এবার হ’ল অনৈশ্বর্য্যের ভাব। সব অবতারেই আমরা দেখতে পাই কিছু না কিছু সিদ্ধাই আছেই। এই ধর না কেন, ৫ খানা রুটিতে ৫০০ লোক খাওয়ান, নদী শাসন করা, শূন্য-মার্গ দিয়া চলা, আম গাছ ক’রে আম খাওয়ান ইত্যাদি। এবার আমি কিন্তু তার একেবারেই অভাব দেখি। এবারকারের মজাই হচ্ছে অনৈশ্বর্য্য। আবার দেখ, সব অবতারেতেই ‘‘রূপের ছটায় ভুবন করে আলো।’’ কিন্তু এবার দৈহিক রূপের অভাব। তাই গিরীশ বাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘হ্যাগা এবার রূপ নাই কেন গা?’’ সাধন অবস্থায় যখন দেহ থেকে জ্যোতিঃ বেরুতে লাগলো তখন মাকে বলেছিলেন, ‘‘দৈহিক রূপে কার্য নাই মা, আধ্যাত্মিক রূপ দে।’’ তারপর, সব অবতারেরা সর্ব্বশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিত; কিন্তু আমাদের কারবার অন্য রকমের লোক নিয়ে। এই দেখ না, চৈতন্যদেব দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকে হারিয়ে তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলে খ্যাত ছিলেন; শঙ্করাচার্য্যের আর কথা কি? বুদ্ধদেব নানাশাস্ত্র পড়ে মুক্তি বিষয়ে হতাশ হয়েছিলেন, এবং সর্ব্বোপনিষদের দোহনকর্ত্তা যে নিশ্চয়ই ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ কি? কিন্তু আমাদের ঠাকুর—এ এক অদ্ভুত ব্যাপার—যো সো করে লিখতে পড়তে পার্ত্তেন মাত্র, কিন্তু পণ্ডিতগুলো বিচার করতে এসে কেঁচোর মত হয়ে যেত। কেন জানিস? উপলব্ধি আর তর্কের দ্বারা বুঝা ঢের প্রভেদ। ম্যাপ দেখে কাশীর কথা আর কতটুকু বুঝান যায়? যে কাশী দেখে এসেছে, তারই কথা সকলে শোনে। তিনি সব তালার খবর জানিতেন। স্বামীজীর প্রশংসিত কোন ব্যক্তির কথা স্বামীজীর কাছ থেকে শুনে বলে দিলেন, তিনি কোন থাকের লোক।
আবার সব অবতারেরা নিজের নিজের মত প্রকাশ্যে প্রচার করে গিয়েছেন। ইনি নিজের কথা কখনও প্রচার করেন নাই। যারা ভালবাসে শুন্তে তাদের কাছে বলতেন। কেশব বাবু কাগজে তাঁর কথা লেখায়, তাকে তাঁর নিকটে আসতে মানা করেছিলেন। একদিন রাত দুপুরে উঠে দেখি পায়চারী কচ্চেন, আর থু থু করে শব্দ করচেন, আর বলচেন, ‘‘লোক মান্যি দিসনে মা, লোক মান্যি দিসনে মা’’ তখন অর্দ্ধবাহ্য দশা। আমার বোধ হ’ল যেন মা আনন্দময়ী মান-যশের ধামা নিয়ে তাঁর পেছনে পেছনে ঘুরচেন, আর বলচেন, এই নে বাবা তোর জন্য মান যশ এনেছি।’’ আর তিনি আরও উচ্চস্বরে থু থু কচ্চেন, আর ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মুখে ঘোর বিরক্তির চিহ্ন। কখনও মানযশের দিকে যেও না। মানযশ হজম করা কি সোজা ব্যাপার? যাঁরা নামরূপের পারে চলে গেছেন, তাঁদের নামে কিছু কর্ত্তে পারে না।
ঠাকুর বলতেন, ‘‘ফুল ফোটাও, মৌমাছি আপনি আসবে। চরিত্র গঠন কর, সুন্দর চরিত্র দেখে জগৎ মুগ্ধ হয়ে যাবে।’’ সকলেই নিজের মতটাকে শ্রেষ্ঠ ব’লে গিয়েছেন এবং কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর মত অবলম্বন না কল্লে আর কিছু হবে না। কিন্তু আমাদের ঠাকুর বলতেন, ‘‘যত মত তত পথ; কারণ তিনি অনন্ত।’’ হাতীর পা ছুঁয়ে একজন অন্ধ বল্লে, হাতী থামের মত, কান ছুঁয়ে আর একজন বল্লে, কুলোর মত। উভয়েই ঠিক, আবার উভয়েই ভুল। তাই এত ঝগড়া বিবাদ। কেউ হাতীটার পূর্ণ অঙ্গ দেখেনি। তিনি নিজ জীবনে দেখালেন, সব মত অবলম্বন করে সব পথ দিয়ে সত্য লাভ করা যায়, এবং বল্লেন ঝগড়া বিবাদে দরকার নাই, সব মত ঠিক।
ব্রহ্মচারী জ্ঞান মহারাজের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব’ থেকে