আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
শোনা যায়, পাঁচের দশকের মাঝামাঝি পথচলা শুরু হয়েছিল এই পুজোর। মোহন বাগানের নাম ততদিনে ভারতজোড়া। বৈশাখের প্রথম দিনে বারপুজোর ভাবনা আসে তৎকালীন সবুজ-মেরুন কর্তাদের মাথায়। শুরু হয় প্রস্তুতি। তাঁদের উদ্যোগের কথা জানতে পারেন ইস্ট বেঙ্গলের শীর্ষকর্তারা। সেই পর্বে লাল-হলুদই হল ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষের মঞ্চ। তাঁরাও প্রিয় ক্লাবের বারপুজোয় অংশ নিতে আরম্ভ করেন। বদ্রু (সমর) বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুকুমার সমাজপতি জানালেন, তখন পয়লা বৈশাখেই শুরু হতো ফুটবল মরশুম। পুজোর উপকরণের পাশেই থাকত নতুন বারপোস্ট। এভাবেই ক্লাবের মঙ্গলকামনায় বিশেষ দিনে এই পুজো ক্রমশ জনপ্রিয় হয়।
প্রথম দশ বছর বারপুজো হতো ভ্রাতৃত্ব ও আবেগের মোড়কে। পুজোর পর দুই প্রধানের মধ্যে মিষ্টি আদান-প্রদান হতো। ১৯৬৩ সালে ইস্ট বেঙ্গল মাঠ থেকে সরে আসেন সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা। অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে সিএফসি মাঠ। তারপর মোহন বাগানের বারপুজো অন্যমাত্রা পেয়েছিল। এর নেপথ্যে ছিলেন ধীরেন দে। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এই অনুষ্ঠানে তিনিই ছিলেন শেষ কথা। ওই সময়ে বারপুজোর জন্য হরিদ্বারের গঙ্গা থেকে জল আনা হতো। নববর্ষের প্রথম দিনে গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে মাঠে আসতেন ধীরেনবাবু। তাঁরই উদ্যোগে তাঁবুর মধ্যে হতো হোমযজ্ঞ। করতেন কালীঘাট কিংবা দক্ষিণেশ্বরের পুরোহিত। পুজো শেষ হলে উপস্থিত সকলে পেতেন রুপোর কয়েন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন মোহন বাগান তাঁবুতে ভিয়েন বসানোর রেওয়াজ তাঁর আমলেই শুরু হয়। ধীরেন দে ও শৈলেন মান্নার উদ্যোগে সাতের দশকের শুরুতে পয়লা বৈশাখে ৪০ মিনিটের প্রীতি ম্যাচ খেলতে দেখা যেত প্রাক্তন ফুটবলারদের। চুনী গোস্বামী তখন প্রাক্তনীদের দলেই। শুধুমাত্র তাঁর স্কিল দেখার জন্য বারপুজোর দিন মোহন বাগান মাঠে সমর্থকদের ঢল নামত।
বারপুজোর প্রসঙ্গ উঠতেই স্মৃতিমেদুর সুব্রত ভট্টাচার্য বলে ফেললেন, ‘১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পয়লা বৈশাখের দিনটি আমার কাছে ছিল অত্যন্ত স্পেশাল। প্রাক্তনীদের ম্যাচের পর আমাদের অনুশীলন শুরু হতো। মাঠ ফাঁকা করার জন্য মাইকে ঘোষণা করতেন কোচ প্রদীপদা। ১৯৭৮-এর বারপুজোয় ঘটেছিল জনপ্লাবন। আগের দিন থেকেই সবুজ-মেরুন আলোয় সাজানো হয়েছিল ক্লাব তাঁবু। কারণ, ১৯৭৭ সালে ত্রিমুকুট জিতেছিলাম আমরা।’ সেই পর্বে ফুটবল সাব কমিটির সদস্য ছিলেন স্বাধীন মল্লিক। তাঁর বক্তব্য, ‘১৯৭৮ সালের পয়লা বৈশাখের দিনে অস্বাভাবিক ভিড় হয়েছিল। টান পড়েছিল লুচি-আলুর দমে। শেষ পর্যন্ত উত্তর কলকাতার এক মিষ্টির দোকান থেকে রাধাবল্লভি ও রসগোল্লা এনে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলাম।’ ক্লাব তাঁবুতে ভিয়েন বা নববর্ষের প্রথম দিনে প্রাক্তনদের ম্যাচের আয়োজন ইস্ট বেঙ্গল কখনও করেনি।
লাল-হলুদের ঘরের ছেলে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বলছিলেন,‘বারপুজো বলতেই মনে পড়ে ১৯৮০ সালের কথা। ইস্ট বেঙ্গলের সাত ফুটবলার চলে গেল মহমেডান স্পোর্টিংয়ে। তবুও স্রেফ মজিদ-জামশিদকে দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল ইস্ট বেঙ্গল মাঠে।’ বারপুজো নিয়ে একটি বিশেষ গল্প আছে মনোরঞ্জনের জীবনে। ছেলের পড়াশোনার জন্য তিনি থাকতেন যাদবপুরে। তাঁর বাড়িতে তখন টেলিফোন ছিল না। ১৯৯১ সালে বারপুজোয় নিমন্ত্রণ করার জন্য তৎকালীন সচিব পল্টু দাস তাঁর বাড়িতে এক কর্তাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মনোরঞ্জনের বাড়িতে পৌঁছে দেখেন, দরজায় তালা ঝুলছে। বাধ্য হয়ে একটি চিরকুটে আমন্ত্রণ বার্তা লিখে রেখে আসেন সেই কর্তা। প্রিয় ক্লাবের থেকে এই আচরণ মেনে নিতে পারেননি ডাকাবুকো মনা। তিনি ভেবেছিলেন, ইস্ট বেঙ্গল তাঁকে উপেক্ষা করছে। তাই নববর্ষের কয়েকদিন পরেই তারকা স্টপার মোহন বাগানে সই করেন। ময়দানের দলবদলের ইতিহাসে যা অত্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বারপুজোর সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। তবে এখন মরশুম শুরু হয় জুলাইয়ে। গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, এপ্রিলে রমরমিয়ে চলছে আইএসএল কিংবা আই লিগের খেলা। অনেক সময়ে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে নতুন বছরের প্রথম দিনে বড় দল শহরের বাইরে থাকে। গত বছর করোনার প্রকোপে থমকে গিয়েছিল বারপুজো। এবার মোহন বাগানের উৎসবে সদস্য-সমর্থকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কোভিড বিধি মেনেই হবে ইস্ট বেঙ্গলের বারপুজো। তাই অতীতের উন্মাদনা বর্তমানে কার্যত উধাও।