“দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে”
এক অখণ্ড চৈতন্যশক্তি হ’তে অখিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সকল চিৎ ও জড় বস্তু উৎপন্ন হয়েছে এই সনাতনবাণী সুপ্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির মূলমন্ত্র। এই চৈতন্যশক্তি এবং সর্ব্বশক্তিমান্ পরমাত্মা অভিন্ন। শক্তির মহিমা শক্তিমানেরই। বিশ্বের সর্ব্বত্রই বিশ্বব্যাপিনী শক্তির খেলা। সেই শক্তি অমূর্ত্ত আবার মূর্ত্ত। হিন্দুর দুর্গোৎসব সেই অখণ্ড মহাশক্তির আরাধনা—মৃন্ময়ী প্রভৃতি মূর্ত্তিতে চিন্ময়ী, আনন্দময়ী ও সনাতনী বিশ্বজননীর বোধন ও অর্চনা। এই অনুষ্ঠান কেবল খড় মাটির রঙ্গীন পুতুল পূজা নয়। পরব্রহ্মকে মা বলে ডাকতে এবং মাতৃরূপে দেখতে হিন্দুর খুব ভাল লাগে যদিও একই তিনি পিতা, পুত্র, সখা, বন্ধু, পতি, পত্নী ও বিশ্বের যা কিছু সবই। লৌকিক সংসারে মায়ের সঙ্গেই সন্তানের সম্পর্ক অধিক ঘনিষ্ঠ। মায়ের নিকট সন্তানের যত কিছু আপত্তি আবদার ও উপদ্রব। মা’ই সন্তানের সব মালিন্য পরিষ্কার করে তাকে সযত্নে লালন পালন করেন এবং দুষ্ট সন্তানের প্রতি রুষ্ট পিতার ক্রোধের শান্তি করান। সেই জন্যই পরব্রহ্মের মাতৃরূপে উপাসনা হিন্দুর ধর্ম্ম জীবনে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে অতি প্রাচীন যুগ হ’তে। শক্তিবাদের মহিমায় বেদ, উপনিষদ, তন্ত্র ও পুরাণ প্রভৃতি হিন্দুর শাস্ত্র সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। আবার জগতের মহাজননীকে আদরিণী কন্যারূপে ভাবনায় হিন্দুর যে প্রাণস্পর্শী বাৎসল্য রসের সৃষ্টি হয়েছে এবং নানা সাহিত্য, পদাবলী ও মাতৃসঙ্গীতে তার অভিব্যক্তি ঘটেছে বৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ বাৎসল্যরসের ও সম্বোদন সেখানে পরাজিত সন্দেহ নাই। দুর্গাপূজার প্রারম্ভে মায়ের আগমনী ও শেষে বিজয়ার মাধ্যমে মাতৃভক্ত হিন্দুর বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে যে সকল পবিত্র ভাবের প্রকাশ ঘটে সে সকল কেবল অনুভবের বস্তু অন্যকে দেখাবার নয়। মায়ের মহাস্নানের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানেরও নয়ন জলে স্নান এবং পূজায় ‘সর্বাত্মস্নপন’ হয়ে যায়। মায়ের পূজার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের ও হৃদয় পবিত্র, হিংসাদ্বেষমুক্ত ও প্রীতিযুক্ত হয়। সন্তান-নির্ভীক হয়, সমাজ কল্যাণ ও দুষ্টদমনের জন্য শক্তি অর্জন করে। আত্মিক বলে বলীয়ান হয়ে সে সমগ্র বৎসর ধরে চলার পথের পাথেয় সংগ্রহ করে। তাই ভারতীয় হিন্দুর জাতীয় মহোৎসব এই দুর্গাপূজা। ভারত সংস্কৃতির সহিত এই উৎসবের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য।
মহামহিমময়ী এই মহাদেবীর একটি নাম মহামায়া। তাঁর পূজার তিথি মহাষ্টমী ও মহানবমী এবং পূজা মহাপূজা। তাঁর স্নান মহাস্নান। যাঁরা তাঁর উপাসনা করেন তাঁরাও মহান হয়ে যান। জগতে আমরা নির্ব্বিঘ্নে কর্ম্ম সিদ্ধি চাই, ধন, বিদ্যা, শক্তি সামর্থ্য ও জীবন ধারণের জন্য কৃষির উন্নতি চাই। কিন্তু সবটাতেই ঈশ্বরের সহিত সম্বন্ধ রেখে চলার জন্য আমাদের পূর্ব্বপুরুষ ঋষি মুনিদের আদেশ। ঈশ্বর সম্পর্ক না থাকলে সবই বিফল এবং ফল বিষময়। দুর্গা প্রতিমার মধ্যে আছেন বিঘ্ননাশন সিদ্ধিদাতা গণেশ, ধনদাত্রী লক্ষ্মী, বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী, মহাবল সেনাপতি কার্ত্তিক। মা স্বয়ং অশুভনাশিনী, সঙ্কটতারিণী, সন্তানপালিনী মহাশক্তিময়ী। মায়ের অনুগত হ’লে তাঁর কৃপায় ধন, বিদ্যা প্রভৃতি সবই সুলভ হয়। পশুশক্তি ও অসুর শক্তি মায়ের চরণস্পর্শে বশীভূত হয়েছে। অসুরও দেবতার ন্যায় পূজা পাচ্ছে। মাতৃ সেবকের মধ্যে পশুভাব ও অসুরভাব থাকে না। তখন পশুশক্তি ও আসুরিক শক্তির দ্বারা নিজের ও জগতের কল্যাণ হয়। নব পত্রিকা বা কলাবৌ কৃষি লক্ষ্মীর প্রতীক। রম্ভা, ধান্য, বিল্ব, হরিদ্রা, অশোক ও দাড়িম প্রভৃতি বৃক্ষে জগন্মাতার পূজা কৃষি প্রধান দেশে একটি সার্থক অনুষ্ঠান। মা দুর্গার হস্তে নানা অস্ত্র, প্রতিমার প্রত্যেকটির দেবতার বাহন, বলিদান, হোম এই সকলেরই বিশেষ বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। আনন্দময়ীর পূজায় প্রত্যেক হিন্দুর প্রাণে অপূর্ব্ব আনন্দ জাগে। শরৎ প্রকৃতির সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য মায়ের আগমনী ঘোষণা করে।
জ্যোতির্ময় নন্দ রচিত ‘মাতৃদর্শন’ থেকে