বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
ভারতের পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরের ধারে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপিত হবে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত GLLV Mark 3 রকেট। ১৫ জুলাইয়ের প্রারম্ভ মুহূর্তে রাত্রি ২টো ৫১ মিনিটে এই GSLV রকেট পাড়ি দেবে — মহাশূন্যে। তার নাকের ডগায় থাকবে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গত সাত বছরের নিরলস সাধনার ফল — একটি মহাকাশ যান, যার নাম চন্দ্রযান-২।
২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর একটি PSLV রকেটে চড়ে পাড়ি দিয়েছিল চন্দ্রযান-১। ১৪ নভেম্বর চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে চাঁদের বুকে নিক্ষেপ করেছিল Moon Impactor Probe (MIP)। সেই আঘাতে চাঁদের পৃষ্ঠদেশ থেকে ছিটকে উঠেছিল অনেক ধুলো। সেই ধুলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে চন্দ্রযান-১ আমাদের জানিয়েছিল, চাঁদের পৃষ্টদেশ ও আবহাওয়ামণ্ডলে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি। চন্দ্রযান-১ হল এগারোটি যন্ত্র সম্বলিত এমন এক মহাকাশযান যা প্রাথমিকভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিমি উচ্চতা বজায় রেখে প্রতি ১১৭ মিনিটে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করেছিল। প্রদক্ষিণরত অবস্থায় তার যন্ত্রের দ্বারা সংগৃহীত যে সমস্ত তথ্য চন্দ্রযান-১ পাঠিয়েছিল ভারতের বিজ্ঞানীদের কাছে, তা অভূতপূর্ব। চাঁদের বুকে ম্যাগনেশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম এবং সিলিকনের মতো খনিজ পদার্থের উপস্থিতির কথা জানান দিয়েছিল সে।

মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ করে চন্দ্রাভিযানের নিরিখে, ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য। চাঁদে জলের এই উপস্থিতিই একদিন মহাশূন্যে মানব সভ্যতার প্রথম উপনিবেশ গড়ার কাজ সম্ভব করবে। প্রায় সাড়ে দশমাস ধরে প্রদক্ষিণরত চন্দ্রযান-১ চন্দ্রপৃষ্ঠের বহু ছবি, পৃষ্ঠদেশের খুঁটিনাটি এবং রাসায়নিক গঠন নিয়ে প্রভূত পরিমাণে তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাই চন্দ্রযান-১-কে ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানের এক স্বর্ণময় অধ্যায়ের পথিকৃৎ হিসাবে ভাবা যেতে পারে।
চন্দ্রযান-১ এর উৎক্ষেপণের সময়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা কিন্তু পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন আরও এক দৃঢ় পদক্ষেপের। তারা ভাবতে শুরু করেছিলেন চন্দ্রযান-২ এর কথা, যেখানে এই কৃত্রিম উপগ্রহটি যে শুধুমাত্র চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে তা নয়, এই Orbitor থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকারী একটি মহাকাশযানের (Lander) পরিকল্পনা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা আরও আশা করেছিলেন যে, এই Lander-এর মধ্যে থেকে একটি স্বয়ংক্রিয় যান (Rover) সফলভাবে তৈরি করতে সক্ষম হবেন।
২০০৮ সাল থেকে তার কাজও শুরু হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, ভারতের ইসরোর বিজ্ঞানীরা তৈরি করবেন প্রদক্ষিণকারী Orbitor এবং স্বয়ংক্রিয় যান (Rover)। অবতরণকারী Module (Lander) তৈরি করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা Roscosmos। ঠিক হয়েছিল, ২০১২ সাল নাগাদ চন্দ্রযান-২ কে উৎক্ষেপণ করা হবে। কিন্তু, রাশিয়ার মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের উদ্দেশ্য পাঠানো Phobos Grant Mission-এর জন্য তৈরি অবতরণকারী যানটিকে বানাতে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে অসফল হন। তারা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা থেকে সরে আসেন। এই ঘটনাটিতে ইসরোর বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা আরও সুদৃঢ় হয়। তাঁরা ঠিক করেন, সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তি দ্বারাই চন্দ্রযান-২ এর Orbitor, Lander এবং Rover-কে তৈরি করবেন। এমনকী, চন্দ্রযান-২ কে পাঠানোর জন্য GSLV Mark-3 রকেটিকেও সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করার প্রতিজ্ঞা নিলেন তাঁরা।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইসরোর বিভিন্ন কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে গত ছ’বছরে সৃষ্টি করেছেন চন্দ্রযান-২। ১৫ জুলাই এই চন্দ্রযান-২ কে নিয়ে পাড়ি দেবে GSLV Mark-3 রকেট। উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রযান-২-কে স্থাপন করার চেষ্টা করা হবে পৃথিবীর চারদিকে একটি অতি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। কক্ষপথের আয়তন ধীরে ধীরে বাড়িয়ে একসময় চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করানো হবে এই মহাকাশযানটিকে। তারপর উৎক্ষেপণের প্রায় বাহান্ন দিন পরে যখন চন্দ্রযান-২ চাঁদের পৃষ্ঠদেশ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রেখে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করবে, তখন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে একটি অবতরণকারী যান। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এই যানটির নাম রেখেছেন ‘বিক্রম’।
গত পঞ্চাশ বছরের চন্দ্রাভিযানের ইতিহাসে ভারত প্রথমবার চেষ্টা করবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণ করার। এর আগে কোনও মহাকাশযান যেখানে অবতরণ করতে সক্ষম হয়নি। অবতরণ করার কিছু পরেই বিক্রমের থেকে বেরিয়ে আসবে একটি স্বয়ংক্রিয় যান। ২৭ কিলোগ্রাম ওজনের ছটি চাকা সম্বলিত এই যানটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রজ্ঞান’। এর উপরে থাকবে দুটি যন্ত্র, যা চাঁদের পৃষ্ঠদেশের রসায়ন এবং আবহাওয়ামণ্ডলের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে। এটি অবতরণক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে প্রায় পাঁচশো মিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করতে সক্ষম হবে। সেই তথ্য এই স্বয়ংক্রিয় যান সংগ্রহ করবে এবং তা বেতার সংকেতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবে অবতরণকারী বিক্রমের কাছে।
অবতরণকারী Lander বিক্রমের ওজন ১৪৭১ কেজি। মূলত চারটি যন্ত্র থাকবে এতে। চাঁদের পৃষ্ঠদেশের কিছুটা গভীর পর্যন্ত তাপমাত্রা, চন্দ্রপৃষ্ঠের কম্পন, জলীয় বরফের উপস্থিতি এবং আবহাওয়া মণ্ডলের সূর্য রশ্মির প্রভাব খুটিয়ে দেখার চেষ্টা করবে এই যান। এছাড়াও এতে থাকবে Laser Retroreflector Array (LRA), যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব মাপা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীরা এর কার্যাবলী সময়কাল ধার্য করেছেন ১ চান্দ্র দিন। পৃথিবীর হিসাবে যা কিনা প্রায় ১৪ দিনের মতো।
২৩৭৯ কেজি ওজনের চন্দ্রযান-২ প্রদক্ষিণকারী মহাকাশ যানটিতে থাকবে আটটি যন্ত্র। এক বছর সময় ধরে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করতে করতে চন্দ্রযান-২ চাঁদের গঠন, আকার, রসায়ন ও জলীয় বরফের উপস্থিতির কথা জানার চেষ্টা করবে। তার সংগৃহীত তথ্য সে প্রেরণ করবে দক্ষিণ ভারতে বায়ালুলুতে Indian Deep Space Network (IDSN)-এর Command ও Communication Centre-এ।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কিছু অঞ্চল আছে যেখানে কোনওদিন সূর্য-রশ্মি পৌঁছয় না। তার ফলে এই অতীব শীতল অঞ্চলে গহ্বরগুলির তলদেশে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বরফ আছে। তাই তাঁদের বিশ্বাস, চন্দ্রযান-২ হবে প্রথম মহাকাশ যান, যা আবিষ্কার করতে পারবে সেই জলীয় বরফের উপস্থিতি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবার চন্দ্রযান-২ হবে এমন একটি প্রয়াস, যা চাঁদ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে আরও উস্কে দেবে চাঁদের বুকে মানুষের উপনিবেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে।
আগামী ১৫ জুলাই প্রত্যেক ভারতবাসী উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করবে চন্দ্রযান-২ এর সফল উৎক্ষেপণের জন্য। দেশবাসীর আশা, ৬ সেপ্টেম্বর সফলভাবে অবতরণ করবে বিক্রম। সফল হবে প্রজ্ঞানের চন্দ্রপৃষ্ঠ সফরও। সেদিন প্রতিটি নাগরিক ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সেই অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে গর্ব বোধ করবেন। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি।
(লেখক এম পি বিড়লা তারামণ্ডলের অধিকর্তা, গবেষণা ও শিক্ষণ)