সন্দীপ বর্মন, কোচবিহার: কোচবিহার জেলার আবহাওয়া ও জমির চরিত্র অনুযায়ী নভেম্বর মাস ডাল চাষের উপযুক্ত সময় বলে জানাচ্ছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা জানান, একটু উঁচু, যেখানে বৃষ্টির জল দাঁড়ায় না, এ ধরনের ঢালু জমিতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই কলাইয়ের বীজ বোনা যেতে পারে। অনেকে অক্টোবরেও এই চাষ শুরু করতে পারেন। বীজ বোনার আগে ভালো করে জমি শুকিয়ে নিতে হবে। বীজবাহিত রোগ থেকে রেহাই পেতে হলে প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে থাইরাম ৭৫ শতাংশ ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করে নিতে হবে। এছাড়া রাইজোবিয়াম কালচার বা জীবাণুসার ব্যাবহার করলে বীজ বোনার সাতদিন আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। তবে রাসায়নিক সারের পরিপূরক হিসেবে বিভিন্ন প্রকার জৈবসার ব্যবহার করা যেতে পারে। খামার পচা সার, আর্বজনা সার, কেঁচোসার, সবুজ সার (ধৈঞ্চা সার, বরবটি) ও জীবাণু সার প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। জৈব সার ব্যবহার করলে জমি তৈরির সময়ে প্রতি বিঘা জমিতে কমপক্ষে ৬০০ কেজি সার প্রয়োগ করতে হবে। ডাল চাষের প্রসার ঘটাতে সম্প্রতি কল্যাণীতে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে দু’দিনের আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চাষিরা অংশ নেন। উন্নত প্রথায় ডাল চাষ করলে দ্বিগুণ লাভ পাওয়া সম্ভব বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। তবে তাঁরা উন্নত জাত, সঠিক পরিচর্যার উপর জোর দেন। বিসিকেভির শস্য বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. কল্যাণ জানা জানিয়েছেন, এ রাজ্যের লালমাটির জেলাগুলিতে যেখানে জলের সঙ্কট রয়েছে, সেখানে আমন ধান তুলে নেওয়ার পর জমি পড়ে থাকে। ওই জমি ফেলে না রেখে অনায়াসেই ডাল চাষ করে চাষি ঘরে লাভ তুলতে পারেন। তা ছাড়া বছরে একবার ডালচাষ করলে জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তবে অনেক কৃষকই অবহেলার সঙ্গে ডাল চাষ করে থাকেন। এই প্রবণতা ঠিক নয়। ভালো জাত দরকার। স্থানীয় জাতের চাষ করে বিঘায় ৫৫০ কেজি ডাল পাওয়া যায়। সেখানে ভালো জাতের বীজে চাষ করতে পারলে এক বিঘা জমি থেকে ১৫০০ কেজি ডাল পাওয়া যেতে পারে। ডাল বীজ বোনার আগে প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে আড়াই গ্রাম ম্যানকোজেব দিয়ে শুস্ক পদ্ধতিতে শোধন করে নিতে হবে। অবশ্যই সার্টিফায়েড অর্থাৎ সংশিত বীজে চাষ করতে হবে। এখনও পর্যন্ত আমরা রাজ্যে যে ডাল উৎপাদন করে থাকি, তা চাহিদার মাত্র ১৫-২০ শতাংশ। ফলে বাইরে থেকে প্রচুর ডাল কিনতে হয়। উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে ঘাটতি পূরণ হবে।
সাধারণত সারদা (ডব্লিউ.বি.ইউ-১০৮), গৌতম (ডব্লিউ.বি.ইউ-১০৫) জাতের কলাই বোনার উপযুক্ত সময় সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। প্রতি বিঘা জমিতে তিন কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। সারি করে লাগালে ভালো হয়। একটি সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব হওয়া উচিত ১২ ইঞ্চি ও একটি গাছ থেকে আরও একটি গাছের দূরত্ব হওয়া উচিত ৪ ইঞ্চি। প্রতি বর্গ মিটারে ৩৩ থেকে ৩৫টি গাছ রাখা উচিত। রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে প্রতি বিঘাতে ২.৭ কেজি নাইট্রোজেন, ফসফেট ৫.৪ কেজি, পটাশ ৫.৪ কেজি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বীজ বোনার ৩০ থেকে ৪০ দিন পর ২০ গ্রাম ইউরিয়া সারের জলীয় দ্রবণ প্রতি লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। এই চাষ করে বিঘা প্রতি ১২০ থেকে ১৫০ কেজি ফলন পেতে পারেন কৃষকরা।
কলাই জমিতে লাগানোর পর থেকে ৮০ থেকে ৮৫ দিনে ফসল তোলা যায়। ফসল তুলতে দেরি হলে কলাই ঝরে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। একারণে সঠিক সময়ে ফসল তুলতে হবে। এ ব্যাপারে কোচবিহার সদর মহকুমা কৃষি আধিকারিক গোপালচন্দ্র বর্মা বলেন, অনেক কৃষক এখন আর কলাই চাষে আগ্রহ দেখান না। কিন্তু সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি মেনে চাষ করলে লাভবান হবেন কৃষকরা। স্থানীয় বাজারে কলাইয়ের চাহিদা ভালো। তাই বিক্রির জন্য তাঁদের আর বাইরের বাজারের ভরসায় থাকতে হবে না। কলাই চাষ করলে জমির উর্বরতাও অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। ফলে পরবর্তী চাষের ক্ষেত্রে খরচও খানিকটা কম হয়। এছাড়া চাষিরা নিজেরাও ডালশস্য হিসেবে কলাই ব্যবহার করতে পারেন।