চিত্রনাট্যটা পুরো এক। বড় কোনও রেল দুর্ঘটনার পরেই সংবাদ মাধ্যমে খবর হয়, রেলকর্তারা এবার ‘নড়েচড়ে’ বসেছেন। গত বছর করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পরও সবক’টি রেলওয়ে জোনে ‘সেফটি ড্রাইভ’ বা সুরক্ষা অভিযান শুরু করার অভিযান নিয়েছিল রেলমন্ত্রক। দেশের প্রায় ৭০ হাজার কিলোমিটার রেল লাইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গেলে বিপুল সংখ্যক কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু এত লোক কোথায়? রেলের সুরক্ষা দেখার জন্য যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেন সেই নন গেজেটেড পদে তো নিয়োগ প্রায় হয়ই না! রাজ্যসভায় গত বছরের শীতকালীন অধিবেশনে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছিলেন, ২০২২-এর ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেলে ৩ লক্ষ ১২ হাজার নন গেজেটেড পদ খালি রয়েছে। এর সিংহভাগ নিচুতলার কর্মী। যার মধ্যে রয়েছেন গ্যাংম্যান, খালাসি পেট্রলম্যান। খালি রয়েছে লোকো ইনস্পেকটর, সিগন্যাল-টেলি কমিউনিকেশন, ট্রাফিক ইনস্পেক্টর, ট্রলিম্যান, গেটকিপার, ব্রিজ ইনস্পেকটরের হাজার হাজার পদ। রেলকর্তাদেরই কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন, লোক কম থাকার কারণে কর্মরতদের কাজের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। একই কারণে অনেকসময় বিশ্রাম পাচ্ছেন না দূরপাল্লার ট্রেনের চালকেরা। কয়েকবছর আগে ক্যাগ রিপোর্ট জানিয়েছে, দেশে ৭০ শতাংশ রেল দুর্ঘটনার কারণ লাইনে ফাটল, মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। একাধিক রেল দুর্ঘটনার কারণের নেপথ্যে অতিরিক্ত পরিশ্রমে জর্জরিত চালকদের ট্রেন চালানোর সময়ে ঘুম পেয়ে যাওয়ার কথাও শোনা যায়। রেল দুর্ঘটনায় শত শত লোকের মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে এই গভীর অসুখের কথা সকলেরই জানা। তার থেকে আশা করা গিয়েছিল, মোদির তৃতীয় সরকার অসহায় যাত্রীদের প্রাণরক্ষায় পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী নিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে। অপদার্থতা ও ব্যর্থতার যাবতীয় অভিযোগের যোগ্য জবাব দেবে। কিন্তু নতুন সরকার শুরুতেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, মোদির স্বপ্নের দ্রুতগামী ট্রেন বন্দে ভারতের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে মানুষের প্রাণের মূল্য বেশি নয়।
সংবাদে প্রকাশ, নন গেজেটেড পদে কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রেল। সংখ্যাটা ৭ হাজার ৯৫১। এর মধ্যে বাংলার ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ৮৫১টি পদ। কেমিক্যাল সুপারভাইজার, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, ডিপো মেটেরিয়াল, সুপারিনটেনডেন্ট সহ গ্রুপ সি-এর একাধিক পদ মিলিয়ে নিয়োগ হবে ওই সংখ্যা। গত কয়েক বছরে যে দেশে তিন ডজনেরও বেশি প্রাণঘাতী রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ খালি পদ থাকাকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেখানে এই সামান্য সংখ্যক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেশবাসীর সঙ্গে চরম রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। সতেরোটি জোনে বিভক্ত ভারতীয় রেলে এই সামান্য সংখ্যক নিয়োগে যে কাজের কাজ কিছুই হবে না তা বলাই বাহুল্য। দেখা যাচ্ছে, কর্মী নিয়োগের মতোই দুর্ঘটনা এড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একইরকম উদাসীন রেল! এই প্রযুক্তির পোশাকি নাম ‘কবচ’। একই লাইনে দুটি ট্রেন চলে এলে ‘কবচ’-এর গুণে থেমে যায় ট্রেন। অর্থাৎ অনায়াসেই সংঘর্ষ এড়ানো যায়। ভারতীয় রেলে এরকম এক অতি প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। কিন্তু গত চার বছরে মাত্র দু’ শতাংশ রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এই প্রযুক্তির আওতায় এসেছে! সাম্প্রতিক কয়েকটি রেল দুর্ঘটনার পর তদন্তে দেখা গিয়েছে, সেখানে ‘কবচ’ সুরক্ষা ছিল না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রায় ৭০ হাজার রেল ট্রাককে এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। মোদি সরকার গুরুগম্ভীরভাবে এর গুরুত্বের কথা বললেও যে গতিতে কাজ করছে তারা তাতে লক্ষ্যপূরণ করতে আরও ৫০ বছর লেগে যাবে। সব মিলিয়ে তাই যাত্রী ও রেলের নিরাপত্তা নিয়ে এই সরকারের ‘নড়েচড়ে’ বসার সাজানো চিত্রনাট্যটা ধরা পড়ে যাচ্ছে।
আসলে দেশের গর্বের ভারতীয় রেলকে মোদি সরকার শুরু থেকেই যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে হেঁটেছে। বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে রেলে অর্থ বরাদ্দের প্রসঙ্গটি। এক্ষেত্রেও সেই বঞ্চনার নজির। যদিও রেলমন্ত্রী দাবি করেছেন, এবার রেলকে রেকর্ড ২ লক্ষ ৬২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মজার বিষয় হল, বরাদ্দ বৃদ্ধির ঢাক পেটানো হলেও কোন প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনতে গড়িমসি করছে সরকার। তাই সঙ্গত প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি রেকর্ড বরাদ্দের বিষয়টি শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ? একথা সকলেই জানে ‘পিঙ্ক বুক-এ’ বরাদ্দকৃত অর্থের প্রতিফলন থাকে, যাতে প্রকাশ পায় রেলের জোনভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দর খতিয়ান। রেলের এই ‘পিঙ্ক বুক’ থেকেই স্পষ্ট হয় কোন প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে মন্ত্রীমশাই গলা ফাটালেও ‘পিঙ্ক বুক’ প্রকাশেই চলেছে টালবাহানা। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কীসের এত লুকোচাপা? কী আড়াল করতে চাইছে সরকার? তথ্য গোপনের এই চেষ্টার পিছনেও কি রয়েছে কোনও কোনও রাজ্যকে বঞ্চনার তথ্য? আশঙ্কা থাকছেই। পিঙ্ক বুক প্রকাশে ঢিলেমি দেখে কেউ অনুমান করতেই পারেন, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!