আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
জাতির ভিত্তি ভাষা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাই আমরা বাঙালি। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের একাধিক পরিচয় আছে— জাতি, নাগরিকত্ব, ধর্ম, দলীয় পরিচয়, পেশা ইত্যাদি। জীবনকালে যা বদলায় না, সেটাই আসল পরিচয়। কেউ আজ ভারতীয়, কালকে নাগরিকত্ব বদলে কানাডিয়ান হয়ে যেতে পারেন। যেমন হয়েছেন হিন্দি সিনেমার অভিনেতা অক্ষয়কুমার। কেউ ধর্ম বদলে মুসলিম থেকে খ্রিস্টান, হিন্দু থেকে বৌদ্ধ, বৌদ্ধ থেকে মুসলিম হয়ে যেতে পারেন— ভারত তথা বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনে এই অধিকার স্বীকৃত। কেউ দল বদলে আজ বিজেপি, কাল তৃণমূল, পরশু কংগ্রেস, তরশু সিপিএম করতেই পারেন এবং করেনও। যা বদল করা যায়, তা জামা। কিন্তু মাতৃভাষার ভিত্তিতে যে আত্মপরিচয় অর্থাৎ জাতিগত সত্তা, সেটা গায়ের চামড়া। বদলানো যায় না। বাঙালি থেকে মাড়োয়াড়ি বা চীনা বা পাঞ্জাবি বা হিন্দুস্তানি বা তামিল হওয়ার কোনও উপায় নেই, আইনও নেই। বাবা-মায়ের দেওয়া এই ভাষা এই পৃথিবীতে ভয় না পেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার, অধিকার বুঝে নেওয়ার, বাংলা নিজেদের কর্তৃত্বে রাখার, পূর্বপুরুষের সঙ্গে আগামী প্রজন্মের সম্পর্ক রক্ষার চাবিকাঠি। যে মুহূর্তে আমাদের বাঙালি-মা জন্মের পরপরই আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকে চিতা বা কবরে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত ঠিক হয়ে গিয়েছে— আমাদের ভাষা, জাতি, জাতীয়তা, জাতিসত্তা। আমরা বাঙালি।
গত সাত দশক ধরে এবং বিশেষ করে গত ২০ বছরে হিন্দি-উর্দু চাপিয়ে দেওয়া, উত্তর প্রদেশ-বিহার থেকে লাগামহীন জনস্রোতের ফলে বাংলার জনবিন্যাসে বাঙালির তলিয়ে যাওয়া এবং পুঁজি-বাজার-চাকরি-জমি-ব্যবসা বহিরাগতদের দখলে চলে যাওয়ার ফলে এই পশ্চিমবঙ্গে শুধু বাংলা ভাষা না, বাঙালি জাতি একটি ঐতিহাসিক সঙ্কটের মুখোমুখি। অথচ এই পশ্চিমবঙ্গই এ দেশের নিপীড়িত বাঙালির শেষ ঠিকানা। এটা হারালে বাঙালি সব হারাবে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিডিয়ার কারসাজিতে জাতি ও নাগরিকত্ব গুলিয়ে ফেলা, দেশ ও রাষ্ট্র গুলিয়ে ফেলা বাঙালিদের জন্য স্বনামধন্য ভাষাবিদ সুকুমার সেনের ‘বঙ্গভূমিকা’র প্রথম লাইন— ‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ।’ যে বাঙালির জন্ম কৃষ্ণনগরে, তিনি যদি গান, ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’, তিনি দেশ বলতে এই বাংলাকেই বোঝাচ্ছেন, নিশ্চয়ই বিহারের ছাপড়া বা রাজস্থানের জয়পুরকে নয়।
আমরা যেন দেশ ও রাষ্ট্রের তফাত গুলিয়ে না ফেলি। কারণ অন্য কোনও জাতি এটা গুলোয় না। ভারত ভাষার ভিত্তিতে গঠিত নয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা ভাষার ভিত্তিতেই গঠিত। আর এই ভারত আমাদের রাষ্ট্র। বাংলা ও বাঙালির রক্তে স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত। এই তফাত বোঝা জরুরি। কারণ ভারত মানে হিন্দি, হিন্দি মানে ভারত, বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণির, ভারতপ্রেমী মানে হিন্দিপ্রেমী, হিন্দুকে ধর্ম না বলে জাতি বলা, হিন্দুর ভাষা হিন্দি, রাষ্ট্রবাদী মানে হিন্দির পক্ষে, বাংলা মানে বিচ্ছিন্নতাবাদ— হিন্দি মানে রাষ্ট্রবাদ, সেনা মানে হিন্দি, কেন্দ্র মানে হিন্দি, হিন্দি না জানলে ভারতীয় না— এই সকল ভয়ঙ্কর ধারণা গত কয়েক বছরে সুপরিকল্পিতভাবে অনেক বাঙালির মাঝে, বিশেষ করে বাঙালি যুবসমাজের মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে। এই মগজ-ধোলাই প্রকল্পের পিছনে ভিন রাজ্যের পুঁজিপতি, বিনোদন জগৎ ও সামাজিক মাধ্যমের ঐক্য রয়েছে। ফলে বাঙালি যুবসমাজকে হীন্মমন্যতায় ভরিয়ে দিয়ে তার মধ্যে বাংলা নিয়ে লজ্জা এবং নিজের মাটিতে নিজের আশ্রিত হিসেবে থাকার বিষয়টা স্বাভাবিক করে দেওয়া হচ্ছে। যে কোনও সাম্রাজ্যবাদ কোনও জাতির আবাদভূমি দখল করতে চাইলে প্রথম সেই জাতির যুবসমাজকে আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ফেলতে চায়, যাতে দখলের সময়ে প্রতিরোধ না আসে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদও ঠিক সেই পথেই এগিয়েছে বাংলায়। সেই সঙ্গে এক শ্রেণির অশুভশক্তি চায় বাঙালি আসল শত্রুর প্রতিরোধ না করে ঘটি-বাঙাল, হিন্দু-মুসলমান করে নিজের ছায়ার সঙ্গে নিষ্ফলা যুদ্ধে ব্যস্ত থাকুক।
এবার আসি সমাধানের কথায়। জিডিপি হোক, জিএসটি ও ইনকাম ট্যাক্স কালেকশন হোক— সব অর্থনৈতিক সূচকই দেখাচ্ছে যে, বাংলায় অর্থনীতি সচল, কাজ আছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ বাঙালি ছেলেমেয়ে বেকার। অথচ আশপাশের রাজ্য থেকে প্রতি বছর যে সমস্ত বহিরাগতরা আসছেন, তাঁরা তো হাওড়া ব্রিজ আর জাদুঘর দেখতে আসছেন না! এসে প্রোমোটারি থেকে ঠিকাদারি, মুটেগিরি থেকে দোকানদারি সব করছেন এবং জনবিন্যাসও পাল্টে দিচ্ছেন। বাংলার শহরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে তাঁরা ক্রমে কাউন্সিলার-এমএলএ-এমপি হয়ে যাচ্ছেন। সত্যটা হল বাংলায় কাজ আছে, বাঙালির কাজ নেই। বহিরাগত পুঁজি আনছে বহিরাগত ঠিকাদার, আবার বহিরাগত ঠিকাদার আনছে বহিরাগত কর্মী— এসব পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে। বাংলা ও বাঙালি তাদের কাছে বিস্তীর্ণ বাজার। কিন্তু বাঙালি তো বসে বসে দেখবে না। ঠিকা-কাজ থেকে স্থায়ী চাকরি, পশ্চিমবঙ্গে সব বেসরকারি কাজে চাই ৯০ শতাংশ ভূমিপুত্র সংরক্ষণ। যা ইতিমধ্যেই হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক, গোয়া, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি রাজ্যে হয়েছে। এর ফলে বাংলার কাজ বাঙালি পাবে। হাতে টাকা আসবে। বাঙালির পুঁজি বাড়বে। কেন্দ্রীয় সরকারি সব পরীক্ষা ইংরেজি ছাড়াও হিন্দিতে হয়, অথচ বাংলায় হয় না। সুভাষচন্দ্র, বাঘাযতীনের মাতৃভাষায় ভারতীয় সেনা ও আধাসেনার ভর্তি হয় না। এর পরিবর্তনের দাবি জানাতে হবে। বাঙালি বাংলামুখী হলেই বাঁচবে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা।