স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমরা দেখতে পাই যে বহু মানুষ আচরণগতভাবে কেবল লেনদেনে বিশ্বাসী। দুটি মানুষ কিংবা তাদের দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে এই লেনদেনের সম্পর্কটা আসলে কী? এটা এইরকম যে, ‘তুমি আমার কোনও উপকার করলে, আমিও তোমার কিছু উপকার করব।’ ইংরেজি কথোপকথনে এটাকে বলা হয় ‘কুইড প্রো কো’। ব্যাপারটা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও পণ্য বা পরিষেবা বিনিময়ের চুক্তি সম্পাদনের মানসিকতা। অফিসিয়াল সিদ্ধান্তের জন্য ঘুষের লেনদেনও এই গোত্রের কারবার। প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকা দেওয়া-নেওয়াও এই ধরনের একটি লেনদেন। মোদি সরকার লেনদেনের কারবারকে একটা বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। সরকারি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচনী বন্ড কেনা হয়েছে অথবা কেনা হবে। নির্বাচনী বন্ড স্কিমের আসল ধান্দাটা কী, সবাই বুঝতে পেরেছে। দেরিতে হলেও সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু যথার্থভাবেই পুরো স্কিমটি বাতিল করে দিয়েছে। তবে এত বড় নির্দেশ দিয়েও শীর্ষ আদালত এই স্কিমের গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে তাদের সংযম রক্ষা করেছে।
কুর্সি বাঁচাও
২৩ জুলাই, ২০২৪। মোদির এনডিএ সরকার লেনাদেনার কারবারটিকে একটি নতুন উচ্চতায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছে। ২০২৪-২৫ সালের বাজেটের পিছনে মূল যে ‘প্রেরণা’ সক্রিয় তা এককথায়—‘কীভাবে সরকারটাকে বাঁচানো যায়।’ মোদ্দা কথা, এবার নির্মলা সীতারামন সংসদে যে বাজেট পেশ করেছেন তা হল—‘কুর্সি বাঁচাও’ বাজেট। বাজেট রচয়িত্রী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে কাজটি করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। বাজেট প্রস্তাব নিয়ে নির্মলা সীতারামন এবং তাঁর সচিবদের বাজেট-পরবর্তী ব্যাখ্যা—দুই জোট শরিকের সমর্থন হাসিলের নগ্ন প্রচেষ্টাকেই প্রকট করে দিয়েছে। তেলুগু দেশম পার্টির (টিডিপি) ১৬ এবং জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডিইউ) ১২ ভোটের বিনিময়ে—দুটি রাজ্যকে যথেচ্ছ উপঢৌকন বিতরণ করা হয়েছে। বিহারকে দেওয়া হয়েছে শিল্প হাব, সংযোগ প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির ‘উন্নয়নের জন্য’ বিপুল অর্থ।
অন্যদিকে, অন্ধ্রপ্রদেশ পেয়েছে পোলাভরম সেচ প্রকল্প, শিল্প করিডর এবং অনগ্রসর অঞ্চলগুলির জন্য বিপুল আর্থিক অনুদান। সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক আশ্বাস এটাই যে, বহিরাগত সহায়তা (এক্সটারনাল অ্যাসিস্ট্যান্স) ‘দ্রুত’ বা ‘অ্যারেঞ্জড’ করে দেওয়ার খোয়াব দেখানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশ—এই তিনের মধ্যে চূড়ান্ত দরকষাকষির রাজনীতির কাছে ‘পরাজয়’ ঘটেছে এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া রাজ্যগুলির। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সাংসদদের মতে এবার প্রতারণার শিকার হয়েছে—পশ্চিমবঙ্গ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরল, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রশাসিত দিল্লি।
যুবরা প্রতারিত
উপর্যুউক্ত রাজ্যগুলির সঙ্গে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণও এই বাজেটকে তাদের পাশে পায়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার শীর্ষে তরুণ বা যুবরা। বেকারত্ব বাড়ছে এবং বেপরোয়া হয়ে পড়ছে যুবসমাজ। আর্থ-সামাজিকে ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ সংস্থা সিএমআইই’র মতে, গত জুন মাসে বেকারত্বের সর্বভারতীয় হার ছিল ৯.২ শতাংশ। স্নাতকদের মধ্যে এই শতাংশ হার প্রায় ৪০। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্ট বলছে, কর্মরতদের মধ্যে মাত্র ২০.৯ শতাংশ নিয়মিত বেতন পেয়ে থাকেন। ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও সত্যি যে, সবচেয়ে কম শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বও সবচেয়ে কম! বাজেট ভাষণে একটি এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ (ইএলআই) স্কিমের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, ২ কোটি ৯০ লক্ষ যুবক-যুবতীকে চাকরিতে নিয়োগ করার জন্য নিয়োগকর্তাদের আর্থিক ইনসেনটিভ দেবে সরকার। এইভাবে পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ লক্ষ তরুণ-তরুণীকে কর্মক্ষেত্রের উপযোগী দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া ১ কোটি যুবক-যুবতীকে দেওয়া হবে ইন্টার্নশিপের সুযোগ। এজন্য চিহ্নিত কোম্পানির সংখ্যা অবশ্য ৫০০ মাত্র! সুতরাং কর্মসংস্থানের এই বিপুল সংখ্যাটি যে নির্বাচনোত্তর একটি মারাত্মক ‘জুমলা’ই হতে চলেছে, তার ইঙ্গিত এতে স্পষ্ট।
এই দর কষাকষির মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে ৩০ লক্ষ শূন্যপদের কোনও জায়গা হয়নি, এমনকী কানে আসেনি এই সংক্রান্ত ফিসফিসানিও। এটাও সম্ভব যে বহুচর্চিত প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিমের বেনিফিট পরিমাপ ছাড়াই কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। ফলে এত এত চাকরির গপ্পো নীরবে ভোঁ-ভাঁ হয়ে যেতে পারে। অনাদায়ী শিক্ষাঋণ মকুবের সর্বজনীন দাবির কোনও উল্লেখ দেখিনি। অথচ, এই সমস্যা অসংখ্য পরিবারকে হতাশার কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। একজন সৈনিকের সঙ্গে আর-একজন সৈনিকের বৈষম্য সৃষ্টিকারী বহু বিতর্কিত ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের ভাগ্যে কী আছে? এই বাজেট সেই সম্পর্কেও স্পিকটি নট!
গরিবরা প্রতারিত
এই বাজেটে অন্য যে বড় অংশের মানুষ নিজেদের প্রতারিত বলে মনে করছে, তারা নিঃসন্দেহে দরিদ্র। স্পষ্টতই, নীতি আয়োগের সিইও-র মনোভাবই শেয়ার করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা দেবী—দুর্ভাবনার কিছু নেই, ভারতে গরিব মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি নাও হতে পারে। অথচ বর্তমান মূল্যে বা নমিনাল প্রাইসে সরকারের তরফে যে গৃহস্থালি ভোগব্যয় জরিপের (এইচসিইএস) ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। তাতে বলা হয়েছে—দেশে মাসিক মাথাপিছু ব্যয়ের (এমপিসিই) ‘মিডিয়ান’ গ্রামীণ এলাকায় ৩,০৯৪ টাকা এবং শহুরে এলাকায় ৪,৯৬৩ টাকা। তার মানে ভারতের ৭১ কোটি মানুষের দৈনিক আয় মাত্র ১০০-১৫০ টাকা বা তারও কম। আমরা যদি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে ছবিটার আরও গভীরে গিয়ে দেখতে চাই, তবে খারাপটাই দেখতে পাব। একেবারে নীচের দিকের ২০ শতাংশ মানুষ বেঁচে আছে দৈনিক মাত্র ৭০-১০০ টাকার জোরে। একেবারে তলানিতে যে ১০ শতাংশ মানুষ, তাদের কী হাল? তাদের দৈনিক খরচের ক্ষমতা ৬০-৯০ টাকা মাত্র! মোদি সরকার এবার বলুক, তারা গরিব নাকি অন্য কিছু?
অর্থমন্ত্রী জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে—
• বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি—নিম্ন, স্থিতিশীল এবং ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগচ্ছে।
• নতুন কর ব্যবস্থায় একজন বেতনভোগী এবং পেনশনভোগী ১৭,৫০০ টাকা পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স রিলিফ পাবেন।
জনসংখ্যার নীচের দিকের ৫০ শতাংশ বা ৭১ কোটি মানুষ না বেতনভোগী কর্মচারী, না তাঁরা সরকারি পেনশনভোগী। এই বিপুল সংখ্যক নাগরিকের জন্য অর্থমন্ত্রী তো সামান্যতম চিন্তাও করললেন না! তাঁরাও জিএসটি’র মতো পরোক্ষ করের আকারে সরকারকে নিয়মিত কর প্রদান করেন। দেশে দিনমজুর বা অস্থায়ী শ্রমিক প্রায় ৩০ কোটি। ছ’বছর যাবৎ তাঁদের প্রকৃত মজুরির কোনও বৃদ্ধি ঘটেনি, অগ্নিমূল্যর বাজারে সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে তাঁদের আয়পত্তর।
গরিব মানুষকে একটু সুরাহা দেওয়ার উপায় রয়েছে। সব ধরনের কাজের জন্য ন্যূনতম মজুরি (মনরেগার অধীনে কাজসহ) দৈনিক ৪০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। এজন্য মনরেগা তহবিলে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তাহলে এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মাধ্যমে বার্ষিক কাজের দিনের গড় সংখ্যা বাড়ানো যাবে। এখন তো বছরে মাথাপিছু গড়ে বড় জোর ৫০ দিন কাজ দেওয়া হয়। অথচ, সংশ্লিষ্ট আইনে মনরেগায় বছরে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা রয়েছে। সরকার আন্তরিক হলে বছরে মাথাপিছু ১০০ দিনের কাছাকাছি কাজের ব্যবস্থা হতেই পারে। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতির সমস্যাটির মোকাবিলা করা যেতে পারে আরও গুরুত্বসহকারে।
প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত যে, অন্যান্য নাগরিকদের মধ্যে যুবক-যুবতী এবং গরিবদের হাতে একটি মারাত্মক ‘অস্ত্র’ রয়েছে—তার নাম হল ভোট। এবারের লোকসভা নির্বাচনেই কিন্তু তাঁরা বিজেপিকে বেশ কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। অতিসম্প্রতি অনুষ্ঠিত ১৩ আসনের উপনির্বাচনেও বিজেপিকে জোরসে থাপ্পড় কষিয়েছেন তাঁরা। মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা এবং ঝাড়খণ্ডে বিধানসভার নির্বাচন কিন্তু ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালে নির্বাচনের আসর আছে আরও অধিক সংখ্যক। যুব সমাজ এবং গরিব মানুষজন ভুলে যাবেন না যে ২৩ জুলাই, ২০২৪ তারিখে মোদি সরকার তাঁদের সঙ্গে প্রতারণাই করেছিল।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত