শুধু ওলিম্পিকস কেন, যেকোনও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরে স্বর্ণপদক লাভ সবসময়ই একটি দুর্লভ সুযোগ। একজন প্রতিযোগী ব্যক্তিগত ইভেন্টেও সেই সাফল্য পেলে তা শেষমেশ দেশগৌরব বলেই মনে করা হয়। এই আবেগ ভারতের জন্য আরও বেশি কাজ করে। কারণ ১৪৫ কোটি মানুষের সুবিশাল দেশের গলায় প্রতিবারই যেটা ঝুলে থাকে, তার নাম পদকের খরা! প্যারিস ওলিম্পিকস, ২০২৪-ও তার ব্যতিক্রম নয়। বুধবার পর্যন্ত আমাদের সংগ্রহ মাত্র তিনটি পদক এবং সবক’টিই ব্রোঞ্জ। তার ফলে সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশটির সুবাদে সেদিন আমাদের স্থান ৬৭-তে, যখন নিকটতম প্রতিবেশী চীন হাসছে দ্বিতীয় স্থানে—তাদের সংগ্রহ তালিকায় উজ্জ্বল ২৫টি সোনা, ২৩টি রুপো ও ১৭টি ব্রোঞ্জ মিলিয়ে মোট ৬৫টি পদক। এই প্রসঙ্গে আরও খেদ রয়ে যায় যে, চীন, ফ্রান্স, আমেরিকা, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের অন্তত ১৫ জন প্রতিযোগীর
ব্যক্তিগত পদক সংখ্যারও ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি তামাম ভারত। তাদের কারও কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে তিন-চারটি পর্যন্ত স্বর্ণপদক! এরকমই এক মুহূর্তে আমরা সবাই একটি সোনার জন্য বড় আশায়
বুক বেঁধে ছিলাম। সকলেরই বাজি ছিল সোনার মেয়ে ভিনেশ ফোগাট। তিনি শেষ অবধিও যে ছন্দে ছিলেন, তাতে সোনা নিশ্চিতই ছিল
বলে মনে করেন সকলে।
কিন্তু বাদ সাধল মাত্র ১০০ গ্রাম! আর তার জন্যই থেমে গেল ভিনেশের স্বপ্নের দৌড়। ফাইনালে নামতেই পারলেন না তিনি। উল্টে তাঁকে ‘ডিসকোয়ালিফাই’ করে দেওয়া হল। অর্থাৎ, ব্রোঞ্জ পদক পর্যন্ত চলে গেল ভিনেশের ফোগাটের নাগালের বাইরে। স্বপ্নভঙ্গ হল ভিনেশের, তাঁর আপসহীন লড়াইয়ের, একইসঙ্গে ভারতেরও। স্বপ্নভঙ্গ হল সেই নারীসমাজের, যারা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়ের শিকার, যারা তাঁর লড়াইকে সামনে রেখেই আশায় বুক বেঁধেছিল। স্বপ্নভঙ্গের এমন করুণ কাহিনি কমই দেখেছে স্মরণকাল। কিন্তু এই স্বপ্নভঙ্গের কারণ কী? হঠাৎ কী এমন বিপর্যয় ঘটে গেল? কেন এতটা বেড়ে গেল তাঁর ওজন? আগের দিন রাতভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও কেন তাঁর ওজন নির্দিষ্ট ৫০ কেজিতে আটকে রাখা গেল না? প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি উঠছে। একইসঙ্গে দানা বাঁধছে সন্দেহ এবং অন্তর্ঘাতের বিষয়টি। ওলিম্পিকসে চক্রান্তের প্রসঙ্গটি তাই বহুদিন পর পৌঁছে গিয়েছে সংসদের অন্দরেও। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এর পিছনে কারও রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে নেই তো? ফোগাট পরিবারের দৃঢ়মূল সন্দেহ, এটা চক্রান্তই। ভিনেশের জেঠু ও প্রাক্তন কুস্তিগির মহাবীর ফোগাটের বক্তব্য, ‘দোষ কোচ ও সাপোর্ট স্টাফদের।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘রাতে কী খাওয়ানোর জন্য ওর ওজন এতটা বাড়ল?’
যে ছন্দে তিনি ছিলেন, সোনা প্রায় নিশ্চিতই ছিল ভিনেশের। এখন তিনি বিধ্বস্ত, অবসন্ন, হতাশ। ডিহাইড্রেশনের জন্য গেমসের পলিক্লিনিকে ভর্তি। ফাইনালে ওঠার পর জল পর্যন্ত স্পর্শ করেননি তিনি। সারা রাত চলে জগিং, সাইক্লিং, স্কিপিং, সওনা বাথ...। চুল ছেঁটে ফেলেছেন, এমনকী শরীর থেকে রক্তও বের করার চেষ্টা করেছেন ভিনেশ—৫২.৭ কেজি থেকে যদি ৫০-এর কাঁটায় নামেন, কিন্তু তা হয়নি। তাই কাঠগড়ায় তাঁর সাপোর্ট স্টাফরা। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ভিনেশ দাঁড়িয়ে ছিলেন ৫০ কেজির সীমানায়—৪৯.৯ কেজিতে। তা নিয়েই একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করেন তিনি। তাহলে? সাপোর্ট স্টাফরা কী করছিলেন? কেন সতর্ক ছিলেন না তাঁরা? ভারতীয় দলের প্রধান মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ ডিনসাউ পারদিওয়ালার সাফাই, ‘ওজন হ্রাসের সব চেষ্টাই বিফলে গিয়েছে। বরং দুর্বল হয়ে পড়েছেন ভিনেশ। এনার্জি ফেরাতে জল ও সামান্য খাদ্য দেওয়া হয়। এতেই দেড় কেজি ওজন বেড়ে যায় তাঁর।’ এখানেই প্রশ্ন, ভারতীয় ওলিম্পিক সংস্থা কী করেছে ভিনেশের জন্য? বুধবার সকালে তারা আর্জি জানিয়েছে, আর একটু সময় দেওয়া হোক। কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি। বরং সেমি ফাইনালে পরাজিত গুজমান উঠে আসেন ফাইনালে। আর ভিনেশের ঠিকানা হয় পলিক্লিনিক। তিনি এভাবে হেরে যেতেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ‘সমবেদনা’ জানান এক্স-এ। নরেন্দ্র মোদির এই তাৎপর্যপূর্ণ ‘পাশে থাকা’য় উল্টে ঘটেছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ। কেউ লিখেছেন, যখন ভিনেশকে দিল্লির রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন কোথায় ছিলেন মোদি? আবার জিজ্ঞাসা, ভিনেশ পদক পেলে কি কারও কারও মুখ পুড়ত? তাদের সন্দেহ, সংকীর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কলকাঠি নেড়েছেন তাঁরাই। হায় রে, কাঁকড়ার জাত! এমন ষড়যন্ত্র যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তা শুধু জঘন্য বা নিন্দনীয়ই নয়, ভয়াবহ দেশবিরোধী কাজ। সত্য দ্রুত উদ্ঘাটিত হোক। এমন প্রকৃত দেশদ্রোহীদের বিচার জরুরি।