খুন হয়ে গিয়েছেন একজন ডাক্তার। তাও আবার ‘দেশের সবচেয়ে নিরাপদ মহানগর’ বলে পরিচিত কলকাতারই একটি এলিট সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে। নিহত ডাক্তার একজন মেধাবী তরুণীও বটে। কল্যাণীর জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে তিনি ছিলেন এমডি দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া। সেখানেই ইমারজেন্সি বিভাগের চারতলায় চেস্ট ডিপার্টমেন্টের সেমিনার হলে পাওয়া যায় তাঁর নিথর দেহ! দেহ শুক্রবার সকালে পাওয়া গেলেও খুনের ঘটনাটি আগের রাতের। ওই তরুণী চিকিৎসক-ছাত্রীকে নিছক হত্যাই করা হয়নি, তার উপর সংঘটিত হয়েছে আরও একাধিক নৃশংস অপরাধ। তার যেকোনও একটি ঘটনাই সভ্যতার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! পুলিসি তদন্তে প্রকাশ, বৃহস্পিতবার রাতে ওই তরুণী ডিউটিতে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্নাতকোত্তর শ্রেণির আরও চার পড়ুয়া। তাঁরা সকলেই ডাক্তার। রাতে অনলাইন অর্ডারে খাবার আনিয়ে তাঁরা ডিনার সারেন। রাত আড়াইটে নাগাদ বাকি চারজন সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেও এই তরুণী চিকিৎসক ওই রুমেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজ অনুসারে, ভোর ৪টে নাগাদ ওই সেমিনার হলে এক যুবকের অনধিকার প্রবেশ ঘটে। মিনিট ৩৫ বাদে যুবকটি ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়েও যায়। পুলিসের সন্দেহ, ওই তরুণীর উপর যাবতীয় নৃশংসতা ওই সময়টুকুর ভিতরেই ঘটে গিয়ে থাকবে। শনিবার ময়ানতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পুলিস নিশ্চিত যে, নির্যাতনের আওয়াজ যাতে বাইরে না বেরয় সেই প্ল্যানমাফিক ওই তরুণীর মুখ শুরুতেই আচ্ছা করে চেপে ধরা হয়। কিন্তু দুর্জন তাতেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না-পেয়ে তরুণীকে নির্দয়ভাবে মারধরও করে।
এরপরই তাঁকে ধর্ষণ এবং গলা টিপে হত্যা করা হয়। মৃতকেও ধর্ষণ, এমনকী, তারপর তাঁর মাথার ক্লিপ খুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তরুণীর নিথর যৌনাঙ্গেই! ওই মহিলা ডাক্তারের চোখে, মুখে, গলায় এবং যৌনাঙ্গেও ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ভাঙা ছিল তাঁর গলার হাড়। মৃতার অর্ধনগ্ন দেহটি ছিল একটি তোশকের উপর আর মাথার পাশে পড়েছিল খোলা ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ভাঙা চশমা, চুলের ক্লিপ এবং ব্লুটুথ-যুক্ত এটি হেডফোন। উল্লেখ্য, ওই হেডফোনটি মৃতার নয়! এই পাশবিক কাহিনি যাতে চাপা পড়ে যায়, দুর্বৃত্তটি সেই দুরাশায় অকুস্থল ছেড়ে যাওয়ার আগে মৃতার হাত দুটি উপর দিকে এমন ভঙ্গিতে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল যে দেখে মনে হবে, তিনি অঘোরে ঘুমোচ্ছেন! তবে অন্যদের ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। দেহটি উদ্ধার করার পরই টানা তদন্ত চালায় পুলিস এবং সন্দেহভাজনদের ডেকে লাগাতার জেরাও চলে।
তার ভিত্তিতে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই, শনিবার অপরাধের ‘কিনারা’ করেছে কলকাতা পুলিস। পুলিসের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গ্রেপ্তার করেছে সঞ্জয় রায় নামে এক যুবককে। তাকে চিহ্নিত করার কাজটি সহজ করে দেয় সিসিটিভি ফুটেজ এবং হেডফোনের সূত্র। ধৃত যুবক কলকাতা পুলিসের সিভিক ভলান্টিয়ার। পুলিস ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আর জি কর-এ তার নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। অর্থাৎ এটাও পরিষ্কার যে, এক্ষেত্রে রক্ষকই ভক্ষক! বহুকাল বাদে ফের এমন কাণ্ডে কলঙ্কিত হল কলকাতা পুলিস। ধর্ষণ ও খুনের মামলা দিয়ে শনিবারই সঞ্জয় রায়কে আদালতে পেশ করা হয়। বিচারক তাকে ১৪ দিনের পুলিসি হেফাজত দিয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে তীব্র ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে। শোকাহত শুধু মৃতার মধ্যবিত্ত পরিবার কিংবা চিকিৎসকরা নন, গোটা সমাজ। কারণ এই মৃত্যু, এই ক্ষতি নিছক একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের নয়, এই অপূরণীয় ক্ষতি সমগ্র সমাজের। বাংলা এবং সারা দেশ একজন প্রতিশ্রুতিবান সেবক ও প্রতিভাকে হারাল। মৃত্যু সবসময়ই বেদনার। কিন্তু এই চিকিৎসকের মৃত্যুর ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি। এমনতিতেই এদেশে ডাক্তারের সঙ্কট বরাবরই তীব্র। ডাক্তার হতে মেধাবী তরুণ-তরুণীরা প্রতিবছর দেশ-দেশান্তরেও ছুটছেন। সেখানে সেবার জন্যই প্রস্তুত একজন ভালো ডাক্তারকে হারালাম আমরা। অতএব, এই ক্ষতি নিঃসন্দেহে অপরিমেয়। এই তরুণী চিকিৎসকের সামনে থেকে যে বা যারা আলো কেড়ে নিল, সে কিংবা তারা শুধু খুনি বা ধর্ষক নয়, তারা সমাজের ও দেশের শত্রু। এই সমাজবিরোধী, দেশদ্রোহী(দের) চরমতম সাজাই প্রাপ্য। সুখের কথা এই যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শাসক দলের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ডও এই ব্যাপারে সহমত। পুলিসও বিশেষ তৎপর। তাই আশা করা যায়, এই ঘটনায় যে বা যারা দোষী তারা কোনোভাবেই পার পাবে না, আইনানুগ দ্রুত উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাই তাদের হবে।