শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,—একাকী কাজ ক’রে মানুষ কতটা এগুতে পারে? কর্ম্মযজ্ঞে অনেক লোকের একত্র মিলন একান্তই আবশ্যক। একের শক্তি অপরের শক্তির সঙ্গে মিলিয়ে জনকল্যাণকর্ম্মে তার প্রয়োগের অনুশীলন খুব বড় রকমের একটা যজ্ঞ। ছোট ছোট উপনদীর জল আস্তে আস্তে পরস্পরের সঙ্গে মিলে যেমন হঠাৎ একদিন একটা বিরাট গঙ্গায়, বিরাট ব্রহ্মপুত্রে বা বিরাট গোদাবরীতে বা বিরাট নর্ম্মদায় পরিণত হয়, এ’ও ঠিক তাই, জান্বে। এক মানুষের শক্তিকে অপর মানুষের শক্তির সঙ্গে মিলানোর সাধনা এই জন্যই মানব-জাতির সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীক জীবনে এবং স্থলবিশেষে আধ্যাত্মিক জীবনেও এক মহাশুভ ঘটনা। কার সঙ্গে কাকে মিলান যায়, লক্ষ্য হওয়া উচিত তা। কার কাছ থেকে কাকে দূরে সরান যায়, এই বুদ্ধি ক্ষীণজীবীর বা স্বার্থপরের হ’লে হ’তে পারে। পৃথিবীর সব মহারথেরা নিজ নিজ বুদ্ধিবিদ্যানুযায়ী মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিত ক’রেই সংঘশক্তির সৃষ্টি করেছেন। কথায় বলে,—সঙ্ঘে শক্তিঃ কলৌ যুগে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি সব যুগেই সঙ্ঘবদ্ধতায়ই শক্তি, বিচ্ছিন্নতায়ই দুর্ব্বলতা ও পরাভব।
সমস্যা থাকিবেই
জনৈক প্রশ্নকর্ত্তার প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,— মানুষের সমস্যার অন্তও নাই, অবধিও নাই। যতক্ষণ সে বিবেক-বুদ্ধি-সমন্বিত একটী চিন্তাশীল জীব, ততক্ষণ প্রতি মুহূর্ত্তে একটা না একটা সমস্যা তার হয় সহচর হবে, নয় প্রতিবন্ধক হ’য়ে দাঁড়াবে। দুই বন্ধুর প্রতিজ্ঞা ছিল যে, তাদের একই দিনে বিবাহ হবে, একটা আসরে বিবাহের মন্ত্রপাঠ হবে, একই পুরোহিত শুভকর্ম্ম করাবেন, একই শানাইওয়ালা শানাই বাজাবে ইত্যাদি। কার্য্যকালে তা হ’লেও কিন্তু একটী বিভ্রাট সকলের অজ্ঞাতসারে ঘ’টে গেল। বরকন্যা বাসরশয়নে যখন গেলেন, তখন এক বরের কনে অন্য বরের কনে হ’য়ে গেলেন। এই ভুলটা কারো চক্ষে তখন পড়ল না, উৎসবের হৈ-হুল্লোড়ে কি যে একটা কাণ্ড হ’য়ে গেল। পরদিন ঊষাগমে কন্যারা প্রথম অনুভব কল্ল যে, তারা নিজ নিজ স্বামীর কাছে রাত্রি যাপন করে নি, যাঁর সঙ্গে মন্ত্রপাঠ করে বিয়ে হয়েছিল, তাঁর কাছে অন্য কনেটী গিয়েছে। কি সর্ব্বনাশ! এমন সাংঘাতিক কথা কে জীবনে নিজের মুখে প্রকাশ ক’রে স্বীকার কত্তে পারে, বল ত! বরেরা বুঝলেন অনেক পরে। কিন্তু ততক্ষণে দুই কন্যাপক্ষের আত্মীয়দের কাছে বিপদটী পরিষ্কার-রূপে ধরা পড়েছে! এক বর বল্লেন,—আসল বিবাহ ত নিশাযাপনে। মন্ত্রে-ফন্ত্রে কি আসে যায়? সুতরাং যা’ হয়েছে, ঠিকই হয়েছে। আমি আমার বউ ছাড়ব না। অপর বর বল্লেন,—সর্ব্বশাস্ত্র মন্থন ক’রে বৈদিক আচার্য্যেরা বিবাহের যে পবিত্র বিধি আবিষ্কার করেছেন, তার মতানুবর্ত্তী হওয়াটাই আসল বিবাহ, পরের বউ ভ্রমক্রমে আমার ঘরে এক রাত্রি বাস ক’রে গেছে ব’লেই সে আমার স্ত্রী হবে কেন? সে পরস্ত্রী। ভ্রমক্রমে পরস্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হ’য়ে গেছে ব’লেই চিরকাল তার সংসর্গকে ধন্য ব’লে মনে কত্তে হবে, এমন বিচারবুদ্ধি আমার নেই। আমার বউ আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমি তাকেই আমার ঘরের লক্ষ্মী কর্ব্ব। লোকটীর মন নিশ্চয়ই উদার, কিন্তু তার সমাজ তাকে এজন্য শাসন না ক’রে ছাড়বে কি? যা’ ঘ’টে গেছে, তাই মেনে নাও।
স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের উপদেশ-বাণী (২১ খণ্ড) থেকে