রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
করোনার মোকাবিলায় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সিনেমা হল বন্ধ অথচ বাংলা ছবি মুক্তির ক্ষেত্রে ওটিটি রিলিজেও তেমন সারা মিলছে না। সিনেমা হলের সঙ্গে যুক্ত অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান প্রশ্নচিহ্নের মুখে। কিছুদিন আগেই ‘মাল্টিপ্লেক্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’ প্রেস বিবৃতি দিয়ে সিনেমা হল বন্ধ রাখার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ জানিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কেউ বলছেন অপেক্ষা করতেই হবে তো কেউ আবার সিনেমা হল খোলার পক্ষে। সম্প্রতি টলিউড ফ্রন্টম্যান প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘নিরন্তর’ মুক্তি পেয়েছে টিভিতে। আবার তাঁরই অভিনীত কাকাবাবু সিরিজের পরের ছবি পুজোয় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা। প্রসেনজিতের পরামর্শ— মন শক্ত করতে হবে। তাঁর কথায়, ‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে সিনেমার ভবিষ্যৎ কী সেটা বলা খুব কঠিন। সিনেমার পাশাপাশি আরও অনেক ইন্ডাস্ট্রি করোনার থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত। যাত্রা, নাটক, বিভিন্ন শো। দর্শক হলে গেলেই তো একটা ছবি সফল হয়। তেমনই এখন মানুষের সুরক্ষাটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের তো এগতেই হবে। সুরক্ষাবিধি মেনেই কাজ করতে হবে। আমার তো মনে হয়, আগামী তিন-চারটে মাস আমাদের মন শক্ত করে ধৈর্য ধরে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। কোনও না কোনও সমাধান সূত্র নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে।’
লকডাউনের আগেই লন্ডনে ‘বাজি’র শ্যুটিং সেরে কলকাতায় ফিরেছিলেন জিৎ। ‘ঠিক কীভাবে এই ভাইরাসের মোকাবিলা সম্ভব সেটাই তো এখনও পরিষ্কার নয়। ধীরে ধীরে সবই খুলে দেওয়া হচ্ছে। আর অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্য সেটা করতেই হবে। কিন্তু সিনেমা হল খুললেও ব্যবসা আগের তুলনায় কমে যাবে। তাই ক’জন প্রযোজক তাঁদের ছবি রিলিজ করতে চাইবেন?’ প্রশ্ন ইন্ডাস্ট্রির ‘বস’-এর। ‘বাজি’র এখনও অনেকটা শ্যুটিং বাকি। তাই এই পরিস্থিতিতে পুজোয় রিলিজ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই তাঁর। তবে তিনি যে সিনেমা হল খোলার পক্ষে, সে কথাও স্পষ্ট জানাচ্ছেন জিৎ। ‘সিনেমা হল খুললে ভালোই হয়। সুরক্ষা বিধি মেনে যখন সবকিছুই ছন্দে ফিরছে, তাহলে সিনেমা হল কী দোষ করল,’ মন্তব্য তাঁর। আনলক পর্বে টালিগঞ্জে ‘এসওএস কলকাতা’র হাত ধরে ছবির শ্যুটিং শুরু হয়েছিল। ছবির অন্যতম অভিনেত্রী তথা সাংসদ মিমি চক্রবর্তীকে কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির টেকনিশিয়ানদের কথা ভাবাচ্ছে। ‘আমরা কাজ না করলে অগণিত টেকনিশিয়ানদের সংসার চলবে না। একইভাবে কাজ না করলে আমরাও পারিশ্রমিক পাব না। তাই কাজ বন্ধ করলে চলবে না।’ পাশাপাশি মিমি মনে করিয়ে দিতে চাইছেন,‘আমরা যদি চাই যে টলিউড স্তব্ধ না হয়ে যাক, তাহলে সুরক্ষাবিধি মেনে আমাদের প্রত্যেককে একটু দায়িত্ব নিতে হবে। আর তাতেই সমস্যা কমবে। তাই শরীর খারাপ হলে বা করোনা উপসর্গ দেখা দিলে আগেভাগে প্রযোজনা সংস্থাকে জানানো উচিত। কারণ ভুলে গেলে চলবে না যে, একজনের সঙ্গে এতগুলো মানুষের জীবন জড়িয়ে।’ আর সিনেমা হল খোলা উচিত কি উচিত নয়, সেই সিদ্ধান্ত আপাতত সরকারের উপরেই ছেড়ে দিতে চাইছেন মিমি।
অন্যদিকে ‘নিউ নর্মাল’-কে মাথায় রেখেই ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ তাদের ঘুঁটি সাজাচ্ছে। সংস্থার বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তির অপেক্ষায়। তার মধ্যেই দর্শকদের কথা ভেবে সংস্থা তাদের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’তে রিলিজ করছে ‘ডিটেকটিভ’ ছবিটি। কিন্তু সিনেমার শ্যুটিংয়ের পরিস্থিতি এখন ঠিক কীরকম? এসভিএফ-এর অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনি বললেন, ‘সবাই জানে এই ভাইরাস রাতারাতি চলে যাবে না। ফলে আমাদের এগতেই হবে। এখন কম সংখ্যক লোক নিয়ে মূলত ইন্ডোর শ্যুট সারতে হচ্ছে। এভাবে ধারাবাহিক এবং ওয়েব সিরিজের শ্যুটিং শুরু করা গেলেও সিনেমার জন্য আমাদের আরও লোকবল প্রয়োজন। আগামী মাসে গোলন্দাজ-এর শ্যুটিং নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
ইন্ডাস্ট্রির পরিচালকরা অবশ্য ‘ধীরে চলো’ নীতিতেই বিশ্বাসী। সিনেমা হল খোলা নিয়ে এখনই তড়িঘড়ি করা হোক চাইছেন না পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। গত মার্চ মাসে লকডাউনের আগেই তাঁদের সংস্থা প্রযোজিত ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ মুক্তি পায়। এছাড়াও এই বছর তাঁদের আরও তিনটি ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সবই বদলে দিয়েছে। শিবপ্রসাদের কথায়, ‘সংক্রমণ যদি বাড়তে থাকে তাহলে আমার মতে, এখন সিনেমা হল না খোলাই উচিত। আমি জানি, এই পরিস্থিতিতে হল মালিকরা বা টেকনিশিয়ানরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু একটা বৃহত্তর স্বার্থে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।’ কিছুটা একইরকম মত পোষণ করছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। ফোনে বলছিলেন, ‘দেখুন, বিশেষজ্ঞরা লাগাতার কাজ করছেন। মানুষের যাতে ভালো হয়, তাঁরা সেটাই করছেন। জিম খুলেছে মানে কাল হয়তো সিনেমা হলও খুলবে। কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? আজকে শপিং মলেও কি মানুষ আগের মতো ভিড় করছেন?’ সিনেমা হলের কথা মাথায় রেখেই সরকারের কাছে রাজের আবেদন, ‘অনেকেই শুনছি বেতন দিতে পারছেন না। সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়ালে খুব ভালো হয়।’
আর এই রকম পরিস্থিতিতে কী ভাবছেন সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ? প্রিয়া এন্টারটেনমেন্টের কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত বেশ চিন্তিত। বলছিলেন, ‘সিনেমা হল খুললেই ছবি থাকবে কিনা বা দর্শক আসবে কিনা, এটাই তো এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সত্যি বলতে আমরা আর লোকসানের বোঝা বইতে পারছি না। সরকারের কাছে আমরা ট্যাক্স কমানো ও সার্ভিস চার্জ সম্পর্কিত কতগুলো অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু এখনও কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যায়নি।’ এই প্রসঙ্গেই ইম্পার (ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন) কোষাধ্যক্ষ শান্তনু রায়চৌধুরী বললেন, ‘খুবই কঠিন পরিস্থিতি। তবে সিনেমা হল নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা চলছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি একটা পথ বেরিয়ে আসবে।’ অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্যের পরিবেশকদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ চওড়া হচ্ছে। লকডাউনের আগে রাজ্যে ‘আংরেজি মিডিয়াম’ হিন্দি ছবিটির পরিবেশনার দায়িত্বে ছিলেন শতদীপ সাহা। ‘দুঃখের খবর লকডাউনের মধ্যেই রাজ্যের বেশকিছু সিঙ্গল স্ক্রিন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেল। অবাক লাগছে সিনেমার শ্যুটিং শুরু হলেও সেই ছবি দেখানোর জন্য সিনেমাহল নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাচ্ছেন না। সুরক্ষাবিধি মেনে যদি বেসরকারি বাস চলতে পারে, ট্যাক্সি চলতে পারে তাহলে সিনেমা হল কেন বন্ধ থাকবে বুঝতে পারছি না,’ সাফ কথা শতদীপের। বোঝাই যাচ্ছে, এক মারাত্মক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলার বিনোদন জগৎ। আগামী দিনে কী হতে চলেছে কেউই তার সদুত্তর দিতে পারছেন না। সিনেমা হলের ভাগ্যে কী লেখা রয়েছে তা জানতে উদগ্রীব প্রত্যেকেই।