শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন হয়েছিল বিশেষ প্রয়োজনে। তাঁকে যুগাবতার আমরা বলে থাকি, কিন্তু তিনি শুধু এই যুগের জন্য আসেননি। তাঁর বাণী এবং জীবনীর অর্থ প্রকাশিত হতে হাজার হাজার বছর কেটে যাবে। তাঁর প্রভাব বিস্তারিত হতে থাকবে ঘর থেকে ঘরে, দেশ থেকে বিদেশে—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে অনেক সময় লাগবে। তাঁর কতটুকু আমরা আজ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছি বা বুঝতে পারি—আর কতটুকুই-বা ভাষায় প্রকাশ করে বলতে পারি। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, মানবজীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানলাভ। তার উপায় কি? উপায়ও তিনি বলে গেছেন তাঁর বাণীতে এবং সেই উপায়কে রূপায়িত করেছেন নিজের জীবনে। যাঁরা তাঁর বাণী এবং জীবনীর সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন তিনি কী বলে গেছেন এবং কী করে গেছেন এবং তার তাৎপর্য কত সুদূর বিস্তারিত। তিনি একটি কথা বলে গেছেন,—কলিতে নারদীয় ভক্তি। ভগবানলাভের উপায় কি? বলেছেন, কলিতে নারদীয় ভক্তি। সর্বস্ব অর্পণ করে, তাঁর জন্য ব্যকুল হয়ে—সত্য, সরলতা ইত্যাদি অবলম্বন করে সারাজীবন তপস্যায় নিরত থাকা—এই হচ্ছে ভগবানলাভের উপায়। তিনি নিজে মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছেন,—মা এই নাও তোমার শুদ্ধি, এই নাও তোমার অশুদ্ধি, এই নাও তোমার কর্ম, এই নাও তোমার অকর্ম, এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। সেই শুদ্ধাভক্তির জন্য তিনি প্রার্থনা করেছেন এবং আমাদেরও বলে গেছেন এই ভক্তি অবলম্বন করেই ভগবানের কাছে পৌঁছাতে পার। নারদ তাঁর ভক্তি সূত্রে বলেছেন যে, ভক্তির যদি সংজ্ঞা দিতে হয়, সেই সংজ্ঞাটা কি, না—তাঁর প্রতি পরমপ্রেমস্বরূপ। ‘তাঁর প্রতি’ বললেন, কোন বিশেষ দেবতা বা দেবীর নাম করলেন না। সাধারণভাবে বললেন তা ‘তাঁর প্রতি’। ভগবান যে রূপেই থাকুন, যে রূপ ধারণ করে আসুন, মানবের মনে তিনি যেভাবেই উপস্থিত হোন না কেন, তাঁর প্রতি যে পরমপ্রেমস্বরূপ একটা ভাব—তাই-ই হচ্ছে ভক্তি। প্রেম বলতে আমরা সাধারণতঃ মানবজীবনের সর্বোত্তম, সন্নিকট সম্বন্ধ বলে বুঝে থাকি, যে-সম্বন্ধ অবলম্বন করে ম্যনুষ মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় হয়ে থাকে—তাকে আমরা বলি প্রেম। এই প্রেমের যা পরম অবস্থা,—সেই অবস্থার সঙ্গেও তুলনা করলেন না, বললেন সেই পরমপ্রেমের মতো। ভগবানের যে-প্রেম তাঁর কাছে জাগতিক যত প্রকারের আমাদের অনুভূতি বা জাগতিক যত প্রকারের বিশ্বাস প্রত্যয় ইত্যাদি আমাদের রয়েছে—সবকে পেরিয়ে যায় ভগবৎপ্রেম। এমন ভগভৎপ্রেমের কথাকেই ঠাকুর ভক্তি বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তারই কথা বলে গেছেন আমাদের সকলকে গ্রহণ করতে। নিজের জীবনে তিনি তাই করেছেন। ভক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নারদ ভক্তির বাইরের লক্ষণ বলেছেন এবং ভিতরের দিক থেকেও সংজ্ঞা দিয়েছেন। বাইরের দিক থেকে ভক্তির লক্ষণ যদি দেখতে যাই, তবে কি দেখব? দেখব,—ভগবানে সর্বপ্রকার কর্ম অর্পণ করা এবং তাঁর দর্শন পাচ্ছি না বলে পরম ব্যকুলতা।
স্বামী গম্ভীরানন্দের ‘কঃ পন্থাঃ’ থেকে