পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
ধনতেরস, ধনবর্ষা বা ধনবৃদ্ধি যে নামেই ডাকুন না কেন সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে সোনার আধিপত্য। আর সোনার কথা যখন উঠলই তখন স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ে গেল শৈশবে শিশুপাঠ্যে পড়া কাঠুরিয়া আর তার সোনার কুড়ুলের সেই গল্প।
দরিদ্র কাঠুরিয়া আর তার স্ত্রী দিন আনে দিন খায়। রোজ ভোরে কাঠুরিয়া বেরয় কাঠ কাটতে। কাঠ সংগ্রহে। দিনের শেষে সংগৃহীত কাঠ বিক্রির অর্থে সংসারের প্রয়োজনীয় চাল-ডাল, নুন-তেল কিনে ঘরে ফেরে। এভাবেই চলছিল তার জীবনযাপন। একদিন বনের মধ্যে জলাশয়ের ধারে কাঠ কাটতে গিয়ে হঠাৎই কুড়ুলটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে জলের মধ্যে। কাঠুরিয়ার মাথায় হাত, রোজগারের প্রধান হাতিয়ার তখন তার হাতছাড়া। কুড়ুল হারিয়ে দিশাহারা কাঠুরিয়া নিরুপায় হয়ে জলাশয়ের ধারে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপরের দৃশ্য আরও চমকপ্রদ। গরিব কাঠুরিয়ার কান্না শুনে জলের মধ্য থেকে আবির্ভূত হন জলদেবী। তারপর কান্নার কারণ জানতে পেরে জলে ডুব দেন দেবী। কিছুক্ষণ বাদে আবার আবির্ভূত হলেন, হাতে তাঁর সোনার কুড়ুল। —‘এটা কি তোমার।’ জলদেবী প্রশ্ন করেন কাঠুরিয়াকে। কাঠুরিয়ার উত্তর, ‘না এই কুড়ুল আমার নয়, এটা তো সোনার।’ জলদেবী পুনরায় ডুব দিলেন এবং আবার ফিরে এলেন। এবার তার হাতে একটি রুপোর কুড়ুল। এবারও জলদেবী একই প্রশ্ন করেন কাঠুরিয়াকে। কিন্তু আগের মতোই নেতিবাচক উত্তর দেয় হতাশ কাঠুরিয়া। ‘আমার কুড়ুলটা তো ছিল লোহার।’ বলে ওঠে কাঠুরিয়া। জলদেবী আবার ডুব দিলেন জলের অতলে। কিছুক্ষণ বাদে উঠে এলেন তলিয়ে যাওয়া আসল লোহার কুড়ুলটি নিয়ে। নিজের হারিয়ে যাওয়া কুড়ুলটি দেখতে পেয়ে কাঠুরিয়া প্রায় কেড়ে নিলেন দেবীর হাত থেকে। জলদেবী মুগ্ধ হতদরিদ্র কাঠুরিয়ার সততা দেখে। এতটাই খুশি তিনি, যে কাঠুরিয়াকে আসল কুড়ুলটা তো ফেরত দিলেনই, সঙ্গে উপহার দিলেন সোনা এবং রুপোর কুড়ুল দুটিও।
তারপর ‘সুখী হও, সমৃদ্ধ হও।’ —বলেই দেবী ভ্যানিস। শিশুপাঠ্যে পড়া সততা শিক্ষার এই নীতি-গল্পের নটে গাছ মুড়িয়েছিল এখানেই।
কিন্তু ধনতেরসের উন্মাদনা তখন ছিল না। আজ সেই উৎসবের আঙ্গিকে যদি গল্পের আকার-প্রকার বাড়ানো হয়, তাহলে সেই গল্পের চেহারাটা ঠিক কেমন হয় এবার সেটাই দেখুন বাকি অংশে।
কাঠুরিয়ার আনন্দ আর ধরে না। ঘাড়ে কাঠের বোঝা। হাতে তিনটে কুড়ুল। বনের রাস্তা দিয়ে সে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। যেতে যেতে সে বাড়িতে একাকী অপেক্ষায় থাকা বউয়ের কথা ভাবতে থাকে। রাত হয়ে গিয়েছে, খাবারও কিছু কেনা হয়নি। অভাবের সংসারে সবকিছুই বাড়ন্ত। কিছু সময়ের মধ্যেই কাঠুরিয়া বাড়িতে পৌঁছে দেখে তার অল্প বয়সি বউ আলুথালু বেশে এলোকেশী হয়ে দাওয়ায় বসে রয়েছে। দু’চোখ তার অশ্রুসজল। ভাবলেশহীনভাবে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কাঠুরিয়া যে এসে গিয়েছে সেদিকে তার বউয়ের খেয়ালই নেই। কাঠের বোঝা নামানোর শব্দে অবশেষে তার সংবিত ফেরে। সে ভাবে ধনতেরসের গয়না আনতেই বোধহয় স্বামীর দেরি হয়েছে।
তখন তার অনেক প্রশ্ন। ‘কী এনেছ, কোথা থেকে আনলে?’... ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনর্গল প্রশ্নের মুখে পড়ে প্রথমে খেই হারালেও, খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলেন কাঠুরিয়া। তার মনে পড়ে গেল বেরবার সময় বউ তাকে বারবার বলে দিয়েছিল আজ ধনতেরস। কাঠ বিক্রির টাকা দিয়ে চাল-ডাল না আনলেও চলবে। বরং তার বদলে সে যেন একটা সোনার নেকলেস নিয়ে আসে। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বউয়ের উপোসি থাকার এমন পরামর্শে তখন বেশ অবাকই হয়েছিল কাঠুরিয়া। এখন সে কথা বউ মনে করিয়ে দেওয়ায়, কালবিলম্ব না করে বেশ বীরদর্পে এগিয়ে এসে কাঠুরিয়া সোনা এবং রুপোর কুড়ুল দুটিকে বউয়ের কোলের উপর রেখে দিল। আর দেখে কে! আনন্দে আটখানা হয়ে এই সোনা-রুপো ভেঙে সাতনরি হার থেকে শুরু করে দুল, টিকলি, নেকলেস, চুড়ি, মল ইত্যাদি নানা রকমের গয়না তৈরির পরিকল্পনাতে মেতে উঠল বউটি। কচি বউয়ের এমন বালখিল্যপনা দেখে কাঠুরিয়া তাকে জলদেবীর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। এবং বোঝাল দেবীর দানের জিনিস খরচ করতে নেই। দেবতার আসনে বসিয়ে ওইসব মূল্যবান সামগ্রীর পুজো করতে হয়। কিন্তু নাছোড় স্ত্রী সেইসব কথায় কর্ণপাত করল না। তার সাফ কথা গয়না গড়াবার পরে বাকি সোনা-রুপো বেচে তাদের বাকি জীবন ভালো মতোই কেটে যাবে। কাঠুরিয়াকেও আর কষ্ট করতে হবে না। অভাবে পড়লে আবার লোহার কুড়ুল জলে ফেলে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলে জলদেবীর কাছ থেকে মিলবে আরেকটা সোনার কুড়ুল, রুপোর কুড়ুল। সংসার ভরে উঠবে আরও টাকা আরও গয়নায়।
বউয়ের এমন অসৎ মানসিকতা ব্যথিত করল কাঠুরিয়াকে। ক্ষিপ্ত হয়ে হাতের কাছে পড়ে থাকা কাঠের টুকরো দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করল বউকে। মনের দুঃখে, অপমানে কুয়োতে ঝাঁপ দিল বউ। জলের মধ্যে আওয়াজ তুলে, নিমেষে সে অদৃশ্য হল পাতাল গর্ভে।
রাগ কিছুটা প্রশমিত হলে, কাঠুরিয়া রান্নাঘরে উঁকি মারল। সেখানে থালায় ভাত, বাটিতে ডাল, মাছ পরিপাটি করে ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশে রয়েছে জলের গ্লাস। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল কাঠুরিয়ার। দ্রুতই সেই খাবার সাবাড় হয়ে গেল। কিন্তু ক্লান্তিতে দু’চোখ জুড়ে এলেও কাঠুরিয়া কিছুতেই ঘুমোতে পারল না। সে সাত-পাঁচ ভাবতে লাগল। শূন্য ঘরে এত খাবার তার স্ত্রী কীভাবে জোগাড় করল সে কথা ভেবে বিস্মিত হল কাঠুরিয়া।
এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে কখন যেন কাঠুরিয়া এসে দাঁড়াল কুয়োর পাশে। তার চোখের জল তখন আর বাধ মানছে না। হঠাৎই কাঠুরিয়ার নজর কাড়ল জলের আলোড়ন। বউয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে ভেবে কৌতূহলী হতেই সে দেখল চারদিকে আলোর ছটা। চোখের ধাঁধা কাটতেই সামনে হাজির স্বয়ং জলদেবী।
‘কী হয়েছে বৎস? আবার কুড়ুল হারাল নাকি?’
‘নানা কুড়ুল নয়, এবার আমার বউ ডুবে গিয়েছে। আমার হাতে নির্যাতিত হয়ে সে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে।’ সব কথা শুনে জলে ডুব দিলেন জলদেবী। কিছু সময় পরে দু’হাতে চ্যাংদোলা অবস্থায় এক সিক্ত বসনা নারীকে নিয়ে তিনি ভেসে উঠলেন। যাকে নিয়ে জলদেবী উঠলেন তিনি স্বয়ং সানিয়া মির্জা। অচৈতন্য ওই নারীকে দেখিয়ে দেবী কাঠুরিয়ার কাছে জানতে চাইলেন এই তার বউ কিনা। কাঠুরিয়া নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বলে দিলেন। মিথ্যার আশ্রয় নিতে দেখে দেবী কাঠুরিয়ার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তোমার এত পরিবর্তন। তোমার সততাতে খুশি হয়ে তোমাকে আমি সোনা ও রুপোর দুটি কুড়ুল দান করলাম আর এখন সুন্দরী সেলিব্রিটিকে দেখে লোভ সামলাতে পারলে না। আমি তোমাকে অভিশাপ দেব। নিরুপায় কাঠুরিয়া তখন জলদেবীর পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন।
শুধু ক্ষমা চাওয়াই নয়, দেবীর কাছে তার আকুতি ছিল, তাকে সুযোগ দেওয়া হোক মিথ্যা বলার পিছনের আসল কারণ বর্ণনার। জলদেবী রাজি হলেন। কাঠুরিয়া বলতে থাকেন যে আমি যদি মিথ্যে না বলতাম তাহলে এরপর তুমি সাইনা নেহওয়াল কিংবা পি.ভি. সিন্ধুকে তুলে এনে একই প্রশ্ন করতে। এবং যথারীতি আমার সত্যভাষণে খুশি হয়ে একইসঙ্গে আমার আসল বউ এবং আরও দুই মহিলাকে আমার কাঁধে চাপিয়ে দিতে। গরিব কাঠুরিয়া আমি, আমার সাধ্য কি যে নিজের বউ-এর পাশাপাশি আরও দুই সেলেব মহিলার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেব! কাঠুরিয়ার উত্তরে দেবী প্রীত হলেন এবং জলের নীচে ডুব দিয়ে তার আসল বউকে তুলে আনলেন। বউয়ের সারা শরীর তখন সোনার গয়নায় সুসজ্জিত। দেবী কাঠুরিয়াকে বললেন, নে তোর বউয়ের শরীরে হাত ছুঁইয়ে দে তাহলেই ধনতেরসে এ গয়না তোর দেওয়া হবে। তোর বউ বড্ড ভালো, জলের নীচেও তোর কথাই ভাবছিল। দেবী অদৃশ্য হলেন। কাঠুরিয়ার কাছে সবকিছু যেন ম্যাজিকের মতো মনে হচ্ছিল। লজ্জা মাখা মুখে কাঠুরিয়ার বউ স্বামীর কাছে এসে দাঁড়াল।
ভুল স্বীকার করে বলল, ‘মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তাই আত্মহত্যা করতে গেছিলুম।’ আর ঠিক সেইসময়, কাঠুরিয়া দম্পতির মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একটা লক্ষ্মী প্যাঁচা। কাল্পনিক এই গল্পের কুশীলবদের মতো বাস্তবেও ধনতেরসে এমন লক্ষ্মী লাভ হয় কি না জানি না। তবে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর, এই প্রবাদ বাক্যের কথা মনে রেখে বলা যেতেই পারে সম্পদ সমৃদ্ধির আশা ভরসাতে আস্থা বা বিশ্বাস দিন দিন বাঙালির বাড়ছে বলেই, অন্যান্য উৎসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধনতেরসের জনপ্রিয়তাও।
আর বিশ্বাস প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৩১-এ রাসবিহারী অ্যাভেনিউ-এর শ্যামসুন্দর জুয়েলার্স-এর কর্ণধার রূপক সাহা বলছিলেন, ‘অন্যান্য প্রদেশের মানুষের মতো বাঙালিরাও এখন বিশ্বাস করছেন ধনতেরসের সময় সোনা বা হীরের গয়না কিনলে সম্পদের দেবী ধনলক্ষ্মী খুশি হন। তাই সম্পদ বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা বাঙালিকে সোনার দোকান মুখী করে তোলে ধনতেরসের দিন।’ ধনতেরস আগে অবাঙালিদের উৎসব থাকলেও, এখন এটা আর কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ধনতেরস এখন জাতীয় উৎসব। তাই সার্বজনীন এই উৎসবে অংশ নিতে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। একথাও সেদিন বলেন রূপকবাবু।
ধনতেরসের পুজো পাঠ
ধনতেরসের এই বিশ্বাসের পিছনে কিন্তু অবদান রয়েছে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনীর। সে সব কাহিনীর আলোচনাতে আসব, তার আগে আসি পুজ্য দেবদেবীর প্রসঙ্গে। প্রায় সারা ভারতেই এখন কালীপুজোর দু’দিন আগে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পালন করা হয় ধনতেরস। প্রদীপ দিয়ে বাড়ি সাজানো হয়। পূজো করা হয় লক্ষ্মী, গণেশ এবং কুবেরদেবের। এই পুজো হয় ছবিতে। দেওয়ালির দিনে পুজো করা হয় মূর্তিতে। ঘরে সঞ্চিত টাকা-পয়সা পুরনো গয়না এবং নতুন কেনা গয়নাগুলি একটি থালাতে রাখা হয়, যার মধ্যে থাকে একটি রূপার সিক্কা টাকা—যে মুদ্রায় লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি খোদাই করা থাকে। কুবেরদেবের প্রতীক হিসাবে এই টাকার পুজো করা হয়। পুজোর ফুল এবং ওই সিক্কা টাকাটি সিন্দুকে বা আলমারিতে রেখে দিতে হয়। বিশ্বাস যে সম্পদ বৃদ্ধির চাবিকাঠি এই টাকাটি কখনও খরচের জন্য বা বিক্রির জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। দুর্গাপুজোর মতোই, ত্রয়োদশী তিথি থেকে শুরু হয় ধনদেবীর আরাধনার চারদিনের এই ধনতেরস উৎসব। সোনার দোকানের সৌজন্যে যে উৎসব এখন অফার আর উপহারের ফোয়ারায় সাতদিনে পর্যবসিত। গয়নার পাশাপাশি তামা বা কাঁসার বাসন কেনার রীতিও প্রচলিত আছে ধনতেরসের সময়।
ধনতেরসের পৌরাণিক কাহিনী
কথিত আছে হিমা নামে একজন প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তার পুত্রের জন্মছকে উল্লেখ ছিল যে, ওই পুত্র বিবাহের চতুর্থদিনে সাপের কামড়ে মারা যাবে। তা জেনেও রাজা হিমা মহাসমারোহে তাঁর পুত্রের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পূর্বাভাসকে এড়াতে রাজপুত্রের নববধূ তাঁর স্বামীকে বিনিদ্র রজনী যাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত সোনা, হীরে, চুনি, পান্নার গয়না, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা শয়নকক্ষের দরজার সামনে স্তূপাকৃতি করে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, সারাবাড়ি প্রদীপের আলোয় আলোকময় করে রাখলেন। এবং স্বামী যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন গল্প আর গান বাজনায় মাতিয়ে দিলেন সারারাত। যমরাজ এলেন কিন্তু প্রাণ ছিনিয়ে নিতে পারলেন না। স্তূপাকৃতি স্বর্ণালঙ্কার তাঁর বুকে হাঁটার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। তাছাড়া প্রদীপের আলোয় অলঙ্কার থেকে ছিটকে আসা বিকিরণে চোখ ঝলসে গেল ছদ্মবেশী যমরাজের। অন্যদিকে, আবার রাজবধূর সুকণ্ঠ তাকে মোহিত করে রাখল। ভাবলেন আঁধার বাড়লে রাজপুত্রের প্রাণ নিয়ে পাড়ি দেবেন যমপুরীতে কিন্তু পারলেন না। ভোর হল, পেরিয়ে গেল চতুর্থ রাত। ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়ে গেল। পরাজিত যমরাজ ফিরে গেলেন শূন্যহাতে। রাজা হিমার পুত্রবধূর এই কাহিনীর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় আরেক পৌরাণিক দম্পতি বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনীর। প্রদীপ জ্বালিয়ে স্বামীর জীবন রক্ষা করে ছিলেন বলে ধনতেরসের দিনটি ‘যমদীপদান’ বলেও পরিচিত।
জন্মসূত্রে গুজরাটি যতীন চৌহান। বর্তমানে থাকেন বরোদাতে। দীর্ঘদিন থেকে গিয়েছেন কলকাতার কাছে উত্তর পাড়াতে। চাকুরিজীবী এই মানুষটি ধনতেরস পালন করেন। বলেছিলেন, শাস্ত্রমতে রুপো কেনাটাই দস্তুর। তিনিও কেনেন। তাঁর কাছেই শোনা গেল অন্য আরেকটি পৌরাণিক গাথা। সেই কাহিনী অনুযায়ী সমুদ্রমন্থনে ধনতেরসের দিনই লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে প্রকট হয়েছিলেন স্বয়ং কুবের। সেই থেকেই ধনতেরসের দিনটিকে কুবেরের জন্মদিন হিসাবে পালন করা হয়। দু’জনেই ধনসম্পদ এর দেবতা। তাই সমৃদ্ধির আশায় দু’জনেরই পুজো করা হয়। কুবের ধন গচ্ছিত রাখেন। অন্যদিকে, লক্ষ্মীর আদেশ ছাড়া এই ধনসামগ্রী কাউকে দেওয়া যায় না। তাই তুষ্ট করতে হয় দু’জনকেই। আরও আছে, যতীনই বলছিলেন কুবের দেব সমুদ্রমন্থনের সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন অমৃত কলস। ওই অমৃত সেবন করেই দেবতারা অমরত্ব লাভ করেছিলেন। আর কুবেরের দেওয়া অমৃত খেয়ে দেবতারা মৃত্যুকে জয় করতে পেরেছিলেন বলে কুবেরের আরেক নাম ধন্বন্তরি।
রাজস্থান এবং গুজরাটের কৃষকরা প্রথম এই উৎসবটি পালন করতে শুরু করেন। ধনতেরসের প্রকৃত অর্থ ‘লক্ষ্মীশ্রী’। অতিথি আসার আগে বাড়িতে যেমন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয় কিংবা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয় ঠিক তেমনি দেওয়ালির দিন লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনের আগে বাড়ি সাফসুতরো করা হয়। ধনতেরসের দিন থকেই শুরু হয় নানা আয়োজন। বলছিলেন, আরেক গুজরাটি কন্যা উন্নতি দাভারে। উন্নতি পেশায় বলিউডের অভিনেত্রী। সম্প্রতি মণিকর্ণিকা ছবিতে কঙ্গনা রানাওয়াতের সঙ্গে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন উন্নতি। অভিনয় করেছেন বাংলা ছবি তিন কন্যাতেও। যে ছবিতে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। ব্যবসায়ী পরিবারের কন্যা উন্নতি যেদিন থেকে রোজগার শুরু করেছেন সেদিন থেকেই ধনতেরসে কেনাকাটা শুরু করেছিলেন। যেমন কয়েক বছর আগে ধনতেরসের দিন কিনেছিলেন একটি বড় সোনার বালা।
তবে প্রতিবছর সোনা না কিনলেও ওই দিন প্রতিবারই কেনেন রুপোর প্লেট-চামচ। কারণ জানতে চাইলে অভিনেত্রী বললেন রুপো শরীর ঠান্ডা রাখে। স্বাস্থ্যকর। রুপোর প্লেটে খেলে শরীর ভালো থাকবে। তাছাড়া সমুদ্রমন্থনে কুবের যে কলসভর্তি অমৃত নিয়ে এসেছিলেন সেই কলসও একটা পাত্র। তাই খাওয়ার জন্য পাত্র কেনার এত ঝোঁক উন্নতির। ছত্তিশগড়ের ভূমিকন্যা, বর্তমানে মুম্বইয়ের আন্ধেরীর বাসিন্দা উন্নতি দাভারের বাড়িতে দেওয়ালির দিন লক্ষ্মী গণেশের পুজো তো হয়ই, তার সঙ্গে হয় সরস্বতী পুজোও। ব্যবসায়িক এই পরিবারে আমাদের বাংলা নববর্ষের হালখাতার মতো হয় নতুন খাতা পুজো। চলে মিঠাই বিতরণ। পরা হয় নতুন জামাকাপড়। অন্য প্রদেশের উৎসবকে বাঙালির আপন করে নেওয়ার সহজাত উৎসাহকে প্রচুর তারিফ করেছেন দুই গুজরাটি, যতীন এবং উন্নতি।
বাঙালির ধনতেরস পালন নিয়ে বক্রেক্তি
আরেক অভিনেত্রীর গলায় অবশ্য কিছুটা ভিন্ন সুর। তিনি একাবলী চোপড়া। একাবলী জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি। পাক পাঞ্জাব ছিল একাবলীর পূর্বপুরুষের দেশ। দেশভাগের কারণে চোপড়া পরিবারের সদস্যরা দিল্লিতে চলে আসেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে একাবলীর দাদু আসেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে, আজ থেকে বহুবছর আগে। আর তখন থেকেই একাবলীর বাবা প্রেমে পড়ে যান এই শহরের। তিনি একজন চিত্রকর। একাবলীর মা গোয়ানিজ। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার এতটাই গ্রাস করেছে যে একাবলী এবং ওর পরিবারকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওদের পরিবার ভিনদেশি।
একাবলী বলছিলেন, ‘বাংলার অনেকের মতো আমরাও দেশভাগের বলি। পাঞ্জাবি উদ্বাস্তু। তবে এখানেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠায় আমি পুরোদস্তুর বাঙালি।’ বাঙালির ধনতেরস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, বাঙালি তো এখন সব বিষয়েই অন্য প্রদেশের সংস্কৃতিতে বেশি মজে। তাই বিয়েতে বাঙালি কনেরা এখন ঘাঘরা পরে। মেহেন্দি হয়। অথচ আমি বাই বার্থ বাঙালি না হলেও শাড়ি পরতেই বেশি পছন্দ করি। ধনতেরসের চেয়ে আমাদের পরিবারে দসেরা নিয়ে হইচই বেশি। তবে নিয়মিত না হলেও ধনতেরসে আমি কয়েকবার রুপোর কয়েন কিনেছি। আমার ঠাকুমা রাজকুমারী চোপড়া, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে সরোজিনী নাইডুর সঙ্গী ছিলেন, তিনি অবশ্য ধনতেরস পালন করতেন। পুজো-পাঠ করতেন। অবশ্য তা সত্ত্বেও একথা বলতেই পারি আমাদের পরিবারে আচার-বিচার সর্বস্ব অনুষ্ঠানের চেয়ে বরাবরই আধ্যাত্মিকতার চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। রিচুয়ালসের চেয়ে স্পিরিচুয়ালিজম অগ্রাধিকার পেয়েছে। উল্লেখ্য, একাবলী একসময় কলকাতায় চুটিয়ে অ্যাঙ্কারিং, মডেলিং করলেও এখন তাঁর কর্মক্ষেত্র মুম্বই। বলিউডি ছবি ‘আংরেজি মে কয়তা হ্যায়’ ছবির জন্য কানাডার অটোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে বেস্ট অ্যাকট্রেস হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন।
বোঝাই যাচ্ছে বাঙালির ধনতেরস নিয়ে এই মাতামাতিকে যতীন বা উন্নতির মতো দরাজ সার্টিফিকেট দিতে রাজি নয় একাবলী। বরং কিছুটা বক্রোক্তিই করেছেন তিনি। বক্রোক্তি করেছেন সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়িও। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ধনতেরসের এই উচ্ছ্বাস বাঙালির হুজুগ কিনা। তিনি বলেছেন হুজুগ কি না জানি না, তবে শাস্ত্রে ধনতেরসের কোনও উল্লেখ নেই।
পঞ্জিকায় ধনতেরস
বেশ কয়েকবছর আগে ধনতেরস প্রসঙ্গে অন্য একটি সাক্ষ্যাৎকারে নৃসিংহপ্রসাদবাবু মন্তব্য করেছিলেন যে অন্যান্য পঞ্জিকাতে টুলোপণ্ডিতরা ধনতেরসে দিনক্ষণের উল্লেখ করলেও, পিএম বাগচির পঞ্জিকাতে ধনতেরসের কোনও উল্লেখ নেই। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে তাই শরণাপন্ন হয়েছিলাম। পিএম বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড-এর পক্ষে পীযূষ বাগচি মহাশয়ের। পুরনো পঞ্জিকা ঘেঁটে তিনি বললেন, নৃসিংহবাবু ঠিকই বলেছিলেন। ধনতেরস নিয়ে মাতামাতি শুরুর প্রথমদিকে এর কোনও উল্লেখ আমাদের পঞ্জিকাতে ছিল না। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে দেশের সমস্ত ভাইটাল উৎসবের সঙ্গে ধনতেরসও জায়গা পেয়েছে পিএম বাগচির পঞ্জিকাতে। প্রসঙ্গত তিনি জানিয়েছেন ৭ কার্তিক, (২৫ অক্টোবর) বিকেল ৪টে ২৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডের পর শুরু হবে ত্রয়োদশী তিথি। সারারাত ধরেই চলবে ধনতেরসের পুজো।
অন্যদিকে, শাস্ত্রে বা পুরাণে ধনত্রয়োদশীর উল্লেখ নেই এ কথা মানতে চাননি পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক আকাদেমির সচিব নবকুমার ভট্টাচার্য। শুধু ত্রয়োদশী তিথির উল্লেখই নয়, শাস্ত্রে ওই তিথিতে তৈজসপত্র দানের কথাও আছে, যেখানে আবার লৌহজাত ধাতব পাত্রের দানসামগ্রীকে নীচতা বলে গণ্য করার কথা আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আরও কিছু পৌরাণিক কাহিনী
সমুদ্রমন্থন, রাজা হিমার পুত্রবধূর পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও মহাকাব্যে, পুরাণে আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। যেমন মনে করা হয় শ্রীবিষ্ণু বামন অবতারের রূপ ধারণ করে কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে রাজা বালির প্রকোপ থেকে লক্ষ্মী দেবীকে উদ্ধার করেন এবং সেই কারণেই দীপাবলিতে মা লক্ষ্মীর আরাধনা শুরু হয়। রামায়ণ অনুসারে এই বিশেষ দিনেই নাকি বনবাস শেষ করে সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে রাম অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন।
সেলেব সহ বাংলার কয়েক জনের ধনতেরস পালন
পৌরাণিক কাহিনীর প্রভাবে, নাকি সোনার প্রতি অদম্য টানে ধনতেরসে সোনার দোকানে ঢল নামে বাঙালি ঘরের মেয়ে-বউদের, সে কথা জানতে যোগাযোগ করেছিলাম বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল, ছোটপর্দার দুই চেনা মুখ সোনালি চৌধুরি, কাঞ্চনা মৈত্র, বড় পর্দার অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরির মতো সেলেব্রিটিরা। তেমনি আছেন বে-সরকারি সংস্থার দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারী অর্ণব ঘোষ, প্রতিভা শা, গৃহবধূ মৌসুমী পাল এবং তিন ব্যবসায়ী শুভ্রা পাল, অসীম সাহা, নন্দিতা পাঠক এবং মেডিটেশন বিশেষজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক যোগা প্রশিক্ষক পালোমা গাঙ্গুলি। এঁদের প্রত্যেকের ঘরেই লক্ষ্মীদেবীর স্থায়ী আস্থানা। ধনতেরসে এঁরা প্রত্যেকেই নিজের সাধ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করেন। তবে এঁদের মধ্যে সোনা-রুপো কেনার পাশাপাশি ধনদেবীর পুজো করেন সোনালি, কাঞ্চনা, প্রতিভারা। অগ্নিমিত্রার আবার দামি গয়নার চেয়ে দামি শাড়ির প্রতি আকর্ষণ বেশি। ধনতেরসে অবশ্য বহুবার মা এবং শাশুড়ির কাছ থেকে ডায়মন্ডের আংটি, সোনার গিনি, হাতের ব্রেসলেট ইত্যাদি উপহার পেয়েছেন। নিজে অবশ্য এই উৎসব উপলক্ষে কেনাকাটা করলে গয়নার পরিবর্তে বাড়ির সত্যনারায়ণ পুজোর জন্য কেনেন কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র।
শুভ্রা পালের বাইন্ডিংয়ের ব্যবসা। সংস্থার নাম প্রাটো বাইন্ডা। কলকাতার নামী প্রকাশনা সংস্থাগুলির বই-ম্যাগাজিন বাঁধাই হয় তাঁর সংস্থায়। অন্যদিকে, মৌসুমীদেবীর কর্তা দেবাশিস পাল বিদেশি সংস্থার ইন্ডিয়া হেড। শুভ্রা এবং মৌসুমী দু’জনেরই ধনতেরস উৎসবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল গত শতাব্দীর শেষ দশকের শেষভাগে। কলকাতা তখন ধনতেরস কী তা জানত না। বলছিলেন দু’জনেই। শুভ্রার বোন উত্তর ভারতে থাকেন। সেই সুবাদে অনেক আগেই এই উৎসবের সঙ্গে তাঁর সখ্য। তাছাড়া কয়েকজন অ-বাঙালি বন্ধুও প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। মৌসুমী আবার বিয়ের পরে কর্তার সঙ্গে তাঁর তখনকার কর্মস্থল বরোদাতে গিয়ে প্রথম দেখেন ধনতেরস উৎসব। পরে হায়দরাবাদেও একই ঘটনার সাক্ষী তিনি।
অ-বাঙালি বন্ধুদের প্রভাবে কলকাতাতে ধনতেরস শুরুর প্রথম দিকেই কেনাকাটা শুরু অসীম সাহার। সোনা-রুপোর কয়েন কেনা দিয়েই হাতেখড়ি। এখন অবশ্য কেনেন সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস। সেই তালিকায় আছে টিভি থেকে মিউজিক সিস্টেম সহ নানাবিধ ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম। ধনতেরস সম্পদ বৃদ্ধি করে এ কথা অসীম জানেন ভালোমতোই।
ইলেকট্রনিক্স জিনিস ক্রয় করা সম্পর্কে তাঁর অভিমত, গয়নাই কি শুধু সম্পদের পরিমাণ বাড়ায়? টিভি, গিজার-এর মতো সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলেও তা বাড়ে সম্পদ। দক্ষিণ কলকাতার ত্রিকোণ পার্কের মেয়ে পালোমা গাঙ্গুলি। বছরের মধ্যে এগারো মাসই থাকেন মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে। যোগ-মেডিটেশনের এই বিশেষজ্ঞা বলিউডের তারকা, কর্পোরেট জগতের হুজুহুদের শরীর ও মনকে শান্ত রাখার পরামর্শ দেন। খোঁজ দেন সু-স্বাস্থ্যের। ভারতীয় যোগের সুলুক সন্ধান দিতে ছুটে যান দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই পালোমার হাতে জ্বল জ্বল
করছে হীরের আংটি। অতীতে ধনতেরসের দিনেই আংটিটি কিনেছিলেন পালোমা। সোনা-রুপোর ধনতেরসের ক্রয়-বিক্রয়ের কনসেপ্ট কি তাহলে ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। সোনার পরে বড়লোকেরা এখন তালাস করছে হীরের। অসীমের মতো কেউ আবার কিনছেন দামি ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট।
মুম্বইয়ের ধনতেরস পালনের ছবিটা ঠিক কেমন জানতে চেয়েছিলাম পালোমার কাছে। বললেন, এখানকার ধনতেরস উৎসবের তুলনা চলে একমাত্র কলকাতার দুর্গাপুজোর সঙ্গে। পুজো-পার্বণ তো আছেই, আছে কেনাকাটা। টোট্যাল ফান। আলোর রোশনাই। রেস্তোরাঁ, হোটেলে উপচে পড়া ভিড়, আর পার্টি করার দেদার মজা নিয়েই চলে এই শহরের ধনতেরস।
ধনতেরসের অফার, উপহার, নতুন কালেকশন
ধনতেরস উপলক্ষে বিক্রি-বাটা বাড়াতে লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে খবরের কাগজের পাতাতে কিংবা মোবাইলের মেসেজে চোখ রাখলেই দেখা যায় সোনার দোকানের অজস্র বিজ্ঞাপন। অফার আর উপহারের ছড়াছড়ি। সোনার পাশাপাশি হীরেকে পালোমার ‘অ্যাফর্ডেবল’ করতে মেকিংয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে পুরোটাই। জানিয়েছেন রূপক সাহা।
অন্যদিকে, আবার ধনতেরস উপলক্ষে সেনকো গোল্ড নিয়ে আসছে গয়নার নতুন কালেকশন। বৈচিত্রে ভরা সেই সম্ভারে আছে সিলভার, গোল্ড, ডায়মন্ড এবং প্লাটিনাম। মনমাতানো ডিজাইনের নানা রকমের গয়না। পুরুষদের জন্য যেমন সেখানে থাকছে ‘অহম’ কালেকশন। তেমনি আছে মহিলাদের ডেইলি ওয়্যারের উপযোগী এভারলাইট কালেকশন।
পরিবেশ বাঁচানো এবং জল সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা বাড়াতে ফুল, পাতা, মাছ ইত্যাদির ডিজাইন থেকে ইন্সপিরেশন নিয়ে তৈরি নেচার কালেকশন, অ্যাকোয়া কালেকশনের হালকা গয়নাগুলি এবার ক্রেতাদের মন মজাতে ভালোরকম সফল হবে, এমনটাই আশা করছেন সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শুভঙ্কর সেন। ভারী ভারী গয়না নয়, মূলত হালকা গয়নাই বাজারে এনেছে সেনকো গোল্ড।
এছাড়াও ইয়ুথ জেনারেশনের জন্য আছে ডেনিম কালেকশন। জিন্স, টি-শার্টের সঙ্গে পরা যাবে লাইটওয়েটের এই গয়নাগুলি। তবে শুভঙ্করবাবু একটা মজার তথ্য দিলেন। জানালেন, তাঁরা এবার স্পেশালি মহিলাদের জন্য আনছেন কস্টিউম জুয়েলারির ‘গসিপ কালেকশন’। কেন, জিজ্ঞাসা করলে হাসতে হাসতে সেনকো গোল্ডের এই কর্ণধার বলেন, ‘পুরুষের চেয়ে মহিলারা এই বিষয়ে অনেকটাই এগিয়ে— তাই।’ সঙ্গে ট্রাডিশনাল বিবাহ কালেকশন তো আছেই। যার মধ্যে ভারী নেকলেস সহ থাকবে আরও অনেক গয়না।
মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদের গয়না পরার ট্রেন্ড কীরকম সেকথাও সেদিন জানতে চেয়েছিলাম শুভঙ্করবাবুর কাছে। তাঁর উত্তরে বুঝলাম, পুরুষেরও গয়না পরার ঝোঁক বাড়ছে। স্টাইলিশ লুকের গয়নাতেই তারা বেশি স্বচ্ছন্দ। অলঙ্কার শুধু নারীর ভূষণ নয়, পুরুষেরও গয়নার প্রতি আকর্ষণ তীব্র। সোনার চশমা, বুকপকেটে সোনার ঘড়ি, সোনার কলম বাবু কালচারের বাবুদের জীবনে ছিল অপরিহার্য। যে কথার সমর্থন মিলল কলকাতার আরেক নামী স্বর্ণ প্রতিষ্ঠান এম পি জুয়েলার্স পরিবারের সদস্য অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরির বয়ানে। টোটার মতে, গয়না শুধু পরার জন্যই নয়, এটা একটা ইম্পর্টেন্ট ইনভেস্টমেন্ট। বিপদের বন্ধু। এই অন্য পরিপ্রেক্ষিতের জন্যই সোনা সঞ্চয় জরুরি। টোটা তাই প্রতিবছর ধনতেরসে স্ত্রীর জন্য গয়না কেনেন। একবার নিজের জন্যও কিনেছিলেন একটা ব্রেসলেট। যেটার লুকটা ছিল বেশ স্টাইলিশ এবং পুরুষালি। অর্থনীতির অবস্থা যখন টালমাটাল, সোনার দাম যখন ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, তখন ক্রেতাদের টেনে আনার রেসিপিটা কী? —দশ বছর আগেও এরকম অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তখন মানুষের হাতে পয়সা-কড়ি ছিল। এখনও আমাদের অর্থনীতির গ্রোথ বেশ স্লো। মানুষের হাতে অর্থের টানাটানি। সেই কথা ভেবেই বিভিন্ন স্তরের আর্থিক ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতাদের জন্য আমরা দেড় হাজার থেকে পনেরো হাজারের রেঞ্জের ভেতরে নিয়ে এসেছি আংটি, পেনডেন্ট, কানের দুলের মতো বেশ কিছু হালকা গয়না। বিজনেস স্ট্র্যাটেজির এই কথাও খোলসা করেছেন শুভঙ্কর সেন।
আর সোনার ব্যাপারীদের এই পলিসির কথা অনুধাবন করেই সেদিন এই প্রতিবেদককে শাস্ত্রে ধনতেরসের অনুল্লেখের কথা বলেই থেমে থাকেননি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। ধনতেরস এবং তাকে নিয়ে উন্মাদনার গোটাটাই যে একটা ব্যবসায়িক প্রচারের কৌশল বলেছেন সেকথাও।
সোনার গয়নার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ধনী-দরিদ্র সকলের। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের কমোডে সোনা, শ্যারণ স্টোন, সোফিয়া লোরেনদের অন্তর্বাসে সোনার পরশ থেকে শুরু করে হাল আমলের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের সোনার দুর্গা প্রতিমা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সাহিত্যে, সিনেমাতেও সোনা নিয়ে চর্চা প্রচুর। আর এই সোনার ভাণ্ডারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নিজের জীবনে সমৃদ্ধি আনতে ধনতেরসের সময় সারা দেশের মানুষ লক্ষ্মী, কুবেরদের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ছে। কিন্তু সেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ঢুকে পড়ছে কোন অছিলায়? বিশেষ করে কিছুদিন আগেই যখন পালিত হয়েছে গণেশ চতুর্থী। ছিদ্রান্বেষীরা বলেন, গণেশ হল চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট। খরচের পাই-পয়সার হিসেব রাখতেই লক্ষ্মী আর কুবেরের মাঝে তাঁর উপস্থিতি।
কোজাগরীর পূর্ণিমা তিথিতে বাংলার ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মী পূজিতা হন, তাহলে আবার অমাবস্যায় তাঁকে স্মরণ কেন? সাহিত্যিক শংকর এ প্রসঙ্গে এক মজার গল্প শুনিয়েছেন।
বাংলার গৃহলক্ষ্মীদের মনে অনেক দুঃখ আছে। সুযোগ পেলেই ভক্তিভরে তারা স্বামীর সমৃদ্ধি কামনায় মা লক্ষ্মীর পুজো করেছে কিন্তু ফল কিছু হয়নি। চঞ্চলা লক্ষ্মী কোথাও বেশি দিন থাকেন না। বিত্তদেবীর এই এক দোষ। সুযোগ এলেই বাহন প্যাঁচাকে নিয়ে পাড়ি জমান অন্যখানে। মাড়োয়ারি, গুজরাটিদের প্রতিই সদয় তিনি। বাঙালি ব্যবসা বিমুখ, বাঙালি সঞ্চয়ী নয় বলে বদনাম কেনে। পড়ে থাকে সেই তিমিরেই। আবার প্রবীণদের মতে, মা লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা অন্ধকারেই ভালো দেখেন। তাই বোধহয় পূর্ণিমার পরে অমাবস্যাতেও লক্ষ্মীদেবীর আরাধনার সুযোগ ছাড়তে নারাজ ভক্তরা। দূরদর্শীরা বলেন, বড়বাজারের ব্যবসায়ীরা এক ঢিলে চার পাখি মারেন। তাঁরা যুক্তফ্রন্টে বিশ্বাসী। ব্যবসা কেন্দ্রে তাঁরা শুধু সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং সম্পদ লক্ষ্মীর পুজো করেন না। যে নতুন খাতার পুজো হয় তার পিছনে রয়েছেন দেবী সরস্বতী। আর যেহেতু কালি দিয়ে লেখা হয়, সেহেতু মা কালীর পুজো তো হয়েই যায়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বিত্ত লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখা যায় না। গতকাল যে কোটিপতি আজ সে দেউলিয়া। অনেকে বলেন, লক্ষ্মীদেবী চঞ্চলা বলেই সব রাজ্যের ব্যবসায়ীরাও চঞ্চল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলেই তাঁরা অন্যত্র নিঃশব্দে ডেরা বাঁধেন। বিবাদ-বিতর্কে জড়ান না। মা লক্ষ্মীও অনন্তকাল ধরে এই ভেগে যাওয়ার পলিসি অনুসরণ করছেন। তাঁকে ধরে রাখতেই বাঙালি সহ সমস্ত ভারতবাসীর এই ধনতেরস ভজনা।
লোভ সংবরণ করতে পারলে, সত্যে অবিচল থাকলে সমৃদ্ধি আসে তার পিছে পিছে। সোনার ডিমপাড়া রাজহাঁসের মালিক পারেননি সোনার লোভ সামলাতে। তার পরিণতি আমরা জানি। আবার আরেক নীতি গল্পে সোনার কুড়ুলের লোভ সামলে গরিব কাঠুরিয়া ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীকে। লাভ করেছিলেন দেবীর কৃপা। ধন-দৌলত। যে গল্পের অবতারণা করা হয়েছে শুরুতেই। তাই সত্য, সমৃদ্ধি, সুখ-শান্তি প্রাপ্তির আরেক নামই হল ধনতেরস। জয় হোক ধনতেরসের।