মনোজগত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এগিয়ে এল ওয়াহাবিজম। ৯/১১ পরবর্তীকালে বিশ্বের মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তীব্র হলে ওয়াহাবি সালাফি ইসলামই প্রবলভাবে সামনে উপস্থিত হল— বাংলাদেশের একাংশ এই ভয়ঙ্কর মতাদর্শকেই তার আশ্রয় হিসেবে বেছে নিল।
যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন কঠিন, তবে মুক্ত দেশে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখাও কিছু কম কঠিন নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি স্তম্ভস্বরূপ হয়ে উঠেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু বলতেন, স্বাধীন বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি সকলের, প্রত্যেককে রক্ষা করাই প্রত্যেকের ধর্ম হবে। তাঁর স্বপ্ন ছিল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলন যে জাতির মজ্জায়। তার স্বাধীন সত্তা প্রোথিত হবে ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সমাজে সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের অভ্যাস ও আচরণ থাকবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। দেশকে একসূত্রে বাঁধবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-আশ্রয়ী উদার বাঙালিত্ব। সেই স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বিএনপি-জামাত জমানায়। মুজিবকে প্রত্যাখান করে বিরোধী ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে তারা। ২০০১ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষাবিহীন একটা প্রজন্মের উত্থান, তথ্য প্রবাহের বিপুল আয়োজন, ভারতের আগ্রাসী মনোভাব এবং ভারতে হিন্দু উগ্রবাদের প্রচণ্ডতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইসলামি উগ্রবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাবি ছাত্রীর সংখ্যা তখন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলির সমাবেশকে লজ্জা দিত। ফেসবুকে বিপ্লবী সেই প্রজন্ম আজও নীরব থেকে জামাত শিবিরকেই সমর্থন দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন পর্বের শুরু ২০০৮ সাল থেকেই। সেই কঠিন সময়ে ভারত প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়ায়। সেই সময়ে আওয়ামি সরকার উৎখাত হয়ে গেলে জামাতের শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে পারত। আজও জামাত সেই ক্ষোভে ভারত বিরোধী প্রচার চালায়। কখনও প্রকাশ্যে, কখনও গোপনে। বাংলাদেশ জন্মের দশকেই একের পর এক রাজনৈতিক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে লিবারেল মুসলিম নেশন থেকে এক ইসলামিক নেশনের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। সংখ্যাগুরুবাদের সেই ধারণার সঙ্গে লিবারেল মুসলিম নেশনের ধারণার লড়াই এখনও জারি রয়েছে। আশার কথা সেটাই। নয়তো বাংলাদেশ হয়তো ইতিমধ্যেই পিছনে হাঁটতে শুরু করত। ১৯৭১-এ, বাংলাদেশের জন্মের সময়, পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্বের তুলনায় ৭০ শতাংশ ধনশালী দেশ। আর আজ বাংলাদেশ জিডিপি-র মাপে সেই পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি সম্পদশালী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, সেই মতাদর্শ ফিরিয়ে আনতে, যেখানে ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে, তবে মাথায় তুলে নয়। সুফিবাদের মৃত শাখাটিকে সঞ্জীবিত করতে হবে— ওয়াহাবিজমের কাউন্টার ন্যারেটিভ হিসেবে। কিন্তু হাসিনা পারেননি জামাতকে উৎখাত করতে। জামাত সেখানে একটা রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র। তাদের অর্থনীতি বৃদ্ধির হার জাতীয় আয়ের থেকেও বেশি। ফলে মৌলবাদ সেখানে দিনের পর দিন আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই জামাত শিবিরের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। নেই ভারতের প্রতিও। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তারা আজীবন শুধু রাজনৈতিক খেলা খেলে গিয়েছে। এই পর্বে যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে সব রাজনৈতিক দলগুলির উলঙ্গ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ক্ষমতার স্বাদ পেতে জামাত শিবিরের অনেকে মিশে গিয়েছে আওয়ামি লিগের সঙ্গে। অভিযোগ, আজ অধিকাংশ সাংসদ লুটেরা বাটপাড়। এদের অনেকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কালো টাকা দিয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা বানায়। সেই মাদ্রাসা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি জমি দখল করে গড়া। ফলে বাংলাদেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলতে মৌলবাদীদের বেশি সময় নষ্ট করতে হয়নি। সম্প্রতি কোটা বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে রয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আন্দোলনের নামে ছাত্রসমাজকে আগুনের সামনে লেলিয়ে দেওয়ার মতো সহজ কাজে উস্কানি দিয়ে গিয়েছে বিএনপি ও জামাত-ই-ইসলামির মতো মৌলবাদী গোষ্ঠী। আজ তারাই ছাত্র আন্দোলনের মুখোশ পরে সুর চড়িয়ে স্লোগান দিয়েছে, ‘ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।’ কে না জানে, গত মার্চে এই বিএনপি স্লোগান তুলেছিল ‘ইন্ডিয়া আউট’। আর তার তিন মাস পরেই আগুনে পুড়েছে বাংলাদেশ। এ যেন এক একটি ‘প্লট’! প্রশ্ন জাগে মনে, বাংলাদেশ কি তবে মৌলবাদের কাছে হেরে যাবে? একটা স্বপ্নের মৃত্যু কি অবশ্যম্ভাবী?