পুজোর আর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক বাকি। করোনার আতঙ্ক থাকলেও সেই চোখরাঙানি কাটিয়ে আনলক পর্বে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে জনজীবন। পুজোর মুখে খুলে যাচ্ছে সিনেমা হল। টলিউডে খুশির হাওয়া বইলেও মুখ ভার করে বসে বাংলার সঙ্গীতজগৎ। এমনিতেই স্বর্ণযুগের মতো পুজোর গানের সেই ক্রেজ আর নেই। তবুও পুজোর সময়টা দেশে-বিদেশে ব্যস্ততায় কাটত শিল্পীদের। এই বছর করোনা থাবায় সেটাও হচ্ছে না। কী ভাবছেন বাংলা গানের তারারা, জানার চেষ্টা করলেন অভিনন্দন দত্ত।
 অনুপম রায়
গান: একটাই গান, তবে সেখানে চমক আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দুশো বছরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তৈরি এই বিশেষ গানের কথা ও সুর অনুপমের। নাম ‘মাইকেল-বিদ্যাসাগর সংবাদ’। মাইকেলের ভূমিকায় অনুপম ও বিদ্যাসাগরের ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
কী বলছেন? প্রতি বছরই পুজোর গান একটু একটু করে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। বাংলার শিল্পীরা অনেকাংশেই লাইভ অনুষ্ঠানের উপর নির্ভর করেন। এই বছর করোনার জন্য সবকিছু অনিশ্চিত। ফলে আমাদের সকলকেই ভুগতে হচ্ছে। আর্থিক বাধাটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলার টাকা কই? অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ আরও শক্ত না হলে বাংলা গানের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হবে। অর্থনৈতিক সাপোর্ট থাকলে তবেই শিল্প বেঁচে থাকে।
 রূপঙ্কর
গান: এই বছর বেশ কয়েকটি গান রয়েছে। সুদীপ্ত চন্দর লেখা অরুণাভ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ট্রাভেল সং ‘চলো হারাই’। ‘সময় থমকে দাঁড়ায়’ গানটির সুরকার শিলাদিত্য ও রাজ। জয় সরকারের সুরে শুভমিতার সঙ্গে একটা ডুয়েট। নিজের কম্পোজিশনে একক গান ‘আমি আসব’।
কী বলছেন? পুজোর গান এখন অনলাইনে মুক্তি পায় বলে তার সঙ্গে করোনার প্রত্যক্ষ যোগ নেই। বরং লকডাউনে মানুষ বেশি করে ডিজিটালের দিকে ঝুঁকেছেন। তবে যা পরিস্থিতি তাতে সঙ্গীতশিল্পীরা আর কিছুদিনের মধ্যেই না খেতে পেয়ে মারা যাবেন। আমি হয়তো কষ্ট করে চালিয়ে নেব। কিন্তু অনেক শিল্পীই আছেন, যাঁরা শুধু বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারেন, কনসার্ট করেন। হয়তো শিল্পের খাতিরে লেখাপড়াটাও ঠিক মতো শেষ করে উঠতে পারেননি। তাঁরা এখন কোথায় যাবেন সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন।
 মনোময় ভট্টাচার্য
গান: একটাই গান রেকর্ড করছেন। অনিন্দ্য বসুর সঙ্গীতায়োজনে ‘জানে মন’।
কী বলছেন? দীর্ঘদিন ধরে পুজোর গান করছি বলে ওই নস্ট্যালজিয়া থেকেই চেষ্টা করি প্রতিবছর শ্রোতাদের অন্তত একটা গান শোনাতে। এবারেও সেই চেষ্টাই করেছি। আসলে করোনার জন্য শিল্পীরা একদম কোণঠাসা। পুজোর আগে বেশিরভাগ শিল্পীর হাতে কাজ নেই। তাই পুজোর গানটা হবে কীভাবে? আমি দীর্ঘ ১৬ বছর পর পুজোয় এবার কলকাতায় থাকব! কিছু অনলাইন কনসার্টের কথাবার্তা চলছে। সেখান থেকে আমার সহযোগী শিল্পীদের কিছুটা সাহায্য করব। তবে অনলাইন কনসার্টে কি আর মঞ্চের মজা পাওয়া যায়!
 লোপামুদ্রা মিত্র
গান: পুজোর গান রেকর্ড করছেন না।
কী বলছেন? শুধু পুজোর গান নয়, দিনে দিনে বাংলা গানের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। প্রবীণ শ্রোতারা অনলাইন গান সম্বন্ধে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। নবীন শ্রোতারা অবশ্য টেক স্যাভি। আর বাংলা রেডিও চ্যানেলগুলোও আমাদের গান নিয়ে অদ্ভুতভাবে উদাসীন। সেই তুলনায় পাঞ্জাবি, তামিল, তেলুগু মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে শিল্প বেশিদিন বাঁচে না। সবার একটাই অভিযোগ ‘টিআরপি নেই!’ ফলে আমারও অভিমান বেড়েছে। কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা চক্রবর্তীরা যেমন একটা সময় এইরকম পরিস্থিতি সামাল দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেইরকম কোনও পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে আগামী প্রজন্ম তো আর বাংলা গান গাইবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। ভাষার মতো হয়তো একদিন বাংলা গানও হারিয়ে যাবে।
 ইমন চক্রবর্তী
গান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এ কী লাবণ্যে পুণ্য প্রাণ’। গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেছেন শিল্পী নিজেই।
কী বলছেন? জনপ্রিয়তা হারালেও আমার মনে হয়, পুজোর গানের অল্প বিস্তর একটা চাহিদা রয়েইছে। কোভিড মহামারী শিল্পীদের বিশাল ক্ষতি করেছে। হাতে একদম কাজ নেই। তার উপর সরকারও এই শিল্পীদের জন্য কিছু করছেন না। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে তাঁরা আর পুজোর গান তৈরি করবেন কীভাবে? শিল্পীরা তাঁদের দায়বদ্ধতা থেকে চেষ্টা করলেও শ্রোতারা কতটা মনোযোগী, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটার একটু অন্যরকম সঙ্গীতায়োজন করেছি বলে ইউটিউবে যে ধরনের কমেন্ট লেখা হচ্ছে, তা দেখে আমি হতাশ। তাই মনে হচ্ছে কাদের জন্য আর গান গাইব!
 রাঘব চট্টোপাধ্যায়
গান: ‘পরম্পরা’। শিল্পীর মেয়ে আনন্দী এই গানে বাবার সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছে। সঙ্গীতায়োজনে ছোট মেয়ে আহিরী।
কী বলছেন? পুজোর গান তো অনেকটা নতুন জামার মতো। এখন হাতে গোনা শ্রোতাই পুজোর গানের প্রত্যাশা করেন। তাঁদের জন্যই আমাদের এই প্রয়াস। এ বছর করোনাই যেন সব লন্ডভন্ড করে দিল। বাঁচার প্রশ্নই এখন সবার আগে। নিজে বাঁচলে তবে তো মানুষ বিনোদনের কথা ভাববে। তাই পয়সা খরচ করে গান শুনবেন, এ আশা এখন দুরাশা। তবুও নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ এখনও হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে গান কেনেন। সত্যি বলতে আমরা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এখন মানুষ চিঠি না লিখে হোয়াটসঅ্যাপ করেন। তাই বাংলা গানকে বাঁচাতে হলে চাই একটা নতুন পরিবর্তন। তবুও বাংলা গানের স্বর্ণযুগ ফিরবে কিনা সেই সন্দেহ থেকেই যাবে।