ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা জেগেছিল মায়ের মুখে কেদারনাথ ধামের গল্প শুনে। তাই ছুটিটা পেয়েই মাথায় এল ছোটবেলার স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা। কেটে ফেললাম দুন এক্সপ্রেসের টিকিট। ট্রেনে যেতে যেতেই আলাপ হল এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। বর্ধমানে বাড়ি কিন্তু কর্মসূত্রে দেরাদুনে থাকেন। গল্প করতে করতে কখন যে ৩৩ ঘণ্টা কাটিয়ে ফেললাম মালুমই হল না। আমার ভ্রমণ সঙ্গী সহকর্মী সুজয়। হরিদ্বার হয়ে হৃষীকেশ পৌঁছলাম। সেখান থেকে যাত্রা শুরু হল রুদ্রপ্রয়াগ যাওয়ার বাস ধরে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা আর সামনে স্বপ্নপূরণের হাতছানি সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক ভালোলাগা। শ্রীনগর পেরিয়ে আমরা যখন রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটে ছুঁই ছুঁই। গৌরীকুণ্ড পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। এখানে বসেই শিবকে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করেছিলেন গৌরী। অবাক করা বিষয় চারিদিকে এত ঠান্ডার মধ্যে কুণ্ডের জল খুবই গরম। পরদিন ভোর থেকে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। কেদারনাথের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম বৃষ্টি একটু থামার পর। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল আর বুঝি পারব না। আবার মন শক্ত করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। মনের এই শক্তিটাই দ্বিগুণ হল যখন দূর থেকে কেদারের শৃঙ্গটা দৃশ্যমান হল। হেঁটে না যাওয়ার কথা আর মনে আসেনি। কেদারনাথ যাওয়ার নতুন রাস্তাটি আগের পুরনো রাস্তার থেকে আরও দুর্গম। বেশ কষ্ট হচ্ছিল চড়াইতে উঠতে। তাই মাঝে মাঝে হাঁটা রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে পড়ছিলাম রাস্তা কিছুটা কমানোর জন্য। গৌরীকুণ্ডের থেকে কেদারনাথের দূরত্ব ১৭ কিমি। ১৫ কিমি অতিক্রম করে দূর থেকে কেদারনাথ ধাম দেখতে পাওয়ার যে আনন্দ, সেটা যাঁরা গিয়েছেন কেবল তাঁরাই জানেন।
টলমল পায়ে ক্লান্ত শরীরে শেষ দুই কিমির জন্য রওনা দিলাম। মন্দাকিনীর উপর সেতুটা অতিক্রম করে যখন মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা। মন্দিরের পাশেই একটা থাকার ব্যবস্থা করে ফেললাম। রুমে ঢুকে যখন বিছানায় বসলাম উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও তখন হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমরা তো এখানে আরাম করতে আসিনি, মহাদেবের দর্শন পেতে এসেছি। এটা ভেবেই একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম মন্দির যাওয়ার জন্য। শেষ সিঁড়িটি অতিক্রম করে যখন মন্দির প্রাঙ্গণে এলাম সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভাসে। চারদিকে বরফাবৃত পাহাড়ের মাঝে মন্দিরটি দেখে সার্থক হল চোখ।
ওখানকার সন্ধ্যারতিও দেখার মতো।
পরেরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম মন্দিরে পুজো দিয়ে চোরাবারি তাল যাওয়ার জন্য। ছোট্ট পাথরের গুহার মতো মন্দিরের ভিতরে পুরাকাল থেকে বিরাজমান বাবা ভোলানাথ। পুজো সেরে রওনা হলাম চোরাবারি তাল যাওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাস্তা খারাপ থাকার জন্য অনুমতি পেলাম না। অতঃপর ফিরে আসতে হল। মনটা একটু খারাপ লাগছিল, এত কাছে এসেও যেতে পারলাম না! ভোলানাথকে প্রণাম জানিয়ে চলে এলাম। এবার ফেরার পালা।
—শিলাজিৎ দাস, কলকাতা