বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
কলেজ স্কোয়ারের চারধারে তখনও স্টল বসেনি। পুরনো বইয়ের দোকান ছিল ক্যালকাটা ওল্ড বুক স্টল। মালিক ছিলেন ইউসুফ ভাই। তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন সত্যেন কর। সত্যেনবাবু সম্পর্কে সাহিত্যিক বিমল করের খুল্লতাত। তবে পুরনো দামি বই সব বিক্রি হতো প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিংয়ে রেখে এবং সামনে ফুটপাথে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতেরা উবু হয়ে বই দেখছেন বা বাছছেন, এমন দৃশ্য বিরল ছিল না।
নববর্ষের দিন বইপাড়ার দৈনন্দিন চিত্রটা পাল্টে যেত। দু-চার দিন আগে থেকেই দোকান-ঘর পরিষ্কার হতো। কতকগুলি বইয়ের দোকানে নতুন খাতার পত্তন সহ গণেশ পুজো হতো। গেটের সামনে আমপাতা সোলার কদমফুল দিয়ে সাজানো হতো। তবে বেশিরভাগ দোকানে দেখা যেত— নতুন খাতা নিয়ে বইয়ের দোকানের মালিকরা কেউ কালীঘাটে, কেউ ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে আবার কেউ বা দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতেন।
টেলারিং শপগুলিতে সন্ধেবেলা থেকেই পুরাতন ক্রেতাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। মিষ্টি, নোনতা নানারকম খাবারের ব্যবস্থা থাকত। এই দিনে ক্রেতারা সাধ্যমতো দেনা শোধ করতেন। বকেয়া টাকা তোলার এ একটা পদ্ধতি ছিল। এই হালখাতা বা টাকা জমা দেওয়া চীনেবাজারে ব্রাবোর্ন রোড অঞ্চলে কাগজের দোকানেও ছিল। সেখানে তো দু’দিন ধরেই ভিয়েন বসত। তখন বইপাড়ায় দুটি দোকানের আড্ডার খ্যাতি ছিল। এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স এবং মিত্র-ঘোষ পাবলিশার্সে। এম. সি. সরকারে সুধীর সরকার মশাইকে ঘিরে প্রবীণ লেখকরা বসতেন— সে আড্ডার নাম ছিল হাউস অব লর্ডস। আর মিত্র-ঘোষে গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষকে কেন্দ্র করে অপেক্ষাকৃত নবীন সাহিত্যিকরা আড্ডা দিতেন— এটির নাম সে জন্য ছিল হাউস অব কমনস্।
আড্ডা প্রায় প্রতিদিনই বসত। নববর্ষের দিন অন্য চেহারা নিত। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর এস. পি. এম. (SPM) গাড়ি নিয়ে, সিল্কের পাঞ্জাবি কোঁচানো জরিপাড় ধুতি প্রায় লোটাতে লোটাতে ঢুকলেন। কই হে, কেমন আছ তোমরা? — বলে হাঁক পাড়লেন।
তখন ‘শহর থেকে দূরে’, ‘মানে না মানা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রের বিপুল সাফল্যে তিনি অগাধ অর্থের মালিক। তারাশঙ্করবাবুও গাড়ি নিয়ে আসতেন, সঙ্গে জ্যেষ্ঠ পুত্র সনৎকুমার। তারাশঙ্করের তখন বেশ কিছু বই চলচ্চিত্র হয়েছে। টালা পার্কে নতুন বাড়ি করেছেন, গাড়ি কিনেছেন। বিধানচন্দ্র রায়ের সরকারের মন্ত্রী বিমলচন্দ্র সিংহও গাড়ি নিয়ে আসতেন। সাহিত্যের নেশা ছিল। নিজে ভালো লিখতেনও।
কাউন্টারে অর্ধেক টেবিল জুড়ে বসতেন কবিশেখর কালিদাস রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। বাকি অংশে সংকুচিতভাবে বইয়ের বেচা-কেনা। দোকানঘরের ভেতরেও অনেক লেখক। খরিদ্দার আড্ডার তুমুল হাসি কলরব দেখে চমকে যেত। একেই বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, আগে জানতুম— যদি হয় সুজন তেঁতুলপাতায় ন’জন। আমি এখানে দেখি, গজেনবাবুর তেঁতুলপাতায় আঠারোজন বসে দিব্যি আড্ডা চালাচ্ছেন।
আড্ডায় তারাশঙ্করকে দেখেই কালিদাস রায় বলে উঠলেন, আরে তারাশঙ্কর যে, কতদিন পরে দেখলাম টালার সম্রাটকে।
তারাশঙ্কর মৃদু হেসে বললেন, আমার মতো সামান্য মানুষকে সম্রাট বলছেন দাদা, আপনিও তো টালিগঞ্জের সম্রাট, রসচক্রের কর্ণধার।
কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়ি ছিল ১৩ নম্বর চারু এভিনিউতে। টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের কাছে। একই রাস্তায় পর পর থাকতেন শশিভূষণ দাশগুপ্ত, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
কালিদাসবাবু বললেন, তোর পাড়া আর আমার পাড়া নিয়ে ইংরেজি, বাংলা মিশিয়ে একটা প্রবাদ চালু হয়ে গেছে— কোনও দুর্লভ জিনিস কেউ খুঁজে না পেলেই বলে— টালা টু টালিগঞ্জ কোথাও পাইনি।
আড্ডার মধ্যেই সুনীতিবাবু বললেন, গজেনবাবু, আজ আর শুধু মুড়ি-বেগুনি, ডালমুটে হবে না, সন্দেশ আনান।
তারপর বইপাড়ায় স্টলের সংখ্যা আরও বাড়তে লাগল। স্টলের ঘেরাটোপে কলেজ স্কোয়ারের জল, বিদ্যাসাগরের মূর্তি সব ঢেকে গেল। ডেভিড হেয়ারের মূর্তিও প্রায় অদৃশ্য। দিনে দিনে বইপাড়া আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠল। আমাদের আড্ডাও বাধ্য হয়ে মহাত্মা গান্ধী রোডের উপর পাশাপাশি দুটি বাড়িতে উঠে গেল— ৮৪এ মহাত্মা গান্ধী রোড এবং ৮৬/১ মহাত্মা গান্ধী রোড। এতটা জায়গা পেয়ে আড্ডা আরও জমজমাট হয়ে উঠল। গজেনবাবুর মধ্যে একবার টেকিকার্ডিয়া হল— এতে নাড়ির স্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়, অনেকটা অ্যালার্জির মতো। একটা বিশেষ ইজিচেয়ার আনানো হল, যাতে দরকার মতো লম্বা করে শোয়ার ব্যবস্থাও হতে পারে। দেখা গেল সবারই সেই চেয়ারটায় লোভ, মাঝে মাঝেই গজেনবাবুকে ছেড়ে দিতে হয়। আড্ডার মধ্যমণি প্রমথনাথ বিশী নববর্ষের দিন ভিড় বেশি দেখে চেয়ার ছেড়ে সাময়িক প্রয়োজনে ওঠবার সময়ে নিজের রুমালটা রেখে উঠতেন। এই আড্ডাতেই প্রমথবাবু একটা লাইন টানা খাতা এনে একদিন বললেন— এই খাতাটার নাম দিলাম— খেয়ালখুশির খাতা, যার যা ইচ্ছে হবে লিখবেন। একটা সময়ের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে এই খাতাতে।
শশিভূষণ দাশগুপ্তের মারাত্মক ব্যাধিতে বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের মনঃকষ্ট,অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের আশ্বাস— ‘জীবন-যখন তৃষ্ণাকাতর যখন বীততৃষ্ণ,
স্মরণ কোরো শরণাগত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।’
৬.১.১৯৬৭ সালে ‘রম্যানি বীক্ষ্য’র লেখক সুবোধকুমার চক্রবর্তী লেখেন— আমি লাইন মানব না। (খাতা বাঁকিয়ে নিয়ে লিখলেন) কিন্তু বেলাইনে বলব কী? এর নীচে প্রমথনাথ বিশী লিখলেন— সুবোধবাবু লাইন মানেননি। তিনি রেলে কাজ করেন। এখন রেলগাড়িও লাইন মানে না। লেখা ছাড়াও এই খাতায় ছড়িয়ে আছে আশু বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্র দুগার প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি। নববর্ষে আগে প্রচুর নতুন বই বেরত। চৈত্র মাস থেকেই তোড়জোড় শুরু হতো।
আজও নববর্ষ হয়। তবে আমরা এই সময়ে এমন কিছু করতে চাই না যাতে শুধু নিজের লাভ এবং অপরের ক্ষতি হয়। আর এখন কলেজ স্কোয়ারে তো নববর্ষের বইমেলাই হচ্ছে— বারো দিন ধরে। সেখানে সবাই পাবে বই বিক্রির সুযোগ। পাঠকরাও পাবেন কম দামে।