বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
ব্যক্তির মানসিক ক্রিয়ার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। একজন অপরাধ কেন করবে, তা বোঝার জন্য ব্যক্তির জিন ও মস্তিষ্ক খুব গুরুতর ভূমিকা পালন করে। কেউ অপরাধ করবে, কেউ সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাবে। কার প্রকৃতি কেমন হবে, তার জন্য বায়োলজিক্যালি অবশ্যই মস্তিষ্ক দায়ী। তবে এর সঙ্গে অনেকটাই সেই ব্যক্তির পরিবেশ, তার বেড়ে ওঠার শিক্ষা, ধরন ও চারপাশের দায়ভারও আছে।
অপরাধ প্রবণতার প্রকার
সাধারণত, অপরাধীরা দুই ধরনের হয়ে থাকে—
১. কেউ ভীষণই ইমপালস বা ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে কিছু করে ফেলে। একে বলে ‘ইমপালসিভ অ্যাক্ট’। এই ধরনের ঝোঁকের পুরোটাই আবেগ থেকে আসে। চারপাশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি ও ঘৃণার সম্মিলিত একটি আবেগের তরঙ্গ তার মন ও মাথাকে কব্জা করে ফেলে। সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে ও কুকর্মটি করে ফেলে। তবে এই আবেগে লোভেরও একটা প্রকট স্থান আছে। অনেকের মধ্যে লোভের তরঙ্গ এত বেশি থাকে, যে তারা এই লোভকে জয় করতে না পেরেই কাজটি করে ফেলে। চুরি বা শপ লিফটিং (দোকানের পণ্য চুরি)-এর বেলাতেও এই ইমপালস কাজ করে।
২. এক ধরনের অপরাধী থাকে, তারা অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। এটা এক ধরনের স্বভাবদোষ। ছোটবেলা থেকেই এদের ব্যবহারে একটা বিশেষ প্রকৃতি লক্ষ করা যায়। এতে অনেক সময় বোঝা যায়, এই ব্যক্তি পরবর্তীকালে তার চারপাশের লোকজন বা পরিবারকে বেশ বেগ দেবে। এদের ক্ষেত্রে ইমপালস বা ঝোঁকের চেয়ে ঠান্ডা মাথায় অপরাধ করার প্রবণতা বেশি। এদের মধ্যে অপরাধের পরিণাম সংক্রান্ত কোনওরকম ভয়, উদ্বেগ, আতঙ্ক কাজ করে না। অর্থাৎ এরা অপরিণামদর্শী হয়। তাই এরা যখন অপরাধ করে, তখন তাদের শরীরে কোনও চেক অ্যান্ড কন্ট্রোল মেথড কাজ করে না। ফিয়ার সিস্টেমও কাজ করে না। করলেও থাকে তলানিতে। সাধারণ মানুষের বেলায় অপরাধ করার সময় বুক ধড়ফড়, ঘাম হওয়া, গলা শুকিয়ে আসা ইত্যাদি বিচলন আসে। এই ধরনের অপরাধীদের বেলায় সেসব খুব একটা থাকে না। তাই পুলিসের জালে ধরা পড়ার পরেও তারা নিরুত্তাপ থাকে। কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় না।
কারা বেশি ঝোঁকের মাথায় অপরাধ করে?
যারা রগচটা, কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে, মারামারি করে, অন্যের খুব ছোট কথা বা ভুলকে বিরাট করে ধরে তুমুল রাগ দেখায়, তারা অনেক সময়ই ঝোঁকের মাথায় চলে। আমাদের মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম ভয়, আতঙ্ক, আনন্দ, দুঃখ, হতাশা—এমন নানা অনুভূতির জন্ম দেয়। সেই অনুভূতির বশে আমরা কতটা কী করব, তা নির্ভর করবে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের নিয়ন্ত্রণের উপর। কারও কারও ক্ষেত্রে ফ্রন্টাল লোব এই কাজে ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ তাদের আবেগের তীব্রতার সঙ্গে পেরে ওঠে না ফ্রন্টাল লোব। তখনই অপরাধী জিতে যায়। দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ বা রাগ থেকে বড়সড় অন্যায় করে ফেলে সে। আবার এক শ্রেণী আছে, যাদের অনেকের মধ্যেই অন্যের ক্ষতি চাওয়ার বাসনা উঁকি মারে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফ্রন্টাল লোব তার পরিণাম, সামাজিক সমস্যা, শাস্তির ভয়, এমনকী কারও ক্ষতি করা যে ঠিক কাজ নয়, এই বার্তাও মনে করিয়ে দেয়। পরিণাম সংক্রান্ত একটা টেনশন, ভয়, চিন্তা কাজ করে। তার ভার এত বেশি হয় যে অপরাধের ইচ্ছেটাই চলে যায়। মোট কথা, আবেগ সকলেরই থাকবে। তবে তার বহিঃপ্রকাশের উপর নির্ভর করবে সে অপরাধী হবে কি না।
অপরাধের মনস্তত্ত্ব, অপরাধীর মন
অপরাধপ্রবণতা বা কারও অপরাধী হয়ে ওঠার নেপথ্যে শুধু বায়োলজিক্যাল কারণই কাজ করে না। এর নেপথ্যে মনস্তত্ত্বও বিরাট ভূমিকা পালন করে।
• শিশুকাল থেকে বাড়ির পরিবেশ বা চারপাশে হিংসা, মারামারি, খুনোখুনি দেখে বড় হলে অথবা পরিবারের ভিতরেই গার্হস্থ্য হিংসা দেখে বেড়ে উঠলে, সেই শিশুর মনেও অপরাধের বীজ ঢোকে। পরে মতের অমিল হলেই সে হিংস্র হয়ে যায়।
• বাড়ির পরিবেশ সারাক্ষণ বিষাক্ত হলে ও অল্পেই সবাই রাগারাগি করছে দেখলে শিশুটিও ধরে নেয়, রাগ ও অত্যাচারই একমাত্র পথ। ফলে সে রগচটা হয়ে অপরাধপ্রবণতার দিকে পা বাড়ায়।
• ছোট থেকে বঞ্চনা নিয়ে বড় হলেও একই সমস্যা হয়। একদল অনেক কিছু পাচ্ছে, আমি কিছুই পাই না, এই মনোভাব থেকেও অপরাধ করার প্রবণতা তৈরি হয়।
‘ইন বর্ন ক্রিমিনাল’ কথাটা ঠিক?
অনেক গুরুতর অপরাধীকেই ‘ইন বর্ন ক্রিমিনাল’-এর তকমা দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কয়েকজন অপরাধীর জিনগত গঠনেই এই অপরাধপ্রবণতা বা হিংসাত্মক হয়ে ওঠার রসদ লুকিয়ে রয়েছে। ‘জিনগত’ কথার অর্থ কিন্তু পুরোটাই বংশগত নয়। মানুষের জিনের সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশ ও মস্তিষ্ক। একে ‘জিন-এনভায়রনমেন্ট ইন্টার্যাকশন’ বলে। কারও জিনগত একটা প্রবণতা আছে, তাতে ইন্ধন জোগাল পরিবেশ, ফ্রন্টাল লোবও সামলাতে ব্যর্থ হল, এভাবেই মানুষটি অপরাধ করল। তবে অনেকের ক্ষেত্রে খুব ভালো পরিবেশ বা সৎসঙ্গ পেলে এই জিন খুব একটা ভিলেন হতে পারে না। রাগ বা অপরাধপ্রবণতাকে তারা অন্য খাতে বইয়ে দিতে পারে।
কোনও সৃজনশীল বা সেবামূলক কাজের মাধ্যমেও এই অপরাধপ্রবণতা সে দমিয়ে রাখতে পারে বা নির্মূল করে ফেলতে পারে। সেই কারণেই সংশোধনাগারে খুব ভালো মানুষ বা শিক্ষকের সংস্পর্শে এলে অনেকেই পুরোপুরি শুধরে যান।
পরিবারের ভূমিকা
যদি কেউ বোঝেন, তাঁর সন্তানের মধ্যে এই অপরাধপ্রবণতা রয়েছে, তাহলে অবশ্যই পরিবারকে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করতে হয়।
১. সেই শিশুর কাউন্সেলিং করানো যেতে পারে।
২. কোনও সৃজনশীল কাজে যাতে তার আগ্রহ বাড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
৩. শিশুর ভুল বা দোষে মারধর করা যাবে না। এতে ভিতরে হিংস্রভাব জন্ম নেবে।
৪. শিশুর আচার আচরণ ও সঙ্গের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তবে, গবেষণা বলে, কারও জিনগত কারণ অত্যন্ত প্রবল হলে তার অপরাধপ্রবণতা খুব একটা আটকানো যায় না। তাই অপরাধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই জেনেটিক বিষয়গুলি ইদানীং বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।