অভিনন্দন দত্ত, কলকাতা: করোনা ভাইরাসকে দূরে রাখতে সোমবার থেকে রাজ্যে জারি হয়েছে লকডাউন। বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়েছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতি। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উপদেশ মেনে সামাজিক দূরত্ব অভ্যাস করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষ একাকিত্ব বা অবসর যাপনের জন্য বই ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উপরেই বেশি ভরসা করছেন। এমতাবস্থায় গড়পড়তা বিনোদনের সংজ্ঞাও যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় খোঁজখবর করে জানা যাচ্ছে, মানুষ এই সময় বাড়ি বসে বেশি করে ভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ক সিনেমা, ওয়েব সিরিজ বা তথ্যচিত্রগুলিই দেখতে পছন্দ করছেন। হোয়াটসঅ্যাপেও ফরওয়ার্ড করা হচ্ছে এই সংক্রান্ত ছবির লম্বা লিস্ট।
এখন প্রায় লোকের মুখে মুখে ঘুরছে স্টিভেন সোডরবার্গ পরিচালিত ‘কন্টাজিয়ন’ (২০১১) ছবির নাম। আমেরিকায় এক অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়েই এই ছবি। করোনা ভাইরাসের মতো এই কাল্পনিক ভাইরাসও ছোঁয়াচে, তার মারণ ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে, উঠে আসছে জন স্যুটস পরিচালিত ‘প্যান্ডেমিক’ (২০১৬) ছবির কথা। লস অ্যাঞ্জেলসে এক মারণ ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সুস্থ নাগরিকদের উদ্ধার করতে তৈরি হয় একটি বিশেষ দল। এছাড়াও নেটিজেনদের পছন্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক কিম সাং সু’র ছবি ‘দ্য ফ্লু’ (২০১৩)। এইচ ফাইভ এন ওয়ান নামক এক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। ত্রাণের ভূমিকায় নেই কোনও প্রতিষেধক।
এ তো গেল কল্পকাহিনীর কথা। বাস্তব এপিডেমিকের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছে ডকু সিরিজ ‘প্যান্ডেমিক: হাউ টু প্রিভেন্ট অ্যান আউটব্রেক’। প্রথম সিজনের ছ’টি এপিসোডে মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ইবোলার মতো একাধিক মহামারীর মোকাবিলার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি গোষ্ঠী সংক্রমণ ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপরেও আলোকপাত করেছে এই সিরিজ। রয়েছে বিবিসি’র তথ্যচিত্র ‘করোনা ভাইরাস: লাইফ ইনসাইড চায়নাজ লকডাউন’। নিঃসন্দেহে তালিকাটি দীর্ঘ। কিন্তু তার মধ্যেই উঠে আসছে ‘আউটব্রেক’ (১৯৯৫), ‘টুয়েলভ মাঙ্কিস’ (১৯৯৫), ‘টোয়েন্টি এইট ডেজ লেটার’ (২০০৩) ও ‘কার্গো’র (২০১৭) মতো একাধিক ছবির নাম। এমনকী মানুষ নতুন করে পড়ছেন নোবেলজয়ী লেখক অ্যালবের কামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’ (১৯৪৭), গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজের উপন্যাস ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯৮৮) ও ডিন কুন্তজের থ্রিলার ‘দ্য আইস অব ডার্কনেস’ (১৯৮১)।
কলকাতার ছেলে শিলাদিত্য সেন গত দশ বছর ধরে বলিউডে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। বললেন, ‘কলকাতার তুলনায় মুম্বইয়ের অবস্থা এখন বেশ খারাপ। আমাদের পরিচালক মহলে তো এখন শুধু এই ধরনের ছবি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজেও বাড়ি বসে বেশ কয়েকটি ছবি দেখে ফেলেছি।’ তবে এই বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করছেন না হায়দরাবাদের আইটি কর্মী তন্ময় দাস। তাঁর কথায়, ‘গৃহবন্দি হয়ে পছন্দের ওয়েব সিরিজ ও সিনেমা বেশিরভাগ আইটি কর্মী দেখছেন। তবে তার মধ্যে একটা বড় অংশ অবশ্যই এই ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে মেতেছে। আমাদের প্রজন্মের কাছে এমন মহামারী নতুন বিষয় এবং সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ আরও সচেতন হতে চাইছেন।’ গৃহবন্দি অবস্থায় মানুষ যখন একমুঠো খুশির খোঁজে, তখন কেন তাঁদের দৈনন্দিন বিনোদনের উপর প্রভাব ফেলছে ভাইরাস সংক্রমণ? এই প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেবাঞ্জন পানের বক্তব্য, ‘আসলে মানুষের মধ্যে একটা ভয় দানা বেঁধেছে। কারণ এখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় মানবজাতির লড়াইয়ের শেষটা কারও জানা নেই। তাই মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে এর থেকে পরিত্রাণের বিকল্প উপায় খুঁজছেন।’ মুক্তির পথ বাতলে না দিতে পারলেও এই কঠিন সময়ে মানুষের মধ্যে আশার আলোর সন্ধান দিতে যে এই ধরনের ছবিগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।