অদিতি বসুরায়: গায়ের রং, মাথার চুল, উচ্চতা এসব নিয়ে ভারতবর্ষের আম-জনতার মাথাব্যথার শেষ নেই। এখনও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চেহারার চাকচিক্য নিয়ে বেজায় ভাবিত। ফেয়ারনেস ক্রিমের বাজার খেয়াল করলেই এই তথ্যের সত্যতা সামনে আসবে।‘পহেলে দর্শনধারী, পিছে গুণবিচারি’ যে সমাজের আপ্তবাক্য হতে পারে, সেখানে একটি কালো গাত্রবর্ণের শিশুকে ‘কালী’ বলে ডাকাটা একেবারে সাধারণ ঘটনা। টাকমাথার লোককে নিয়ে তো রীতিমতো মজা করে বন্ধু-বান্ধব থেকে অফিসের সহকর্মী পর্যন্ত। এসব ব্যাপারে আমাদের হৃদয়-হীনতা সীমাহীন। ফলে আদালতে দাঁড়িয়ে শ্যামলা আইনজীবীকেও আমরা ছাড় দিই না। বডি-শেমিংয়ের বিপক্ষে সওয়াল করতে গেলে তাঁকে শুনতে হয় ব্যাপারটা তিনি ‘পার্সোনালি’ নিচ্ছেন বলে। এসব অবশ্য নতুন কিছু নয়। অভিনব যেটা, তা হল পরিচালক অমর কৌশিকের বক্তব্য। সেই ‘জুতা আবিষ্কার’-এর তত্ত্ব। দুনিয়াকে আমরা বদলাতে চেষ্টা করব না। নিজেকে বদলাতে হবে। আগে নিজেই নিজেকে সমস্ত ত্রুটিসহ গ্রহণ করা শিখতে হবে। তবেই অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। একই বিষয় নিয়ে মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আর একটি হিন্দি ছবি রিলিজ করেছে। সেই ছবিকে, ‘বালা’ প্রায় দশ গোল দিয়েছে নিশ্চিত। ট্রিটমেন্ট থেকে লুক – সবকিছুই অসামান্য। সংলাপের ধারও তীক্ষ্ণ। ছবির ইমারতকে চমৎকার সঙ্গত করেছেন আয়ুষ্মান খুরানা, ইয়ামি গৌতম, ভূমি পেডনেকর, সৌরভ শুক্লা, জাভেদ জাফরি। বালার চরিত্রে আয়ুষ্মানের লুক থেকে বডি-ল্যাংগুয়েজ – অনবদ্য। লতিকা হিসেবে ভূমির তুলনা নেই। বালা কেবল একজন কেশহীন পুরুষের গল্প বলে না, বেশ কিছু জরুরি প্রশ্নও তুলে ধরে। বালা শিশুকাল থেকেই চেহারা নিয়ে অবসেসড। নিজেকে ‘কানপুরের শাহরুখ খান’ বলে মনে করে সে। তাই পঁচিশ বছর বয়সে যখন তার মাথা ফাঁকা হয়ে আসে, সে প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। অজস্র ওষুধ, টোটকা, জড়িবুটি সবই ফেল করায় সে হেয়ার-ট্রান্সপ্লান্টের জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু ডায়াবেটিস থাকায় সে রিস্কও নেওয়া সম্ভব হয় না বালার পক্ষে। সহপাঠী লতিকার সঙ্গে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। তার প্রধান কারণ, লতিকা ফর্সা নয় এবং ফর্সা নয় বলেই তাকে সুন্দরী বলে না কেউ। অথচ দারুণ মেধাবী সে। আইনজীবী হিসেবেও তার নামডাক ছড়িয়েছে। বালা এহেন লতিকার শরণাপন্ন হয় স্ত্রীর সঙ্গে সমস্যার জেরে। বডি-শেমিংয়ের সঙ্গে এবার উঠে আসে আর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— স্বামী নিজের টাকমাথা লুকিয়ে বিয়ে করলে, তাকে চিটিং বলা যাবে কি যাবে না! পুরুষতন্ত্র কখনওই স্ত্রীর চেহারা লুকিয়ে বিয়ে করাকে সমর্থন করে না। ছেলের বাড়ির লোক ভাবী কনেকে হাঁটিয়ে, চুল খুলিয়ে, মুখে হাত বুলিয়ে যেখানে পরিবারের বধূ নির্বাচন করে, সেখানে মেয়েরাই বা কেন এই জিনিস মেনে নেবে? ছেলেদের যেমন স্বপ্ন থাকে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার, তেমনই মেয়েরাও নিশ্চিতভাবেই চাইতে পারে সুদর্শন স্বামী। এবার সেই শারীরিক কাঠামো দিয়ে বা গায়ের রং দিয়ে বা মাথার চুল দিয়ে মানুষকে বিচার করা উচিত কি না – তা অন্য প্রশ্ন। এবং সেই প্রশ্ন উঠলে, তার উত্তর দ্বিধাহীনভাবে হবে- কখনওই মানুষকে চেহারা দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। আগে প্রয়োজন নিজেকে নিয়ে লজ্জা না পাওয়া। বালার বাথরুমের আয়নার ওপরের অংশ একটা সেলোটেপ দিয়ে আটকে দেওয়া আছে, কারণ সে নিজেই নিজেকে টেকো দেখতে চায় না। তাই ছবির শেষে, বালার স্ত্রী যখন প্রশ্ন করে, যে নিজেই নিজের কেশহীন মাথা দেখতে চায় না, তাহলে সে কি আশা করতে পারে, যে অন্যরা তাকে সুনজরে দেখবে? আমাদের নিরুত্তর থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। আমরা পাকা চুল লুকিয়ে ফেলি, বলিরেখা পড়লে কুণ্ঠিত বোধ করি, মেদ বাড়লে নিজেরাই নিজেকে গাইগরু তকমা দিই, হাইহিল পড়ে উচ্চতা বাড়িয়ে ফেলি, ফোটোশপ করে মসৃণ গাল আর চিকন চামড়ার ছবি পোস্ট করি সোশ্যাল মিডিয়ায় আর দিনের শেষে মানবজন্মের সাফল্য উদযাপন করি লাইক আর কমেন্টের সংখ্যা দিয়ে। না – এভাবে হয় না। নিজেকে নিজে নির্দ্বিধায় সঙ্গে নিন। তারপর বাকি দুনিয়া কী করে দেখুন! চলুন, লেটস গো!