ব্যবসা সূত্রে উপার্জন বৃদ্ধি। বিদ্যায় মানসিক চঞ্চলতা বাধার কারণ হতে পারে। গুরুজনদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন ... বিশদ
‘... মণিমালিকা সমস্ত রাত ধরিয়া একটি একটি করিয়া তাহার সমস্ত গহনা সর্বাঙ্গ ভরিয়া পরিয়াছে। মাথা হইতে পা পর্যন্ত আর স্থান ছিল না। বাক্সে করিয়া গহনা লইলে সে বাক্স হাতছাড়া হইয়া যাইতে পারে, এ আশঙ্কা তাহার ছিল। কিন্তু গায়ে পরিয়া গেলে তাহাকে না বধ করিয়া সে গহনা কেহ লইতে পারিবে না।... গহনার ঝমঝম শব্দ শোনা গেল। ঠিক মনে হইল শব্দটা নদীর ঘাটের উপর হইতে উঠিয়া আসিতেছে। ...তখন ফণীভূষণ চোখ মেলিল এবং দেখিল, ঘরে নিবেদিত দশমীর চন্দ্রালোক আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মুখে একটি কঙ্কাল দাঁড়াইয়া। সেই কঙ্কালের আট আঙুলে আটটি আংটি, করতলে রতনচক্র, প্রকোষ্ঠে বালা, বাহুতে বাজুবন্ধ, গলায় কন্ঠি, মাথায় সিঁথি, তার আপাদমস্তকে অস্থিতে অস্থিতে এক-একটি আভরণ সোনায় হীরায় ঝকঝক করিতেছে। অলংকারগুলি ঢিলা, ঢলঢল করিতেছে, কিন্তু অঙ্গ হইতে খসিয়া পরিতেছে না।’ (মণিহারা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সান্ধ আড্ডায় ভূতুড়ে গপ্পো তখন মোড় ঘুরিয়ে নারীর গহনাপ্রেমের দিকে বাঁক নিয়েছে। আর প্রসঙ্গ ঘুরতে ঘুরতে এসে ঠেকেছে সিনেমায়। সিনেমা, ভূত, নারী আর গয়না যখন একসঙ্গে উচ্চারিত হল তখন পূর্ণিমার চাঁদের মতো যে নামটা আড্ডা আলো করে উঠল তা এতক্ষণে পাঠক ধরে ফেলেছেন। মণিহারা। রবীন্দ্রনাথের এই ছোট গল্পের অনবদ্য চিত্রায়ন করেছিলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘তিন কন্যা’ ছবিতে। মণিহারার সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া দৃশ্যটা আর নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। অলংকারে সাজানো মণিমালিকার কঙ্কাল হাতটি মনে পড়ছে। কঙ্কালের গায়ে হীরের ঝলক! ফণীভূষনের হাত সরিয়ে গয়নার বাক্সগুলোর দিকে ছোবল মারল যে সজোরে। দৃশ্যটা দেখে শিউড়ে ওঠেনি এমন দর্শক বিরল।
এর পরেও বাংলা ছবিতে ভূতের গয়না প্রীতি লক্ষ করা গিয়েছে, তবে এমন ভয়ালভাবে নয়। বরং হাস্যকৌতুকের ভঙ্গিতে। এই যেমন ‘গয়নার বাক্স’ ছবিতে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের নিজের গয়নার বাক্সটির প্রতি কাঙালপনা মৃত্যুর পরেও যে থেকে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবু সেই অতিরিক্ত ভালোবাসাকে ভয়ালো রূপ দেননি পরিচালক। বিধবা বেশে পিসিমা ওরফে মৌসুমীর গয়নাগাটি পরে সাজের বহর হাসিরই উদ্রেক করে। সাদা থান, চোখে চালশে চশমা আর সঙ্গে গা ভরা গয়না। গয়নাও আবার যে সে রকম নয়। একেবারে বিয়ের গয়না। কপাল জোড়া সিঁথিকাটা টায়রা, কানে ঝুমকো দুল, গলায় মটর মালা, মফ চেন, সীতা হার, হাতে কাঁকন, রুলি বালা... কী নেই সেই গয়নার তালিকায়। বাল্য বিধবাদের বুঝি সেকালে এমনই সাজগোজের প্রতি লালসা থাকত? হবেও বা।
মেয়েদের কাছে গয়না যে সত্যিই প্রিয় তা বহুবার বহু ছবিতে দেখা গিয়েছে। কখনও গয়নার প্রতি অপূর্ণ সাধ থেকে মেয়েরা মরেও শান্তি পায়নি। কখনও বা বিয়ের সাজে গা ভরা গয়না পরে অপরূপা হয়ে উঠেছেন বাংলা ও হিন্দি ছবির নায়িকারা। এই যেমন ঋতুপর্ণ ঘোষের দুটি ছবির কথাই ধরুন না, ‘চোখের বালি’ আর ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। দু’ক্ষেত্রেই বিয়ের সাজে গয়নার ব্যবহার অপরিহার্য বলে মনে করেছেন ঋতুপর্ণ। তাই তো কখনও রাইমা সেনকে, কখনও ঐশ্বর্য রাইকে আর কখনও বা বিপাশা বসুকে দেখা গিয়েছে অপরূপ সাজে। ছবিগুলোয় গয়নার যেমন ব্যবহার পাওয়া যায় তারই সামান্য বিবরণ দেওয়া যাক। ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনীর বৈধ্যব্যপূর্ব বিয়ের সাজে তাকে দেখা গিয়েছে পরিপূর্ণ সাজগোজের সঙ্গে। মাথায় সরু চেন দেওয়া ফুল কাটা টায়রা, কানে কানবালার সঙ্গে লাগোয়া ঝুমকো, গলায় চওরা কারুকাজ করা নেকলেস। আবার একই ছবিতে আশালতার গয়না পরে বিনোদিনী যখন মহেন্দ্র প্রেমে মগ্ন, তখন তার পরনে যে গয়নাগুলো উঠেছে তার মধ্যে রয়েছে চওরা সিঁথিকাটা টিকলি ও টায়রা, কানে দু’থাক বিশিষ্ট ঝুমকো আর গলায় চওরা পাটি হার, নেকলেস, মটর মালা, লম্বা চেন, মুক্ত বসানো সোনার খামিতে বাঁধানো সীতাহার ইত্যাদি। পাশাপাশি নেহাতই ঘরোয়া রূপেও আশালতার পরনে টুকিটাকি যে গয়নাগুলো উঠেছে তার মধ্যে নাকের নোলক, কানের ছোট ঝুমকো আর গলার লম্বা চেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘চোখের বালি’ ছবির গয়না প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অঞ্জলি জুয়েলার্সের কর্ণধার জানান, ছবিতে বিয়ের বেশে ঐশ্বর্যকে সাজানো হয়েছিল অঞ্জলি জুয়েলার্সের ভারী সোনার গয়না দিয়ে। গয়নাগুলো ঐশ্বর্যকে এতটাই মানিয়েছিল যে, অভিষেক বচ্চনের সঙ্গে যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন শ্বশুরবাড়ির গয়নাগুলো জয়া বচ্চন সম্পূর্ণই অঞ্জলি জুয়েলার্সকে অর্ডার দিয়ে গড়িয়েছিলেন। তার মধ্যে দুটো গয়না পরবর্তীকলেও অঞ্জলি জুয়েলার্সের ট্রেডমার্ক হয়ে যায়, হাতের গোলাপ কাঁকন আর গোলাপফুল মালা।
টলিউডের গণ্ডী পেরিয়ে একটু বলিউডের দিকে পা বাড়ানো যাক। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওপর যে আমাদের দেশের ফ্যাশন ট্রেন্ড অনেকটাই নির্ভরশীল তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এক্ষেত্রে গয়নাও ব্যতিক্রম নয়। একটা সময় এল যখন আধুনিক নকশার সঙ্গে মধ্যযুগের নকশা মিলিয়ে বলিউডি গয়না তৈরি শুরু হল। ব্যস, সেটাই হল গয়নার নকশায় নতুন ডিজাইন ট্রেন্ড।
ঘটনাটা প্রথম বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল ‘বীর জারা’ ছবিতে। তার আগেও অবশ্য ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’ ছবিতে কাজলকে বেশ কিছু ভারী গয়নায় সুসজ্জিত দেখা গিয়েছিল। কানে লম্বাটে চেনে ঝোলানো ঝুমকো দুল, মাথায় চওড়া সিঁথির সঙ্গে গোলচে টিকলি আর গলায় সোনার ফ্রেমে পাথর বসানো কুন্দন স্টাইলের চওড়া চোকার থেকে ঝুলমি দেওয়া ভরাট হার পরে কাজলের ‘মেহেন্দি লাগাকে রাখ না’ নাচের দৃশ্যটা ভোলার নয়। তবে সেইসব গয়নায় মধ্যযুগের ডিজাইন বা স্টাইল ততটা প্রকটভাবে ধরা পড়েনি। এরপর ‘বীর জারা’ ছবিতে প্রীতি জিন্টাকে সাজানো হয়েছিল পাথর বসানো সোনার সাজে। গলায় চওড়া নেকলেস পুরোটাই মণিমুক্ত খচিত। কপালে টিকলিতেও নানা রঙের পাথরের প্রাচুর্য। অনেকটাই সম্রাজ্ঞীর গয়নার মতো এই ছবির গয়নার নকশা। এর আগেও অবশ্য ‘কভি খুশি কভি গম’ ছবিতে জয়া বচ্চনের পরনে ভারী জরোয়ার গয়নার সেট বা ‘লে জা লে জা’ গানের দৃশ্যে কাজল ও করিনার পরনে পাথর বসানো গয়না দর্শককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই নকশায় জাঁকজমক থাকলেও রাজকীয় ভাব ততটা ছিল না।
বলিউডের গয়নায় রাজকীয় ডিজাইন আরও বেশিভাবে চোখে পড়েছিল ‘যোধা আববর’, ‘প্রেম রতন ধন পায়ো’ জাতীয় ছবিতে। ‘যোধা আকবর’ ছবিতে ঐশ্বর্য রাইয়ের পরনে রাজস্থানি নকশার কুন্দনের গয়নার ডিজাইন এতই হিট করেছিল যে সেই সময় তানিষ্ক ‘যোধা আকবর’ স্টাইলের গয়নার একটা গোটা রেঞ্জ বানিয়ে ফেলেছিল। ছবিতে নাকি তানিষ্কের বানানো ২০০ কেজি ওজনের গয়না পরানো হয়েছিল যোধারূপী ঐশ্বর্য রাইকে। সেই গয়নার তালিকায় কখনও কুন্দন নকশায় রঙিন পাথর বসানো নেকলেস কখনও বা আবক্ষ আবৃত পাত ডিজাইনের সোনার ভরা হার, নাকে বড় রিং লাগানো নথ আর কপালে সরু চেনের সঙ্গে লাগানো গোল মাঙ্গ টিকা পরে দেখা গেছে ঐশ্বর্য রাইকে।
রাজকীয় গয়নাই যে বলিউডের একমাত্র স্টাইল তা ভাববেন না। বরং বিভিন্ন সময় গল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী নানা প্রদেশের গয়না ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দি ছবিতে। এই যেমন ‘দেবদাস’ ছবিতে সঞ্জয়লীলা বনসালি পার্বতীকে বাঙালি গয়নায় সাজিয়েছেন। সেখানে চোকার, সীতাহার, ঝুমকো ইত্যাদির প্রাধান্য লক্ষ করার মতো। আবার ‘বাজি রাও মস্তানি’ ছবিতে তিনি মারাঠি গয়নার দিকে ঝুঁকেছেন। সেখানে ‘পিঙ্গা লা পোরি’ গানের দৃশ্যে দীপিকা এবং প্রিয়াঙ্কা চোপড়া দু’জনেই মারাঠি স্টাইলের গয়না পরেছেন। মারাঠিদের মতো নাকে ঝোলানো রিং নাকছাবি, কানে পাটি ঝুমকো, গলায় চওরা লম্বা চেন পরানো হয়েছে দুই নায়িকাকে। আর ‘টু স্টেটস’ ছবিতে আলিয়া ভাট সেজেছেন সম্পূর্ণ দক্ষিণ ভারতীয় গয়নায়। সেই সব গয়নায় কোনও পাথরের প্রাধান্য নেই। শুধুই ভারী সোনার কারুকাজ। কয়েন নেকলেস, জাদু ঝুমকো, মাঙ্গ টিকার মতো দক্ষিণী নকশার গয়না উঠেছে আলিয়ার গায়ে।
সিনেমায় গয়না নাকি বিয়ের গয়নার ডিজাইনকে বহুসময় বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে জানালেন তানিষ্ক, অঞ্জলি জুয়েলার্স সহ নানান স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ‘যোধা আকবর’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরে বিয়ের গয়নায় জরোয়ার নকশার চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সোনার চেয়ে তখন বিয়ের গয়নায় হীরের কদরও বেড়ে যায়। আর বাঙালিরাও টিকলির বদলে অবাঙালি কায়দায় মাঙ্গ টিকা বানানো শুরু করেন। এছাড়া একটা সময় ছিল যখন বিয়ের গয়নায় লম্বা হারের চেয়ে নেকলেসের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ট্রেন্ড আবারও বদলে যায় ‘চোখের বালি’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর। তখন থেকেই আবারও পুরনো ডিজাইনের একটু মোটা লম্বা হারের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। কানের দুলের ক্ষেত্রে যেমন কান বালা ও ঝুমকোর চাহিদা সবসময়ই কান পাশার তুলনায় বেশি। সেও কিন্তু হিন্দি ছবির কারণেই। বলিউডের বহু ছবিতে নায়িকাদের কানে ঝোলা ঝুমকো দুল দেখেই নাকি এই ট্রেন্ড বাঙালি অবাঙালি সর্বস্তরেই সমানে চলেছে। তার মধ্যে আবার একটু চেন দেওয়া ঝুমকোর চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল ‘টু স্টেটস’ ছবিতে অলিয়ার বিয়ের সাজ দেখে। এইভাবে বিভিন্ন সময় টলিউড থেকে বলিউডে ভরাট গয়নার নকশা সাধারণ স্তরেও পৌঁছে গিয়েছে। আর সেই সাজে সুসজ্জিত হয়ে বাঙালি কন্যেরা মনে মনে কখনও হয়ে উঠেছে মাধুরী, কখনও ঐশ্বর্য, কখনও বা কাজল, করিনা, আলিয়া।