আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
হালখাতা, মানে নতুন খাতা। লেখা-পড়ার খাতা নয়। পাওনা-গণ্ডার খাতা। সে-খাতার চেহারা আলাদা। পাট, পাট তিনি পাট। খসখসে লাল খেরোর বাঁধাই। ফিতে লাগানো। জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকে। তাকে তুলে রাখা যায়। বহু পরিবারকে পথে বসাবার খতিয়ান। অতি পবিত্র এই খাতাটির উদ্বোধন পর্ব। বৈশাখের প্রথম দিবসে মা সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির, সিন্দুরচর্চিত, স্বস্তিকা চিহ্নাঙ্কিত, মন্ত্রলিখিত ওঁ গাঙ গণপতয়ে নমঃ। তিনি বাণিজ্যের দেবতা, সিদ্ধিদাতা। খাতা থাক খাতার জায়গায়, আমাদের শৈশবে অর্থাৎ পূর্ব শতকে এই দিনটির বড় মধুর আকর্ষণ ছিল। বড় হয়ে গেলে চলবে না। ছোট থাকতে হবে, হিসাবনিকেশের বাইরে। উজ্জ্বল বৈশাখের তখন অন্য আকর্ষণ। চৈত্রের শেষদিনে গাজনের সন্ন্যাসীদের হাঁকডাক শেষ হয়েছে। চরকের মেলা গুটিয়ে গিয়েছে। পয়লা বৈশাখ। তালঠুকে শুরু হল নতুন বাংলা বছর। কোন দেবতাকে স্মরণ করব? সূর্যদেব, জগতের আঁখি, তিনি বিষ্ণু নারায়ণ, নারায়মং নমস্কৃত্য নরষ্ণৈব নরোত্তমম। গণপতি থাকুন ভানুবাবু, দানুবাবুর দোকানে। মাসকাবারি মালের হিসেবে থেবড়ে বসে ডাইনে বাঁয়ে শুড় দোলান। বৈশাখের ওই পুণ্য প্রভাতে ‘আকাশ আমার ভরল গানে।’ উষ্ণ নিঃশ্বাসের মতো বাতাস কোনও আপনজনের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। কোনও একজন, কোথাও একজন। কে সে? নব জীবন। টাটকা একটা নতুন বছরের পাতা খোলা হল। আকাশের হালখাতা। আশুবাবুর পালিশচটা ক্যাশ বাক্সোর ওপর যে খসখসে খাতাটা, ওটা নয়। ওটার ভেতরে অনেক কারচুপি। এক পাশে আদায়, এক পাশে বিদায়।
এই আধুনিককালে সেকালের সবই যেন গল্প। মাকালীর মন্দিরে লম্বা লাইন। খাতা পুজো। ‘অন লাইনে’ বেচা-কেনা সম্ভব হলেও, খাতাপুজো সম্ভব কী! আজকাল হিসেবও তো যন্ত্রে থাকে, তবু খাতা একটা রাখতে হয়, প্রাচীন প্রথা। ট্র্যাডিশন। সংস্কারে ঢুকে গিয়েছে।
বেঁটে-খাটো, তেল চুকচুকে মানুষ আশুবাবু। তাঁর ছিল মুদিখানা। সবাই বলত গোলদারি। শব্দটার অর্থ জানা নেই। মনে হয় বড়-সড় একটা কিছু। দোকানটার ছিরি-ছাঁদ তেমন কিছু ছিল না। মাল-পত্তরে ঠাসা চাল, ডাল, আটা, ময়দা, নুনের বস্তা, চিনি, সর্ষের তেলের পিপে, বাইরে কেরোসিন তেল, কয়েকহাজার আরশোলা, নানা মাপের ইঁদুর। নগদখদ্দেরের পাশাপাশি খাতার খদ্দেরও অনেক। হাড় কিপটে। সেই আশুবাবু সাত সকালে খাটো ধুতি আর ফতুয়া পরে কালীবাড়িতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। খাতা পুজো হবে। রাসভারী পুরোহিত পূর্ণবাবু। সকলেই তাঁকে ভয় আর ভক্তি করেন। জ্যোতিষ জানেন, তুকতাক নানারকমের। আশু দুনিয়ার কাউকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে না, একমাত্র এই পূর্ণঠাকুরের কাছে জব্দ। শনি এ-বছর কি খেলা দেখাবেন একমাত্র পূর্ণ ঠাকুরই জানেন। গ্রহরাজের অকৃপায় চাল-চুলো উড়ে যায়—একথা কারও জানতে বাকি নেই। জিভ বের করা মা-টিকে খোশ মেজাজে রাখাটাই আসল কথা। ঠান্ডা ঠাকুর নারায়ণকে নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। পাঁচ পো সিন্নি চড়ালেই বাকি বছরটা গড়িয়ে গড়িয়ে কেটে যাবে।
সুরেশ মন্দিরের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেল কিনছে ‘র্যালে’। পরিবারে এক নতুন সদস্য। ঠাকুরমশাই হাতলে একটা জবার মালা জড়াতে বলেছেন। যন্ত্রটিকে মায়ের পায়ে উৎসর্গ করা হবে। কাঠগোলার বঙ্কু একটা নতুন কুড়ুল এনেছে। রোদ্দুরে শুয়ে শুয়ে ঝিলিক মারছে।
আমপাতার মালা, মাঝে মাঝে দোদুল্যমান শোলার ফুল। প্রবেশদ্বারের মাথায় মাথায়। গেরস্তের কল্যাণ হোক। যৌথ পরিবারের পরিমণ্ডল সদা উত্তপ্ত। ছোট নাকি শ্বশুরের টাকার গরমে আদালতে গিয়ে তাল ঠুকবে। আজ আর ওসব কথা কেন? দুটো ভগবানের কথা কও না। নাও ফটিক নাম ধরো, নাম ধরো।
বেলা শেষ। দোকানের সামনের রাস্তায় জল ছড়িয়েছে। ভাপ উঠছে। বস্তায় মোড়া বরফের চাঙড়ে কাঠের মুগুর হাঁকাচ্ছে। চুড়চুড় শব্দ। একটা, দুটো টুকরো এদিকে, ওদিকে ছিটকে গিয়েছে। একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। সারা বছর ধরে জমে থাকা পথের ধুলো একটু জল পেল।
ময়রার দোকানে খাস্তা কচুরি ভাজা হচ্ছে। গন্ধে মম করছে চারপাশ। মুগের নাড়ুতে একটা বোলতা আটকে গেছে। সোনার দোকানে বেশ ভিড়। বউদের গয়না গড়িয়ে দিয়ে বাবুরা খাতে পড়ল। এখনও সাতশো। এবার একটু হাত চালান। হাতে ঠান্ডা এক গেলাস ঘোলের শরবত। এখনও পাওনা সাতশো। খেরোর খাতায় কোনও মায়া-মমতা নেই। নামেই হালখাতা, হাল কার হাতে কে জানে!
এই যে মিষ্টির প্যাকেটটা ভুলে যাবেন না। বাবুকে বাক্সটা ‘তাহলে, এসো’, এবার হরিনারায়ণ বলে শুয়ে পড়া যাক। দিবা শেষে তিনিও শয়নে গেছেন। মাকালীর মন্দিরের দরজা বন্ধ। মা শুয়ে পড়লেও দাঁড়িয়ে আছেন, যত নিদ্রা সব শিবের। মালাচ্যুত একটি শোলার ফুল বাতাসে গড়াতে গড়াতে দিশাহীন দিশার দিকে চলেছে। খাতা বন্ধ। খাতক আর যত ঘাতক এখন বিশ্রাম।