পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
—মহালয়া আবার শুনবে কী! মহালয়া তো তিথি, তা কি শোনবার জিনিস?
—আরে আকাশবাণীর মহালয়ার কথা বলছি, যার নাম মহিষাসুরমর্দিনী।
এই ‘মহালয়া’ আর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সেই কবে থেকে সমার্থক, একাকার হয়ে গিয়েছে। বেতারের একটি অনুষ্ঠান শরতের এক তিথির মাধুর্যকে স্পর্শ করেছে, আপামর বাঙালির উৎসবের মহিমাকে আলিঙ্গন করেছে। কেউ বলেন না ‘মহিষাসুরমর্দিনীর সকাল’। সবাই বলেন ‘মহালয়ার ভোর’। এই ভোর রঞ্জিত হয়, বন্দিত হয়, নন্দিত হয় শুধুমাত্র আকাশবাণীর একটি অনুষ্ঠানে, যা আজ মন্দ্রিত হল ঘরে ঘরে। মনে হল যেন দেবলোক থেকে ভেসে আসছে এক নির্মল আনন্দধারা।
প্রায় নয় দশক হতে চলল (সূচনা ১৯৩২ সালে) এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান আমাদের এই শারদোৎসবের সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে এক নিবিড় ছন্দোবন্ধনে। —কেন বলছি ছন্দের কথা? যেখানেই কথা ও সুরের ছাঁদ, সেখানেই মুক্তি অবাধ। আজ যদি বৃষ্টি নামে তবুও যেন আকাশ নীল। প্রকৃতিতে যদি দেখা দেয় কোথাও আঁধারঘন ছায়া, তবুও সে আঁধার আলোর অধিক। কেন এমন মনে হয়!
পিতৃপক্ষের অবসানে আজ তর্পণ। ‘তর্পণ’ শব্দের অর্থ, যা তৃপ্তিকারক। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান আমাদের হৃদয়ের তর্পণ করে। এক মনোচিকিৎসককে বলতে শুনেছি, এই অনুষ্ঠানটি শুনলেই কীরকম একটা থেরাপিউটিক এফেক্ট হয়। তার মানে আমাদের দগ্ধ বিপন্ন হৃদয়ে কোথাও শুশ্রূষা দেয়। কিন্তু আলাদা করে একটা গানও তো শুশ্রূষা দিতে পারে। কারও কথাও হয়তো পারে তা, যদি সে কথায় থাকে মায়াভরা আস্তরণ, হৃদয়কে ছুঁয়ে যাওয়ার আলোকিত আভা। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের শুরুতেই যখন আমরা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে শুনি: ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর’— তখন কে বলবে বাইরে আলো নেই? এ আলোকমঞ্জীর তো বেজে ওঠে। কোথায় বাজবে তা হৃদয় ছাড়া? আর এরপরের কথাটাই তো: ‘প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জগন্মাতার আগমনবার্তা।’ আমাদের অন্তরই তো দেখতে পায় প্রকৃতির অন্তরাকাশ। সেই অন্তরাকাশের আলো উৎসবে এসে মিশছে। সত্যিই কি আলো উৎসবে এসে মিশেছে, নাকি উৎসব আলোয়? অথবা উৎসব আর আলোয় মাখামাখি হয়ে কি আমাদের কর্ণেন্দ্রিয়ে ঢেলে দিচ্ছে এক নবজাগরণের সুর? যখনই বলা হচ্ছে: ‘আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীমছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব নব ভাব মাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন’— তখন কি মনে হয় না সিঁড়ির ধাপে ধাপে ওপরে উঠে যাচ্ছে এক আলোকমূর্তি, তিনি অধিষ্ঠিতা হচ্ছেন আমাদের হৃদয়মন্দিরে?
এ শুধু কথার রূপকার বাণীকুমারের হাতে তৎসম শব্দমালার ঝঙ্কার নয়। এর গভীরে আছে আলোকিত হৃদয়ের নির্যাস দিয়ে তৈরি ভাষারও এক মূর্তি নির্মাণ। শৈশবে যখন শুনেছি এই অনুষ্ঠান তখন কি এইসব বাক্যবন্ধের অতল ছুঁতে পেরেছি? একেবারেই তা নয়। তবু গীতিগন্ধে কাব্যছন্দে একটা ঘোর লাগত। অলঙ্কারময় ভাষার মাধুর্য যেন স্থায়ী ইশারা রেখে দিত। বছর ঘুরে এই দিনটির প্রতীক্ষায় এক আকুলতার জন্ম দিয়ে যেত। প্রতিবছর শুনি আর কেবলই বয়সকে তুচ্ছ মনে হয়। আজও আকাশবাণীর এই অনুষ্ঠান যেন বলে যায়, জীবনের পরেও আছে অনন্ত জীবন। আর অনুষ্ঠানটির শুরু যেন বেতারেরও জন্মের আগে। —এই কল্পনাবিলাস আবেগের বাড়াবাড়ি নয়। রেডিওয় রূপ-রসের এক সংহত শিল্পের ক্ষমতা যে কতখানি, তার এক আশ্চর্য নিদর্শন এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’
অনুষ্ঠানটির জন্ম তো হয়েছিল আকাশবাণীরই এক ঘরোয়া আড্ডায়। কলকাতায় বেতারের সূচনা থেকেই সকলের দুশ্চিন্তা ছিল, কীভাবে এই মাধ্যমটিকে আরও জনপ্রিয় করা যায় শ্রোতাদের কাছে। নিত্যনতুন নানা অনুষ্ঠানের কথা ভাবতেই হতো অনুষ্ঠানের চালক-পরিচালক সকলকেই। আড্ডায় নানা প্রস্তাব আসত। নতুনত্ব চাই। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নৃপেন মজুমদার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমাররা ছিলেন সেই আড্ডায়। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সকলের কাছে ছিলেন বুড়োদা। তিনিই ছিলেন তখন কার্যত ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদক। তিনি বললেন, ‘মাথা খাটালে অনেক কিছুই করা যায় (তখনও রেডিওয় দিনে রাতে তিনটি অধিবেশনের অনুষ্ঠান চালু হয়নি)। মাঝরাতে বড় গাইয়ে বাজিয়েদের জলসা বসানো যায়, ভোররাতেও কোনও অভিনব অনুষ্ঠান করা সম্ভব।’ সেই সময়ে সকালের অধিবেশন শুরু হতো সকাল আটটায়।
সেই আড্ডায় সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, অনুষ্ঠানটা কী হবে? যে অনুষ্ঠান আজ শুনছি, তাও প্রেমাঙ্কুর আতর্থীরই প্রস্তাব। তিনি আড্ডায় বলেছিলেন, ‘ওই তো বাণী রয়েছে— সংস্কৃতের তো আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে— ওই কতকগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক আর গান লিখুক, রাই সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক— ভোরবেলা লাগিয়ে দাও, লোকের লাগবে ভালো।’ —শ্রোতাকে সেই ভালো লাগানোর স্বপ্ন আজও কোন বিস্ময়ের চূড়ায় অবস্থান করছে, তা আমরা বুঝতে পারছি নিশ্চয়ই।
এতদিনে এ গল্প তো অনেকেরই জানা, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে প্রথম প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান ‘বসন্তেশ্বরী’। বাণীকুমার শ্রী শ্রী মার্কণ্ডেয়চণ্ডীকে ভিত্তি করে লিখেছিলেন এর স্ক্রিপ্ট। তিনি একে কখনও বলতেন ‘চম্পূ’, কখনেও ‘বীথিরূপিকা’। এই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ ভাষাভঙ্গিরই প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। এমনকী অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রটিও তিনিই লিখতেন। এই অনুষ্ঠান যখন শ্রোতাদের বিশেষ প্রশংসা পেল আরও এক ধাপ সাহস বেড়ে গেল অনুষ্ঠান-কর্তাদের। ‘বসন্তেশ্বরী’তে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। বাণীকুমারের ভূমিকা ছিল শ্রীশ্রীচণ্ডীর কিছু শ্লোক আবৃত্তির। আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণর অংশ নাট্য কথা সূত্র আর গীতাংশ। অর্থাৎ গানেও তাঁর কিছুটা ভূমিকা ছিল। অবশ্য অন্য শিল্পীরাও ছিলেন।
কিন্তু অনুষ্ঠানের প্রশংসা পেয়ে সাহস বেড়ে যাওয়ার ফল হল ওই বছরেই মহিষাসুর বধের কাহিনী নিয়ে আর একটি গীতি-আলেখ্য লিখলেন বাণীকুমার। মহাষষ্ঠীর দিনে প্রচারিত হল সেই অনুষ্ঠান। ভোররাতে নয়, ভোরে (সকাল ছ’টা থেকে সাতটা)। তখনও অনুষ্ঠানের নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নয়। ‘বেতার জগৎ’-এ লেখা ছিল ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’। তারপরের কয়েকটি বছর অনুষ্ঠানটি মহালয়ার ভোরে প্রচারিত হয়েছিল ঠিকই, ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি আবার ফিরে আসে মহাষষ্ঠীর সকালে। সেটাও ছিল এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান। এর মধ্যে প্রতিবারই এই অনুষ্ঠানটির নানারকম পরিমার্জন চলেছে। গ্রন্থনায় এবং নতুন গানের অন্তর্ভুক্তিতে। যেহেতু অনুষ্ঠানটি ক্রমশই শ্রোতাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠছে তাই তার মূল কাঠামোর বদল ঘটেনি কখনও। আঙ্গিকেরও কোনও পরিবর্তন হয়নি।
প্রথম দিকে ‘বেতার জগৎ’-এর পাতায় ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ কথাটা লেখা থাকলেও অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘মহিষাসুর বধ’। ১৯৩৭ থেকে নাম হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ‘বসন্তেশ্বরী’র পর্বটা বাদ দিলে এই অনুষ্ঠানে বরাবর গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। শুরুতে কিছু গানের সুর করেছিলেন হরিশচন্দ্র বালী (‘অখিল বিমানে’, ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’), সাগির খাঁ (‘শান্তি দিলে ভরি’) এবং রাইচাঁদ বড়াল ( ‘নিখিল আজি সকল ভোলে’)। বাকি সব গানে সুর দিয়েছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। প্রাক স্বাধীনতাপর্বে এক-দু’বছর বাদ দিলে প্রতিবারই সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন তিনিই।গানে অনেকরকম রাগ-রাগিণীর সমাবেশ ঘটেছে এই অনুষ্ঠানে। ভৈরবী, মালকোষ, বিভাস, শুদ্ধ কল্যাণ, দেশি, পিলু, আহির ভৈরব, মাঝ খাম্বাজ এবং সোহিনী ও পুরিয়া একসঙ্গে। কোনও কোনও রাগের প্রয়োগ ঘটেছে একাধিক গানে। আর রাগরাগিণীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠও এক স্বতন্ত্র সুর রচনা করেছে।
সুরই বলব। প্রথমে কথা ছিল, সংস্কৃত শ্লোক সুরে আবৃত্তি হবে তারপর গ্রন্থনার বাকি কথা গদ্য পাঠের ভঙ্গিতে। বলা ছিল, যন্ত্রীরা গদ্য পাঠের রাগালাপ করবেন ধীরে ধীরে আবহের মতো। হঠাৎই ‘উর্দুভাষী মুসলমান বাদকবৃন্দ শ্লোক আর বাংলা গদ্যের পার্থক্য বুঝতে না পেরে বাজনা বাজিয়ে চলেন কথার সুরের সঙ্গে।’ মন্দ লাগছে না দেখে সেই সুরই চালিয়ে গেলেন ভাষ্যের গদ্যাংশ পাঠে। তাই হয়ে উঠল এক অনবদ্য সৃষ্টি। পিয়ানো যেমন ভালো বাজাতে পারতেন, তেমনি সঙ্গীতে গভীর বোধ ছিল তাঁর। তারপর গান, শ্লোক, আবৃত্তি, স্তোত্রপাঠ— সব যেন এক অভিন্ন সুধা রসের ধারা।
বেতারে আমাদের প্রাক্তন সহকর্মী বন্ধু দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গ্রন্থনার যে বিন্যাস, সেখানে কোথায় মালকোষের আরোহণ অবরোহণ, কোথায় কোমল ধৈবত, কোথায় মধ্যম লাগাচ্ছেন। এই অনুষ্ঠানটির পরতে পরতে সুরের সূক্ষ্ম কারুকার্য।
সেই যুগ কায়েতের ছেলে (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ) কেন স্তোত্র পাঠ করবে, এমন ভক্তিরসের অনুষ্ঠানে মুসলমান বাদ্যযন্ত্রী কেন থাকবে— এমন প্রশ্ন অনেকবার তোলা হয়েছে। কিন্তু কোনও অবাঞ্ছিত প্রশ্নই এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তার গতি রোধ করতে পারেনি। অভিনব কিছু করে দেখানোর আকর্ষণে নতুন একটি রচনার আঙ্গিকে, ভাষ্যে গানে, তার গীতিরূপে একটা চমক দেবার চেষ্টা করেছিল আকাশবাণী, নতুন তারকা সমাবেশে তা সম্প্রচারিত হয়েছিল (১৯৭৬)। কিন্তু শ্রোতারা যে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাও এক ইতিহাস। সেই অনুষ্ঠানের ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’) প্রধান আকর্ষণ ছিল উত্তমকুমার। সমবেতভাবে শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানটি কোনও দিনই রেকর্ডিং করেননি। রিহার্সালও নয়। মহানায়ক তাঁর ভাষ্যটি রেকর্ড করেছিলেন এককভাবে। মুম্বইয়ের শিল্পীদের গান সেখান থেকেই রেকর্ড করে আনা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠান শ্রোতাদের প্রত্যাখ্যানের পর উত্তমকুমার স্বয়ং বলেছিলেন, ‘ঠাকুরঘরকে ড্রয়িংরুম’ বানালে যা হয়, তাই হয়েছে। ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’ আজও শারদোৎসবের অনুষঙ্গেই সম্প্রচারিত হয়, কিন্তু মহালয়ার ভোরে নয়। কারণ মহালয়ার ভোর, এক অন্য অনুভবের, জাগরণের ভোর। উৎসব যে সম্প্রীতির আর সংহতির। তার সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সুর।