অর্থনীতি নিয়ে পড়তে
হলে অঙ্ক জানাটা আবশ্যিক
উচ্চমাধ্যমিকের পর অর্থনীতি নিয়ে কীভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য এগনো সম্ভব? বা অর্থনীতি নিয়ে পড়ে কেরিয়ারের সুযোগ কেমন? আমাদের প্রতিনিধি কৌশানী মিত্রের বিভিন্ন প্রশ্নের সহজ উত্তর দিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি এবং মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের অধ্যাপিকা স্বাতী ঘোষ।
‘অর্থনীতি’- নামটি ছাত্র ছাত্রীদের কাছে বেশ একটা ভয়ের বিষয়, অনেকে মনে করে কঠিন বিষয় তাই উচ্চশিক্ষায় যাওয়া আরও কঠিন। আর সেই কারণেই অর্থনীতি নিয়ে কলেজে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর পরিমাণ বেশ কম। কথাটা সত্যি, নাকি মিথ?
না, এটা মিথ নয়। বর্তমানে অর্থনীতি পড়তে আসছে অনেক কম ছাত্রছাত্রী। সেটা কলকাতা কিংবা কলকাতার বাইরে সব জায়গাতে একই। আসলে ইকনমিক্স-এর অনেক ভাগ আছে। এর যে থিওরির পেপার তাতে মাইক্রো ইকনমিক্স, ম্যাক্রো ইকনমিক্স, ট্রেড, ফিনান্স এই পেপারগুলোয় কিন্তু অঙ্কের ভিত্তি না থাকলে বোঝা মুশকিল, কারণ অর্থনীতিতে আমরা সমস্যাগুলিকে ম্যাথামেটিক্যালি ফরমুলেট করি এবং সেখান থেকে একটা মডেল তৈরি করে তা দিয়ে আমরা উত্তর খুঁজি। কিংবা সেই মডেল দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি নির্দিষ্ট বিষয়টি। এখন অঙ্ককে যারা ভয় পায়, তারা ইকনমিক্স কম পড়তে আসবে। আর এই বিষয়টি খুব একটা মুখস্থ করে পড়া যায় না। এখানে কিছুটা বুঝে কিছুটা মুখস্থ করে পাশ করা যায় না। এখানে অঙ্কটাকে ব্যবহার করা হয় একটি টেকনিক কিংবা টুল হিসাবে। এবার আমরা কখন সেই টেকনিক কিংবা টুল ব্যবহার করব, সেটা না বুঝতে পারলে অঙ্কের মাধ্যমে বিষয়টাকে বোঝা খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাই অর্থনীতি বুঝতে গেলে অঙ্কের প্রায়োগিক দিকটা বুঝতে হবে। সেটা যারা সঠিক বুঝতে পারবে, তারা অর্থনীতি নিয়ে পড়তেই পারে।
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে আমরা দেখি অর্থনীতি পড়ে আর্টস কিংবা ইকো-সায়েন্স এর ছাত্রছাত্রীরা। যাদের অনেকের অঙ্ক নেই কিংবা অঙ্ক ফোর্থ সাবজেক্ট। সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে পড়া হয় না। কিন্তু সায়েন্স থেকে যারা অর্থনীতি পড়তে আসে তারা অঙ্কে ভালো। অর্থনীতি নিয়ে পরবর্তী সময় পড়ার জন্য কোন সাবজেক্ট-কম্বিনেশন ছাত্রছাত্রীরা বেছে নিতে পারে?
দু-ধরনের ছেলে-মেয়ে মূলত ইকনমিক্স পড়তে আসে, একদল আসে যারা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী, কোন কারণে তারা পিওর সায়েন্স-এ না গিয়ে সমাজ এবং বিজ্ঞান দুটি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চায়, তারা ভালবেসেই আসে। একটা অংশ থাকে ফিজিক্স কিংবা কেমিস্ট্রিতে একটু দুর্বল, তারাও আসে এই বিষয় পড়তে। আর একদল আসে যারা হয়তো অন্যান্য সোশ্যাল সায়েন্স পড়তে গিয়ে মনে করছে ইকনমিক্স থেকে কিছু দরকারি ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। তাই জানার আগ্রহ থেকে তারা ইকনমিক্স পড়তে আসছে। ইকনমিক্স এর সঙ্গে যোগসূত্র আছে এমন বিষয় যেমন অঙ্ক, সংখ্যাতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান— যা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে চাইতে পারে, তারা এই বিষয়টাকে বেছে নিচ্ছে। আর অঙ্ক না থাকলে ইকনমিক্স অনার্স পড়ার কোন সুযোগ নেই। তাই অঙ্ক থাকতেই হবে। তবে এমনও নয় যে খুব সাংঘাতিক ধরনের কোন অঙ্ক করতে হবে। খুব সাধারণ বীজগণিত, ক্যালকুলাস এটুকু দিয়েই অনেক তত্ত্বকে বোঝা যায়। খুব সরল অঙ্ক বা গ্রাফ দিয়েই বোঝা যায়, কীভাবে অর্থনীতির ওঠাপড়া চলে বা কীভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। তাই এটা একেবারেই নয় যে খুব জটিল বা কঠিন অঙ্ক নিয়ে প্রথমেই কাজ করতে হয়। তবে যত উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়া যায়, তত অঙ্কের নতুন কিছু টেকনিক বা দিকগুলো শেখা সম্ভব হয়।
আর যারা অঙ্কে ভয় পায় কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের অংশ হিসাবে সমাজ-অর্থনীতিকে ভালোবাসে, তাদের পক্ষে কী উচ্চশিক্ষায় যাওয়া সম্ভব হবে?
হ্যাঁ সম্ভব হবে। তাকে বুঝতে হবে, আমি অর্থনীতিতে অঙ্কের প্রয়োগ কীভাবে ঘটাচ্ছি আর কেন ঘটাচ্ছি। সেটুকু বুঝে নিয়ে সে যদি এগতে চায় এবং যেখানে তার আগেই অঙ্ক ছিল এবং সে পাশ করে এসেছে, সেখানে ইকনমিক্স-এর অঙ্ক নিয়ে কাজ করতে তার খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ ইকনমিক্স মানেই অঙ্ক তা তো নয়। এটা সমাজবিজ্ঞান। আর সেটা বোঝার জন্য যেটুকু অঙ্ক লাগে সেটুকুই তাদের করতে হবে।
এই যে আপনি বললেন ইকনমিক্স-এর মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে ছাত্রছাত্রী তাকে কতটা ভালোভাবে বুঝতে পারছে তার ওপর। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখে থাকি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা কিছু নোটস মুখস্থ করে এবং তার ওপর ভরসা করেই অনেক সময় পরীক্ষা দিয়ে থাকে। তাতে তাদের বোঝার জায়গায় অনেক সময় গলদ থেকে যায়। ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষায় কী তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
এখানে বলব নোটস মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়া শুধু ইকনমিক্স-এর দোষ নয়, এটা সমস্ত বিষয়েই হয়ে থাকে। নিশ্চয় সেই সব কোচিং সেন্টারগুলিতে বিষয়টিকে বোঝানো হয়, তাই পাশ করে যায়। তবে মুখস্থ করে ইকনমিক্স হয় না, সেটা আমি বলতে পারি। আমার মনে হয় মুখস্থ করে পাশ সেটা কোনও বিষয়েই হয় না। কোনক্রমে পাশ করা যায়, কিন্তু বুঝে, ভালোবেসে না পড়লে কোনও বিষয়ে এগনো যায় না, উচ্চশিক্ষা তো নয়ই।
স্কুল-শিক্ষায় আমাদের রাজ্যে একাধিক বোর্ডের উপস্থিতি দেখি আমরা। সিলেবাস বা পড়ানোর ক্ষেত্রে এই সব বোর্ডগুলির শেখানোর পদ্ধতিগত কোন তফাত আছে কী? অর্থনীতির সিলেবাসের ওপর ভিত্তি করেই জানতে চাইছি।
কোনও বোর্ড হয়তো একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর অঙ্ক দিয়েই কোন থিওরি বোঝানোর চেষ্টা করে, আবার কোনও বোর্ড চেষ্টা করে সিলেবাস এমনভাবেই তৈরি করতে যা একই অঙ্ক বোঝাচ্ছে, কিন্তু গ্রাফ/ছবির সাহায্যে বোঝাচ্ছে, সেটা একটু সহজ। আবার কোন বোর্ড ভাবছে অঙ্ক কম থাক, বিষয়গত ভাবে একেবারে বেসিক জায়গাটা বুঝিয়ে দিই। এই রকম কিছু ছোটখাটো তফাত আছে।
বলা হয় অর্থনীতির মতো বিষয়ের ল্যাব হল গোটা সমাজ। অর্থনীতি পড়তে গেলে দেখার চোখ পরিবর্তন কতটা জরুরি? এই অভ্যাস একজন ছাত্রছাত্রী গড়ে তুলবে কীভাবে?
এর জন্য এই বিষয় ভালো বই পড়তে হবে, অনেক ভালো ভালো অর্থনীতিবিদরা অনেক বই লিখেছেন। তবে তা টেক্সট বই হতে হবে নোটবই নয়। এখানে আমি টেক্সট বই আর নোট বইয়ের মধ্যে তফাত করব। বড় অর্থনীতিবিদরা যেসব বই লিখে গেছেন, সেগুলো অবশ্যই ইংরেজিতে, সেগুলো পড়তে হবে। নোটবই কেবল পরীক্ষা পাশের সহায়ক। দুটোকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের কী কোনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় উচ্চশিক্ষা পর্যায়? কারণ উচ্চশিক্ষায় অধিকাংশ বই ইংরেজিতে লেখা।
না, এখানে ভাষাকে আমি কোনও বাধা বলে মনে করি না। কারণ বাংলা মাধ্যমের যারা ভালো ছাত্রছাত্রী, তারা সব বিষয়ে ভালো। ভাষার জন্য তাদের বিষয় নিয়ে এগতে কোথাও আটকানোর কথাই নয়। এখন যদি দেখা যায় বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীরা অনেকাংশে পাশ করতে পারছে না, তাহলে আমি বলব সেটা পড়ানোর কোনও খামতি থেকেই হচ্ছে। ভাষার জন্য নয়।
এবার আসি চাকরির প্রসঙ্গে। অর্থনীতি নিয়ে পড়লে চাকরির সুযোগ আছে এটা সবাই জানে। অনেকেই ব্যাঙ্ক কিংবা সরকারি নানা চাকরির জন্য চেষ্টা করে, পরীক্ষা দেয় এবং সুযোগ পায়। আচ্ছা কিছু গতানুগতিক জায়গা ছাড়া ইকনমিক্স-এ আর কী কী চাকরি হতে পারে?
ইকনমিক্স এমন একটি সাবজেক্ট যার বিস্তার অনেকটা। কিছু গতানুগতিক চাকরি আছে যেমন কর্পোরেট সেক্টরে বিজনেস অ্যানালিটিক্স, অথবা ব্যাঙ্কিং সেক্টর। অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে যাওয়া যায়, তবে তার জন্য ইনভেস্টমেন্ট একটু বেশি। ভালো রেজাল্ট করতে হবে, নেট দিতে হবে, পিএইচডি করতে হবে। তারপর এই ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। ভাববার ক্ষমতা থাকতে হবে এক্ষেত্রে। কারণ গবেষণা মানেই একটা কিছু নতুন কথা বলা, মার্জিনাল হলেও কিছুটা নিজের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবেই। সাধারণত কলকাতা এবং কলকাতার বাইরেও যারা ভালো ছাত্র, তারা জিআরই দিয়ে বাইরে যায় এবং সেখানেই গবেষণা করে তারপর কেউ দেশে ফিরে আসে, কেউ আসে না। এছাড়াও সরকারি চাকরির পরীক্ষাতেও ইকনমিক্স-এর ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফল করতে পারে। ইদানীং ইকনমিক্স পড়ে অনেকেই সাংবাদিকতায় যাচ্ছে। যারা ভালো লিখতে পারে তাদের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা খুব গ্রহণযোগ্য। কারণ অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীরা সমাজ এবং অর্থনীতিকে অ্যানালিটিক্যালি ভালো বিশ্লেষণ করতে পারে। এছাড়াও অনেক এনজিও-তেও ইকনমিক্স এর ছাত্রছাত্রীরা চাকরি পাচ্ছে।
এনজিও-তে কী সেই অর্থে কেরিয়ার তৈরি করা সম্ভব?
এখন অনেকেই করছে, কারণ ধারণা পাল্টেছে। এখন ডেভেলপমেন্ট এনজিও যারা, তারাও বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রান্ট সংগ্রহ করে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করতে চাইছে। অনেক রিসার্চ এনজিও আছে, সেখানে ডেভেলপমেন্ট নিয়ে নানা রিসার্চ, প্রজেক্ট ভিত্তিক কাজ হচ্ছে। এই সব ক্ষেত্রে কিন্তু ইকনমিক্স-এর ছাত্রছাত্রীরা সুযোগ পাচ্ছে, দাম পাচ্ছে। আমি বলব না প্রথমেই গ্লোবাল এনজিওগুলোর মতো বড় জায়গায় কেউ পৌঁছতে পারবে, কিন্তু বিষয়টাকে ভালোবেসে লেগে থাকলে সফল হওয়া সম্ভব।
এবার উচ্চশিক্ষার দিকে আসি। সমাজবিজ্ঞান-এ প্রতিনিয়ত নতুন কিছু নিয়ে কাজ করতে পারা সম্ভব। সমাজ এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতেও এমন অনেক নতুন বিষয় আসছে, যা নিয়ে আগে কাজ হয়নি অথবা নতুন কিছু বলা এখনও বাকি আছে। সেদিকে একটু আলোকপাত করুন।
ইকনমিক্স-এর বাউন্ডারি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। এখন কিছু নতুন দিকে কাজ হচ্ছে যেমন এক্সপেরিমেন্টাল ইকনমিক্স, এনভায়ারমেন্টাল ইকনমিক্স, রিসোর্স ইকনমিক্স ইত্যাদি। রিসোর্স ইকনমিক্স-এ জল, অরণ্য এসব নিয়েও কাজ হতে পারে। জেন্ডার ইকনমিক্স নিয়ে কাজ হচ্ছে। পাশ্চাত্যে ফেমিনিস্ট ইকনমিক্স বলে একধরণের ফিলোজফিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং রয়েছে। ইকনমিক্স অ্যান্ড ল- এটাও আর একটা নতুন জায়গা। যেহেতু সমাজবিজ্ঞান ইন্টারডিসিপ্লিনারি তাই অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ইকনমিক্স-এরও অনেক কাজ হচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক পড়তে এসে ছাত্রছাত্রী অর্থনীতি বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হয়। একজন ছাত্রছাত্রী কীভাবে নিজেকে মূল্যায়ণ করবে, যে সে ভবিষ্যতে এই বিষয় উচ্চশিক্ষা করার উপযুক্ত?
প্রথমত বেসিক কিছু জিনিস যেটা বললাম, যেমন অঙ্কটা জানতেই হবে। সঙ্গে দেখতে হবে তাকে ভারত কিংবা বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তন বা বর্তমান অবস্থা— এসব ভাবায় কিনা। সেগুলো জানতে ইচ্ছা করে কিনা? এটুকু থাকলেই অর্থনীতি নিয়ে এগনো যেতে পারে। তারপর তো পড়তে পড়তেই শেখা, বিষয়টিকে আরও জানলে এমনিতেই ভালবাসা তৈরি হবে।