অভিনন্দন দত্ত: অতীতকে বুকে আগলে বাঁচতে চায় কেউ, তো আবার কেউ বাঁচতে চায় সুরক্ষিত ভবিষ্যতের আশায়। আর এই অতীত ও বর্তমানের দ্বন্দ্ব সুজিত সরকার পরিচালিত ‘গুলাবো সিতাবো’র ভিত্তি তৈরি করেছে— লখনউয়ের প্রেক্ষাপটে তৈরি এক সোশ্যাল স্যাটায়ার, যার হাস্যরসের শিকড় লুকিয়ে রয়েছে মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে।
লখনউয়ের এক শতাব্দী প্রাচীন হাভেলি ‘ফতিমা মহল’-এর মালিক মির্জা (অমিতাভ বচ্চন)। এই বাড়িতেই পরিবার নিয়ে বাস করে বাঁকে রাস্তোগি (আয়ুষ্মান খুরানা)। ছবির শুরু থেকেই বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের লড়াই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাসিক তিরিশ টাকা ভাড়াও দিতে পারে না বাঁকে। পৈতৃক আটা কলের ব্যবসা মা ও তিন বোনকে নিয়ে বাঁকের মিলিত সংসারের অনটন ঘোচাতে পারে না। উল্টো দিকে বাড়ির পুরনো আসবাব লুকিয়ে বিক্রি করে দিন চলে মির্জার। নিজের থেকে সতেরো বছরের বড় তাঁর বেগম প্রায় শয্যাশায়ী। বাড়ির সমস্ত ভাড়াটে বিশেষ করে বাঁকের সঙ্গে ঝামেলাই যেন বৃদ্ধের দৈনন্দিন রুটিনের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে। আর ভাড়াটে উচ্ছেদের চক্করে ইতিমধ্যে বাড়িতে পুরাতত্ত্ব বিভাগের আধিকারিক ও উকিলের আনাগোনা বাড়তে থাকে। জমে ওঠে দু’পক্ষের লড়াই। লোভ, ক্ষমতা ও স্বার্থপরতার এক বিরাট খেলার হাতের পুতুলে পরিণত হয় বাড়ির চরিত্ররা।
এই ছবি দেখতে হবে অমিতাভ-আয়ুষ্মানের অভিনয়ের স্বাদ নিতে। ঝগড়ুটে, বাতিকগ্রস্ত আর মোটের উপর হাভেলি-প্রেমীর চরিত্রে অমিতাভের অভিনয় অনবদ্য। মাথায় টুপি, মোটা চশমা, প্রস্থেটিক্সের নাক আর গাল ভর্তি দাড়ি নিয়ে এই অমিতাভ বচ্চনকে চেনা কষ্টকর। তাঁকে এখানে মির্জা হিসেবেই পাবেন দর্শক। আপনাকে সকলে কেন ঘৃণা করে, এই প্রশ্নের উত্তরে যখন মির্জা বলে ‘কই, আমার তো তা মনে হয় না।’ তখন চরিত্রটার উদ্দেশ্য যেন আরও স্পষ্ট হয়। সাতাত্তরের ছ’ফুট দু’ইঞ্চির মানুষটা পুরো ছবি জুড়ে কীভাবে কোমর বেঁকিয়ে অভিনয় করে গেলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বলতেই হচ্ছে ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা ফ্রেম শাসন করেছেন তিনি। চিত্রনাট্যকার জুহি চতুর্বেদীর সাফল্য এখানেই যে তিনি ‘পিকু’র ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই ছবির মির্জাকে গুলিয়ে ফেলেননি। অন্যদিকে আয়ুষ্মানের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রত্যাশা মতোই তিনি নিরাশ করেননি। কিন্তু অমিতাভের মতো চমকেও দিতে পারেননি। আসলে সাম্প্রতিক অতীতে দর্শকের সামনে তিনি যেন একটু বেশিই সহজলভ্য হয়ে গিয়েছেন। পুরাতত্ত্ব বিভাগে অফিসার শুক্লার চরিত্রে বিজয় রাজ ও উকিল ক্রিস্টোফরের চরিত্রে বিজয়েন্দ্র কালা অসাধারণ। ছোট ছোট চরিত্রে সৃষ্টি শ্রীবাস্তব (গুড্ডু) বা ফারুখ জাফরের (বেগম) অভিনয় ছবিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
ছবিতে ডিওপি অভীক মুখোপাধ্যায়ের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে এক্সপেরিমেন্ট মন্দ নয়। যার ফলে লখনউ শহর এবং পুরনো বাড়িটি যেন ছবির স্বতন্ত্র দুই চরিত্র হয়ে উঠেছে। শান্তনু মৈত্র, অনুজ গর্গ ও অভিষেক আরোরার সঙ্গীত ছবির কিছু দৃশ্যকে অত্যন্ত উপভোগ্য করে তুলেছে। তবে ছবির গতি অত্যন্ত ধীর। মাঝেমধ্যেই তা বিরক্তির কারণ হয়েছে। কিন্তু গতিশীল শহরে থমকে যাওয়া একটা পুরনো বাড়ির সদস্যদের পরিস্থিতি বোঝাতেই হয়তো সুজিতের এই কৌশল অবলম্বন। তাছাড়া চিত্রনাট্যের বুনোট দ্বিতীয়ার্ধে আলগা হয়েছে। ‘গুলাবো সিতাবো’ হয়তো দর্শকের মনে হাসির ফোয়ারা ছোটাবে না। কিন্তু এই ছবি অবশ্যই তাঁদের ভাবাবে। ঐতিহ্যের অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ ও তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করবে। আসলে সব স্যাটায়ারের শেষটা তো ভালো নাও হতে পারে। আর সেখানেই এই ছবির সার্থকতা।