কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
নববর্ষের উৎসবে বা বিয়ে, বউভাত, পুজোয় , নিজের বাড়ি বা কুটুম্ব-আত্মীয়বাড়িতে গা ভরা গয়নায় সেজে মেয়ে-বউরা পালকি বা জুড়িগাড়ি থেকে নামত আশপাশের সকলের চোখ ঝলসে দিয়ে। আর এই গয়না পরা নিয়ে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে চলত একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা বা রেষারেষি। যাকে বলা হত বড়মানুষির জাঁক দেখানো। তেমনই একটি স্মৃতির ছবি দেখতে পাই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক পুত্রবধূ, প্রফুল্লময়ীর আত্মকথায়। ‘উৎসবের সময় আমাদিগকে নানারকম গহনা পরিয়া সাজিতে হইত। এখনকার মত তখনকার দিনের গহনা অত হালকা ছিল না। বাড়ির যে নতুন বউ... তাহাকে আরও বেশি গহনার উৎপাত সহ্য করিতে হইত। ...গলায় চিক, ঝিলদানা, হাতে চুড়ি। বালা, বাজুবন্ধ, বীরবৌলি, কানবালা, মাথায় জড়োয়া সিঁথি। পায়ে গোড়ে, পায়জোর, মল, ছানলা চুটকি। এই ছয়-সাত সের ওজনের গহনা, .... গহনার ভারে কোনওরকমে বাঁকিয়া চুরিয়া চলিতাম, তাহাতে বাহিরের লোকেরা মনে করিত যে আমি গহনার জাঁকে ও গুমরে ঐরূপভাবে চলিতেছি। ....ইহা ছাড়াও দশভরির গোট কোমরে পরিবার নিয়ম ছিল।’ গয়নার ভারে তন্বী ত্রয়োদশী বধূটির অবস্থা ও ছয়-সাত সেরের গয়না আজকের যুগে মনে হবে গল্পকথা!
তবে গল্পকথা নয়, এমন গয়নাই সেকালের সচ্ছল পরিবারের রীতি ছিল সেকথা জানা যায় সেকালের আর এক গরবিনী সীমন্তিনী-কৈলাসবাসিনীর নিজের কথায়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী কৈলাসবাসিনী লিখে গিয়েছেন তাঁর অলংকার ঐশ্বর্যের কথা আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। ‘কোমরে দুই ছড়া চন্দ্রহার আর গোট চাবিশিকলি। হাতে দমদম মিচরি তিনজোড়া। পিনখাড়ু তিনজোড়া। ঘোড়োয়া পঁইছা। হাতাহার জাল ও হাতের মুকুতা। হাতে চালদানা, সরদানা। নঙ্গ (লবঙ্গ) কলি, নঙ্গফুল নারিকেল ফুল, মাদুলি, সোনার পঁইছা, বাউটি ও হাতমাদুলি। ওপর হাতে তাবিজ ও বাজু। তাগা, জমন (জসম) ঝাঁপা ও নবরত্ন। গলায় ডামন (ডায়মন্ড) কাটা চিক ও গোপহার ও ছড়িহার ও হেঁসো (হাঁসুয়া) হার। ন-নর গোলমালা। সাত নরদানা। পাচনর পানহার, ন-নর মুকুতা। দো-নর মুকুতা। মুকুতার কন্টি ও আরেক ছড়া কন্টি (কণ্ঠি)। কানে তিনজোড়া চউদানি, দু’জোড়া কানবালা, মুকুতার গোচা ও কান ঝোমকা (ঝুমকা)। মাতায় সিঁতি ও ফুলকাঁটা ও গোট। গলায় চাপকলি ও ধুকধুক। এছাড়া পায়ে ছ’গাছা মল ছিল আশি ভরির। জড়োয়া নথও ছিল কয়েকটি। আরও গয়না নানা উপলক্ষে পেয়েছিলেন বাবা, স্বামী ও শাশুড়ির কাছ থেকে’।
সেকালে গয়নাগাটি মেয়েদের এমনই ছিল। ভারী গয়না। অবনীন্দ্রনাথ দেখেছেন তাঁর সুন্দরী পিতামহীর কিছু গয়না ছিল মায়ের কাছে। ‘হীরে মুক্তো দেওয়া কান, ঝাপটা। ....একটি সাতনরীহার ছিল কী সুন্দর। দুগগো প্রতিমার গলায় যেমন থাকে। সেই ধরনের।’ সেকালেও পুরনো দিনের ভারী জমকালো গয়নার কদর ছিল বেশি। গগনেন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে পূর্ণিমা লিখেছেন সেকথা। তাঁর দাদার বিয়েতে বউ আনতে যাওয়ার সময় পিতামহী সৌদামিনী তাঁর নিজের সেকেলে সব গয়না বের করে দিলেন। বললেন, ‘তোমাদের নতুন গয়না যৌতুক কর। ভারী গয়না না হলে কি বউ মানায়।’ সেইসব ভারী সেকেলে গয়নার কথাও বলেছেন পূর্ণিমা। ‘হীরের কণ্ঠা, কঙ্কন, বাউটি, কানবালা, হীরের কান।’
লেখিকা জ্যোতির্ময়ীদেবী লিখেছেন তাঁর গয়নার কথা। জয়পুর রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সংসারচন্দ্র সেনের পৌত্রী ছিলেন তিনি। তাঁকে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া হয়েছিল ‘মুকুট নয় ভরি, কান ছয় ভরি। সাতলহরী চোদ্দো ভরি চূড় চোদ্দো ভরি। বালা পাঁচ ভরি, তাবিজ সাত ভরি বাঁক পাঁচ ভরি, গোট দশ ভরি।’ আর ছিল হাতভরা চুড়ি, খোঁপার ফুল চিরুনি চার ভরি, জড়োয়া মুক্তো মিনার সরস্বতীহার, নেকলেস, রুপোর মল ছিল ত্রিশ ভরি, পাঁয়জোর কুড়ি/পঁচিশ ভরি।’
উত্তরবাংলার হরিপুরের জমিদারবাড়ির মেয়ে কবি প্রসন্নময়ী লিখেছেন—বাড়ির মেয়ে-বউদের বারোমাসের আটপৌরে গয়না ছিল ‘হাতে বেঁকি চুড়ি, নারকেল ফুল, পৈঁচে, গলায় চাঁপকলি, তুলসীদানা, কানে কদমফুল, পিপুলপাতা, নাকে বেশর, কোমরে গোট।’— এই সামান্য বারোমেসে গয়না হলে জমিদারবাড়ির আভিজাত্যের ঠাঁট বজায় রাখা যেত না। আর নববর্ষের সময় বাড়ির গিন্নি মেয়ে বউ সকলেই ঠাকুর দালানে আসতেন— ‘হাতে বাউটি। পাঁচদানা, কণ্ঠে কামরাঙা হার, নাকে নথ, কানে কড়ি রিং, ঢেঁড়ি ঝুমকা, কোমরে চন্দ্রহার, পায়ে বাঁকমল পরে।
সেকালিনীর গয়নাগাটির কথা বলে শেষ করা যায় না। বিয়ে ছাড়াও অভিভাবক, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িদের কাছ থেকে পেতেন নানা গয়না উপহার বিভিন্ন উপলক্ষে। সেকালেও প্রগতিশীল পরিবারের তরুণী মেয়েরা ভাবী স্বামীর কাছ থেকেও পেয়েছেন উপহার। পরে বলছি সেকথা। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরিবারের ছ’বছর বয়সের গৌরাঙ্গী সারদা পুত্রবধূ হয়ে আসার পর সংসারে নানা শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। তাতে পরম সন্তুষ্ট দ্বারকানাথ পুত্রবধূকে কিনে দিয়েছিলেন— লক্ষ টাকা দামের জড়োয়া খেলনা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুব খুশি করেছিলেন বিদুষী দৌহিত্রী সরলা, মাতামহের প্রিয় কবি হাফেজের কবিতায় সুর বসিয়ে, গান গেয়ে শুনিয়ে। দেবেন্দ্রনাথ দৌহিত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন চুনি ও হীরে বসানো নেকলেস আর ব্রেসলেট। মামাবাবু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে গান শুনিয়ে সন্তুষ্ট করে সুগায়িকা ভাগ্নি সাহানা উপহার পেয়েছিলেন— হীরের আংটি আর বড় বড় মুক্তো বসানো নেকলেস। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ছিল একটি দুর্লভ মোহর। যার একপিঠে জাহাঙ্গির অন্য দিকে ছিল নূরজাহানের ছবি। আর ছিল একটি বড় পান্না। নিজের জহুরিকে ডেকে সেই মোহর ও পান্না দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ স্ত্রী সুহাসিনীকে একটি সুন্দর ব্রোচ তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্দিরা দেবীচৌধুরানির বিয়ের সময় বাবা মা তাঁকে দিয়েছিলেন একটি ‘প্ল্যাটিনামের উপর হীরে বসানো বেশ বড় একটি ফুলপাতা নকশার ব্রোচ। তার বড় ফুলটা কাঁপত।’ লীলা মজুমদার লিখেছেন তাঁর ছোট পিসিমার মেয়ে মালতীর একটি আশ্চর্য সুন্দর ব্রোচের কথা। সেই ব্রোচের ‘মস্ত মুক্তোর ভিতরে আলো জ্বলত।’
প্রাক বিবাহ পর্বে ইন্দিরা ভাবী স্বামী প্রমথনাথের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন এক চেন ব্রেসলেট— যা সেকালে বিদেশিনী মেমদের হাতে দেখা যেত। ইন্দিরা জানিয়েছেন স্মিত মন্তব্য সহ ‘সোনার ঢিলে শিকল হাতে পরিয়েছিলেন।’ আর ‘সোনার হলেও শিকল তো বটে!’ প্রমথনাথ আরও দিয়েছিলেন— ‘নীলাতে মুক্তোতে গাঁথা চিক।’ রমেশচন্দ্র দত্তের বড় মেয়ে কমলার আঙুলে ভাবী স্বামী প্রমথনাথ বসু পরিয়ে দিয়েছিলেন হীরের আংটি।
গয়না নিয়ে চিরদিনই সংসারে, পরিবারে অনেক কথা! অনেক বিবাদ। ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা। অনেক দম্ভ, লোভ, মান অভিমান, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। গয়নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত রোমান্স, রোমাঞ্চ আর ভালোবাসা, আবার দুঃখ ও চোখের জলও। তবুও সংসারে মেয়েদের গয়নার প্রতি দুর্বলতা থাকবেই।
একালেও মেয়েরা গয়না পরে সাজতে ভালোবাসে। তবে সেকালের মতো একশো-দেড়শো ভরির সোনার গয়না এখন গল্পকথা। মেয়েকে পনেরো-বিশ ভরির গয়না দিতেই গৃহস্থের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছে। একশো বছর আগেও সোনার ভরি ছিল— কুড়ি-বাইশ টাকা। এখন দুর্মূল্যের দিনে অকৃপণ হাতে আর সোনার গয়না মেয়ে-বউকে দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবু নববর্ষে পুণ্যলগ্নে প্রিয়জনকে স্বর্ণালঙ্কার উপহার দেওয়ার সাধ তো থাকেই।
যুগের প্রয়োজনে স্বর্ণব্যবসায়ী, স্বর্ণকাররাও নতুন ধরনের গয়না করার চেষ্টা করছেন। সেকালের ভারী ভারী গয়নার বদলে নান্দনিক নকশার হালকা গয়না তৈরি করছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের কেনার ক্ষমতার দিকে নজর রেখেই। এক নামী স্বর্ণকার বলেছিলেন, ‘সেকালের অনেক গয়না এখন ফিরে আসছে, যেমন রতনচূড়, আর্মলেট ইত্যাদি। আমরা সেইসব গয়না কম সোনায় হালকাভাবে সুন্দর নকশায় তৈরি করছি। এখনকার ক্রেতাদের কেনবার ক্ষমতার দিকে লক্ষ রেখে।’ বর্তমান সময়ে এটা খুবই আশা ও আশ্বাসের কথা তা বলাই বাহুল্য, বিশেষ করে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে।
এখন মেয়েরা পরছেন রংবেরঙের পুঁতির মালায় গাঁথা সোনার লকেট, সঙ্গে মানানসই কানের ছোট গয়না। কখনও বা ট্যাসেলের ফাঁসে (নানারঙের) ঝোলে সোনার লকেট, সঙ্গে মানানসই কানের গয়না। আধুনিক কালের মেয়ে-বউদের তাতে আপত্তি নেই, বরং নানা রঙের শাড়ি ও পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে পরা যায় সেই আনন্দটাই বড় কথা। যুগের প্রয়োজন বুঝে মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতাও বদলে গিয়েছে। কিন্তু বদল ঘটেনি গয়না প্রীতির। গয়না তারা ভালোবাসে, পরতেও চায় নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। মেয়েরা এখন অনেক ফ্যাশন সচেতন। কিন্তু নববর্ষ বা পুজোর মতো বাঙালির ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসব অনুষ্ঠান যেন সোনা-জড়োয়ার গয়না ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। আর এইসব উৎসব উপলক্ষে উপহার হিসাবে সোনার গয়নার এখনও তুলনা নেই।