পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
‘তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে
এল এল এল গো।
বুকের আঁচলখানি ধুলায় পেতে
আঙিনাতে মেলো গো।।’
চিরদিনের অভ্যাসমতো ঘাড় উঁচু করে দেখে নিই আজ মন্দিরের আচার্য কে? ইনিও অচেনা। কেবল পরিচিত বৃদ্ধা কল্পিকাদিকে দেখতে পাচ্ছি একটু উঁচু আসনে। আমাদের সময়ের মতোই ইনি মন্ত্রপাঠ করবেন।
আমার মেয়ের বয়স সাত বছর। আমাদের বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের থেকে ছোট। আসলে আমার সব সিদ্ধান্তই দেরি করে নেওয়া। আমার মা হওয়ারও। ছোট্ট তিন্নি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখছে। গানে ওর মন নেই। দেখবে নাই বা কেন? ওর মা যে এখানে পড়েছে। কত গল্প শুনেছে সে সেই ছোটবেলা থেকে। চারপাশে ওর মতো সব ছেলেমেয়ে, কিংবা ওর দাদা-দিদিদের বয়সি। আজ তারা অন্যদিনের থেকে চঞ্চল। মন্দিরের অনুষ্ঠানে মন নেই। গোছা করা ছবি আঁকা কার্ড হাতে তাদের। প্রিয় বন্ধু, হস্টেলের প্রিয় দিদি, দাদা, বোন, ভাই, যাকেই দেখছে, সঙ্গে সঙ্গে তার নাম লিখে তার দিকে কার্ড এগিয়ে দিচ্ছে। একটু মাথা নিচু করে। যাতে মাস্টারমশাইরা দেখতে না পান। আবার তাঁরাও সব দেখে নীরব। উপাসনায় মন দিয়েছেন।
একসময় আমার চিঠি জমানো স্বভাব ছিল। আমাদের সময়ে চিঠি লেখার অভ্যাস ছিল। খুব ইচ্ছে ছিল, মোটুর একখানা চিঠি পাই। কিন্তু কোনও দিনও সে লেখেনি। কেবল এই নববর্ষের দিন কার্ড দিত। সেই নববর্ষের শুভেচ্ছা লেখা, রং পেনসিলে একটা হাতির ছবি আঁকা কার্ড আমার এখনও আছে। পিছনে লেখা মোটাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। ইতি মোটু। ব্রাকেটে প্রীতম নন্দী।
আমি মোটা। সেও মোটা। আমার ইন্দ্রাণী নামটা বন্ধুদের কাছে হারিয়েই গিয়েছিল। মোটা বলতে হস্টেলে, ক্লাসে সবাই আমাকে চিনত, আর মোটু বলতে প্রীতমকে। কেবল আমি কালো, আর ও ফর্সা। বন্ধুরা আমাদের বর-বউ বলে খ্যাপাত। সারিবদ্ধ হয়ে কিচেনে খেতে যাবার সময় কিংবা ক্লাসে শিক্ষক আসার বিরতিতে বন্ধুরা গানের সুরে সুরে মোটা মোটু বলেই যেত। প্রথম প্রথম প্রীতম রেগে যেত। তারপর সেও যেন ব্যাপারটা উপভোগ করতে লাগল। বড় ক্লাসে মোটু বলে ডাকলে, সেও সাড়া দিত। শিক্ষকরাও এই গল্পটা জানতেন। কখনও কখনও তাঁরাও আমাদের মোটা বা মোটু বলে ডেকে ফেলতেন। আবাসিক বিদ্যালয়ে অন্যরকম আবহাওয়া ছিল বলে, অভিমানের কোনও জায়গাই ছিল না।
এবার এতদিন পর, ফেসবুক সূত্রে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হবার পর, যখন পরিকল্পনা করে আমরা ছ’জন ছেলেমেয়ে নিয়ে মিলতে এলাম, তখন গেস্ট হাউসের বারান্দা থেকে আমাকে দেখে ওরা কেমন মোটা মোটা করে চেঁচাচ্ছিল, তাতে এই প্রথম আমার লজ্জা লাগছিল। চারদিকে অচেনা লোকজন। তাছাড়া কয়েকটা অপারেশনের পর আমি এখন বেশ রোগা। তিন্নিও খুব হাসছিল। গেস্ট হাউসের অন্য লোকেরা হাঁ করে নাটক দেখছিল। তারপর অবশ্য ছয় বুড়ির জড়াজড়ি, মারামারি, পাগলামি দেখে তারা শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমরা আড্ডা দিয়েছি, অনেক পুরনো গল্প; শেষ হবার নয়। আজকে আবার হবে। কাল ভোরবেলায় বিদায় নেব। নিজের নিজের সংসার, অফিস, নানা প্রান্ত ডাক দেবে। এখানে এসে আমাদের বয়স কমে গেছে। এখন আমরা আট, দশ, বারো, চোদ্দো কি ষোলো। আমাদের অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু মোটুর কথা ওঠেনি। সচেতনভাবেই হয়তো ওর কথা কেউ তোলেনি।
কিন্তু আজ সকাল থেকে মোটু যেন আমার সঙ্গে রয়েছে। মনে মনে ওর সঙ্গেই যেন কথা বলে চলেছি। মন্দিরের আচার্যের সব কথা আমার কানে ঢুকছে না। সামনে বসে থাকা ছেলেগুলোকে দেখে ভাবছি, মোটুও এমন ছিল। ছোট ছোট করে কদমছাঁট চুল, বড় বড় চোখ, এমন কিছু মোটা নয়, তবু বেঁটে বলে মোটা লাগত বেশি। আসলে সেই সময়টা এমনিই ছিল। কিছু বুঝতাম না, কিন্তু বড়দের মতো হাবভাব ছিল। কারুর সঙ্গে কারুকে জড়িয়ে দিতে পারলে ঢের মজা পাওয়া যেত। আমাদের ক্লাসে আমাদের মধ্যেই কেবল এমনই মিলমিশ পাওয়া গিয়েছিল। নইলে তো শুনতাম, প্রীতমরা মানে মোটুরা খুব বড়লোক। ওদের বিশাল বিশাল মাছের ভেড়ি আছে। তবে ওর বাবা-মা নেই। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে খাদে গাড়ি পড়ে দুর্ঘটনায় দু’জনেই মারা গেছেন। ও তখন খুব ছোট। কোলের বাচ্চা। ও কীভাবে যেন বেঁচে যায়।
যাই হোক, এ নিয়ে অন্যরা দুঃখ পেলেও মোটুর কোনও দুঃখ আছে বলে টের পেতাম না। সে পিসি, পিসেমশাইয়ের আদরে বহরমপুরে মানুষ। তাদেরকেই সে মা-বাবা বলে জানে। সেখানে তার দিদিও আছে। দাদুর বাড়ি, মাছের দেশে সে কদাচিৎ যায়। কিন্তু শুনি ওর কাকারও কোনও ছেলেমেয়ে নেই। সেই বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর পরবর্তীকালে মোটুই হবে। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, ওসব স্বপ্ন কখনও দেখতে চাইনি। আমার বাবা সামান্য সরকারি কেরানি ছিলেন। তাঁর শান্তিনিকেতনে গান শিখতে আসার সাধ ছিল। সেই অপূর্ণ সাধ পূরণে তিনি কষ্ট করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু সিক্সে পড়ার সময়, গ্রীষ্মের এক দুপুরে, ছুটির সময়, রাধাচূড়া গাছের বেড়া দেওয়া নন্দিতাদির বেদিতে বন্ধুরা একদিন মোটা আর মোটুর বিয়ে দিয়েছিল। মোটু লাল মাটির সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল মোটার সিঁথিতে। মধুমালতীর বিনিসুতোর মালায় মালাবদল হয়েছিল। তারপর পাতার লুচি, কাঁকরের ডালনা, ইটের মাংসের ভরপেট ভোজ হয়েছিল।
বিষয়টা খেলারই। কিন্তু ঘটনাটা কীভাবে যে শিক্ষকদের কানে পৌঁছয়! তারপর এত বকুনি খাই যে আমি আর মোটু দু’জনেই দু’জনের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিই। বন্ধুরা রাগানো কমায় না। জোর করে কিচেনে আমাকে তার পাশে বসায়। মোটুর বন্ধুরা মোটুকে আমার গায়ে ঠেলে দেয়।
আমরা দু’জন একসঙ্গে খেলি না, কথা বলি না। তবু দু’জনে দু’জনের দিকে খুব তাকাই। বন্ধুরা রাগায়। একে ওরা বলে ‘ঠুলিমারা’। আস্তে আস্তে ওকে দেখলে আমার বুক কাঁপে। চোখ নিচু করি। কখনও চোখে জল আসে। নাইনে উঠলে ওর রুমমেট আমাকে বলে, বড় হয়ে মোটু তোকে বিয়ে করবে বলেছে। ওর পিসিও তোর কথা জানে। তুই করবি তো? তাহলে বেচারাকে দু’লাইন লিখে দিস। এই নে ওর রাফখাতা। এর পিছনে লিখলেই হবে।
ও খাতা আমি নিইনি। কাঁদতে কাঁদতে হস্টেলের বাথরুমে অনেকখানি সময় ছিলাম। আমি তো আমার সবটুকু মোটুর জন্যই রেখেছিলাম, কিন্তু আমার তো দেবার উপায় ছিল না। একটা কথা বন্ধুদের কাছে আমি লুকিয়েছিলাম। আমিও অনেকদিন জানতাম না। আমার বাবা-মা আমাকে একটা হোম থেকে দত্তক নিয়েছিলেন। এই সংবাদ জানার পর আমি নিজেই এত অশান্ত, বিচ্ছিন্ন এবং আত্মবিশ্বাসহীন ছিলাম যে মোটু কেন, কারুর সঙ্গে যুক্ত হবার কথাই ভাবিনি।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাবার কাউন্সেলিং-এ আস্তে আস্তে প্রাণে বল এল। ভাবলাম, ইলেভেনে ক্লাসের প্রথম দিনেই কথাটা তাকে নিজে ডেকে বলব। চিঠি লিখেও নয়।
হঠাৎই আচার্যের পাঠ কানে এল। ‘বালক নিজেকে ঘরের ছেলে বলেই জানে। তার ঘরের সম্বন্ধকেই সে চরম সম্বন্ধ বলে জ্ঞান করে।’ আর হঠাৎ তখনই তাকে চোখে পড়ল। ওই দিকের কোনায় আপনমনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে একখানা কার্ড দেখছে। আমি দেখতেই থাকতাম তাকে। তাকে মানে মোটুকে। ও কী করে আসবে? এইটুকু হয়ে! এটা কি ওর ছেলে নাকি! আমার কানে আবার রবীন্দ্র রচনাপাঠের খণ্ডাংশ— ‘সে মানুষ, সুতরাং সে সমস্ত মানবের। সে যদি ফল হয়, তবে তার বাপ-মা কেবল বৃন্ত মাত্র; সমস্ত মানব বৃক্ষের সঙ্গে একেবারে শিকড় থেকে ডাল পর্যন্ত তার মজ্জাগত যোগ।’
আমি হাঁ করে তাকে দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ একটু দূর থেকে আমার আর এক বন্ধু রুণি এসে পাশে বসল। মোটুর দিকে বিস্ময়ভরা চোখে ইঙ্গিত করে বলল, ও কে রে?
‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’ গান দিয়ে উপাসনা শেষ হল। আমরা সব বন্ধু একত্রিত। মুখে কারুর ভাষা নেই। সবার চোখ মোটুর দিকে।
ছেলেমেয়ের দল ঘণ্টাতলায় অনুষ্ঠানের দিকে যাচ্ছে। আমরা ওদের পিছনে। যেন সবাই ছেলে-মেয়ে সামলে মোটুকেই অনুসরণ করছি। অমন চুলকাটা, অমন চোখ, চোখের নীচে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের মতো জড়ুল।
ঘণ্টাতলার পাশে নন্দিতাদির বেদির পিছনে ছেলেটা একা একা ঘুরছে। পৃথা এগিয়ে গিয়ে ডেকেই ফেলল, মোটু, এই মোটু শুনে যা।
ছেলেটা ভুরু কুঁচকে বলল, আমার নাম জানলে তুমি কী করে! পৃথা বলল, জানি।
শোনো, ঢপের চপ আমি খাই না। খাওয়ালে একটা আইসক্রিম খাওয়াও। পারবে?
কিন্তু এখানে আইসক্রিমের গাড়ি কোথায়? মোটুই বা কোথায়? আমরা সব বন্ধুরা পাশাপাশি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
আমরা তো সকলেই জানি, সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ছুটিতে মোটু দাদুর বাড়ি গিয়ে জলে ডুবে গিয়েছিল। আর উঠে আসেনি।
আমার বহুদিনের জমানো কথাটা আর ওকে কোনও দিন বলতে পারব না বলে, আমিও আর শান্তিনিকেতনে পড়তে আসিনি। এতদিন পরও আজ কাকে দেখতে এল? আমাকে না আমার মেয়েকে!