বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
চিনি খেলেই কি ডায়াবেটিস হয়?
না, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের যে অতিরিক্ত চিনি খেতে বারণ করা হয়, তার কারণ আলাদা।
ডায়বেটিকরা দিনে কতটা চিনি খাবেন?
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, ডায়াবেটিকরা সারা দিনে পাঁচ চা চামচ পর্যন্ত চিনি খেতে পারেন। তবে এই চিনির সমপরিমাণ শর্করা জাতীয় খাবার (কার্বোহাইড্রেট) সারা দিনের খাবার থেকে বাদ দিতে হবে। চিনি কিন্তু অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। আলাদাভাবে নয়। খাবারে সলিবল ফাইবার যথেষ্ট পরিমাণে (৩০-৩৫ গ্রাম প্রতিদিন) রাখলে তা চিনিকে রক্ত মিশতে বাধা দেয়। তাই ব্লাড সুগার চট করে বাড়তে পারে না।
মনে রাখবেন, নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি চিনি খেলে তা লিভারে গিয়ে ফ্যাটে পরিবর্তিত হয়। এর থেকে ফ্যাটি লিভার, ডায়াবেটিস সহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যাঁদের ডায়াবেটিস নেই, তাঁরা অতিরিক্ত চিনি খেলে ব্লাড সুগার তো বাড়ে না, কিন্তু তা লিভারে গিয়ে ফ্যাটে (ট্রাইগ্লিসারাইড) পরিবর্তিত হয়।
উন্নত দেশে, প্রতিটি লোকের দৈনিক কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের পরিমাণ কখনই মোট খাবারের মোট ক্যালোরির ৫০ শতাংশের বেশি হয় না। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেটে থাকে ৪ ক্যালোরি। সুতরাং রোজ আমাদের যত পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে, তার অর্ধেক করে সেই সংখ্যাকে ৪ দিয়ে ভাগ করলেই কত গ্রাম কার্বোহাইড্রেট আমরা খেতে পারব, তার হিসেব পাওয়া যায়।
ধরে নেওয়া যাক, কোনও ব্যক্তির দিনে ২০০০ ক্যালোরি দরকার। তার মধ্যে অর্ধেক অর্থাত্ ১ হাজার ক্যালোরিকে ভাগ করতে হবে চার দিয়ে। সুতরাং হিসেব মতো ওই ব্যক্তি ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত কার্বোহাইড্রেট খেতে পারেন।
ফ্রুট সুগারও কি ডায়াবেটিসের সমস্যা তৈরি করে?
হ্যাঁ। ফলের মধ্যে ফ্রুকটোজ থাকে। অনেকে বলেন, দিনে যত ফল খাওয়া যায়, তত ভালো। এই তথ্য সঠিক নয়। ডায়াবেটিস থাকলে সারাদিনে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত টাটকা ফল খাওয়া যেতে পারে। এর বেশি খেলে ফলের মধ্যে যে ফ্রুক্টোজ থাকে, তা সাধারণ সুগারের মতোই লিভারে গিয়ে চর্বিতে পরিণত হয়।
সুগার রোগীর চিনি কেন খাওয়া নিষেধ?
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য চিনি যে কোনও সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ হল সিম্পল কার্বোহাইড্রেট বা সরল শর্করা। ফলে সুগার দ্রুত রক্তে মিশে যায়। ফলে পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে ব্লাড গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যেতে শুরু করে। এভাবে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে ইনসুলিন বা ওষুধের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সবসময় সম্ভব হয় নয়। বারংবার এমন হতে থাকলে তা ডায়াবেটিস রোগীর স্বাস্থ্যে কুপ্রভাব ফেলে।
সুগার থাকলে চিনির বদলে কি সুগার ফ্রি খাওয়া যাবে?
অনেক ডায়াবেটিস রোগীই চিনির বদলে স্যাকারিন বা সুগার ফ্রি খান। এগুলিকে আর্টিফিশিয়াল সুইটনার বলে। ডায়াবেটিস রোগী এবং যাঁরা ওজন কমানোর জন্য আমাদের কাছে আসেন, তাঁদেরকে আমরা কিন্তু এগুলো খেতে বারণ করি। ডায়াবেটিকদের মনে রাখা উচিত এক গ্রাম সুগার ফ্রি-তে মাত্র ০.৪ ক্যালোরি সুগার আছে (এক গ্রাম চিনিতে থাকে ২০ ক্যালোরি সুগার)। তাহলে আমরা বারণ করছি কেন? সমস্যা অন্য জায়গায়।
আমাদের মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাস বলে একটা জায়গা আছে। হৃদস্পন্দন, ব্লাডপ্রেশার, কতটা খাওয়া-দাওয়া করব, আমাদের নিদ্রাচক্র ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রিত হয় হাইপোথ্যালামাস থেকে। এই হাইপোথ্যালামাসেই গ্লুকোজ স্ট্যাট নামে একটি প্রক্রিয়া আছে। যখন হাইপোথ্যালামাস বুঝে যায় যে গ্লুকোজের ‘কোটা’ পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তখনই সে পাকস্থলীতে সিগন্যাল পাঠায়। যার প্রভাবে খাবাবের ইচ্ছে চলে যায়। আর্টিফিশিয়াল সুইটনার খেলে হাইপোথ্যালামাস গ্লুকোজ পায় না। ফলে সেখান থেকে পাকস্থলীতে ‘পরিতৃপ্তির’ কোনও সিগন্যালও যায় না। তাই ওই ব্যক্তি দিনের অন্য সময় চিনিযুক্ত খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে ওজন বেড়ে যায়। এইরকম অনেক রোগী আছেন, যাঁরা ওজন ও সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সুগার-ফ্রি খান আবার রাত্রিবেলা লুকিয়ে ফ্রিজ খুলে মিষ্টিও খান। এবং প্রায়শই বাড়ির লোকের হাতে ধরা পড়েন। তাই বাড়ির লোককে বলা হচ্ছে, যে কেউ যদি একটু মিষ্টি খেতে চান, তাঁকে বারণ করবেন না। অনুষ্ঠান বাড়িতে রস চিপে একটা রসগোল্লা খেলে আপত্তি নেই। কিন্তু, হেঁটে বা শারীরিক পরিশ্রম করে সেই অতিরিক্ত ক্যালোরি খরচ করে দিতে হবে। তাহলেই ওজন বা সুগার কোনওটাই বাড়বে না।
ডায়াবেটিকদের ডায়েট নিয়ে কিছু বলবেন?
ভারতের কোন প্রান্তের ডায়াবেটিসের রোগী কত পরিমাণ কার্বহাইেড্রট খান, তা আমরা বছর পাঁচেক আগে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখাই। দৈনিক ডায়েটে কার্ভের পরিমাণ ভারতের যে কোনও রাজ্যেই ৬৪ শতাংশের উপরেই দেখা গিয়েছিল। আগেই বলেছি, উন্নত দেশগুলিতে তা সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ। একটা উদাহরণ দিই। ইউরোপে কোনও দেশের রেস্তোরাঁয় গেলে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, মাছ খাবেন না মাংস? কিন্তু আমাদের এখানে রেস্তোরাঁ গেলে জিজ্ঞাসা করবে, ভাত খাবেন না রুটি? ডায়েটের প্রাথমিক তফাতটা এখানেই। আমরা ভাত বা রুটিকে মাঝখানে রেখে অন্যান্য খাবার দিয়ে থালাটাকে সাজিয়ে তুলি। ইউরোপে মাছ বা মাংসের সঙ্গে অল্প ভাত এবং অনেকটা সব্জি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওদের ডায়েট অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। এখন আমাদের দেশে কন্টিনেন্টাল খাবার চালু হয়েছে। সেখানেও খাবারে এই মাত্রাজ্ঞান বিষয়টি দেখা যায়।
শুধু কি খাবার খেলেই হবে? এক্সারসাইজ কি জরুরি নয়?
মানুষ যতদিন বনে থাকত, ততদিন এই সব রোগ ছিল না। এখন খাওয়া-দাওয়া বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু, সেই অনুযায়ী ক্যালোরি খরচ হচ্ছে না। প্রায় ৫০০ বছর আগে জঙ্গলবাসী মানুষের রোজ খাবার জুটত না। অথচ খাবার জোগাড় করার জন্য প্রচুর শারীরিক কসরৎ করতে হতো। তাই ওজন বাড়ার এবং সেই জনিত ব্লাড সুগার হওয়ার সমস্যা থেকে তারা অনেকটাই মুক্ত ছিল। এখন কিন্তু পরিস্থিতি হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাত্, কোনও কায়িক পরিশ্রম ছাড়াই শুধুমাত্র স্মার্টফোন ব্যবহার করে দিনে চারবেলা খাবার বাড়িতে আনিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। জীবনযাত্রার এই পরিবর্তনের ফলে ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, রক্তচাপ, হার্টের অসুবিধার মত রোগ যে শরীরে বাসা বাঁধবেই, তাতে আর আশ্চর্য কী? তাই সুস্থ থাকার স্লোগান হল – ‘খাওয়া কম, কাজ বেশি’। এই ব্যালেন্সটা জরুরি। আমার কথা হল, পেটটাকে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলবেন না। খাবার বেঁচে গেলেই বাড়ির গৃহকর্ত্রীরা সেই খাবার খেয়ে নেন। তাঁরা ভুলে যান যে, অতিরিক্ত খাবার গরিব মানুষ অথবা পশু-পাখিকে দেওয়া সম্ভব। না হলে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচিত। নিজের পাকস্থলিকে ডাস্টবিন ভেবে তার মধ্যে ফেলা ঠিক নয়। এই নিয়ম মেনে চললে ওবেসিটি এবং ডায়াবেটিসের সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যাবে।