রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
লকডাউন ও প্রাণহানির হার
চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে লকডাউন শুরু হয়েছিল ভারতে। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এই ভাইরাসটির সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের কাছে সেভাবে কোনও তথ্য ছিল না। ফলে সাধারণ মানুষের কাছেও সঠিক তথ্য পৌঁছচ্ছিল না। তাই বহু মানুষ উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা করাচ্ছিলেন না। শারীরিক পরিস্থিতি জটিল হওয়ার পরেই অসুস্থরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিলেন। সেইসময় নিয়মমাফিক পরীক্ষা করানোর পরে বহু ব্যক্তির করোনা ভাইরাসের রিপোর্ট পজিটিভ আসছিল! অর্থাৎ করোনা রোগীর যেটুকু খোঁজ মিলছিল তা ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যেই। বাইরেও যে বিরাট সংখ্যক রোগী ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁদের হিসেব ছিল না।
এখানেই শেষ নয়, প্রথমদিকে এদেশে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যাও কম ছিল। পরীক্ষাও হচ্ছিল কম। এদিকে, করোনায় মৃত্যুহার নির্ণয় করা হচ্ছিল, মোট মৃতের সংখ্যাকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দ্বারা ভাগ করে তার সঙ্গে ১০০ গুণ করে।
স্বাভাবিক কারণেই মোট করোনা আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা প্রথমদিকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে ৬০ শতাংশ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির কোনও উপসর্গ থাকে না। ২০ শতাংশ রোগীর মধ্যে মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়। আর বাকি ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে মাঝারি বা জটিল ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। প্রথমদিকে এই শেষের ২০ শতাংশকেই চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছিল। ৮০ শতাংশ রয়ে যাচ্ছিলেন চোখের আড়ালে। ফলে মাত্র ২০ শতাংশের রোগীর মধ্যে নির্ণয় হচ্ছিল প্রাণহানির হার! স্বাভাবিকভাবেই প্রাণহানির হারও বেশিই মিলছিল। প্রায় ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ!
পরিস্থিতির উন্নতি
ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য পরিচয় হতেই দেশে আরও টেস্ট সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া হয়। টেস্ট-এর সংখ্যা বাড়ল। কিছু মানুষ সচেতন হয়ে নিজেরাই পরীক্ষা করাতে থাকে। ক্রমাগত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মোট আক্রান্তের তুলনায় প্রাণহানির হার কমতে দেখা যায়। প্রশ্ন হল, তারপরেও কি আদৌ প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল? একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
মে মাস নাগাদ কলকাতায় সেরো সার্ভাইলেন্স করা হয়েছিল। তাতে দেখা যায় কলকাতার ৩০ শতাংশ মানুষ ইতিমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন! শুধু পরীক্ষার অভাবে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা পড়ছিল না। কারণ ওই পর্যবেক্ষণেই ধরা পড়ে, বহু করোনা পজিটিভ রোগী উপসর্গহীন!
আনলক পর্ব
আনলক পর্ব শুরু হতেই বহু অফিস কাছারি খুলে যায়। অফিসের নিয়ম অনুসারে কর্মীরা নিজের কোভিড টেস্ট করাতে থাকেন। অসংখ্য উপসর্গহীন ব্যক্তির কোভিড পজিটিভ হওয়ার রিপোর্ট মেলে। বহু মানুষ সচেতন হয়ে নিজেরাই পরীক্ষা করাচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে রোজ প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষা করানো হচ্ছে। দেশে মৃত্যুহার কমে হয়েছে ১.৭ শতাংশ!
রাজ্যের হাল
পশ্চিমবঙ্গে এখন রোজ ৪৫ হাজারের বেশি পরীক্ষা হচ্ছে। অথচ পজিটিভ রোগীর সংখ্যা আটকে আছে ৩ হাজার বা তার চাইতে সামান্য কিছু বেশি সংখ্যার মধ্যে। প্রতিদিন প্রাণহানি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ জনের। প্রাণহানির হার ১.৯ শতাংশ।
মৃত্যুহার ও ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা
অতএব একটা বিষয় পরিষ্কার। করোনায় প্রাণহানির হার ২ শতাংশেরও নীচে! ফলে যে ভাইরাসের ডেথ রেট এত নীচে, তাকে মারাত্মক ক্ষতিকারক এমন বলা যাবে না। তুলনামূলকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। মৃত্যুহার প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ। স্ক্রাব টাইফাসেও ডেথ রেট প্রায় ১০ শতাংশ, যদিও স্ক্র্যাব টাইফাস ব্যাকটেরিয়া ঘটিত অসুখ। এমনকী প্রথমদিকে এইচ১এন১ ভাইরাসের ক্ষেত্রেও মৃত্যুহার ২ শতাংশের বেশি ছিল।
আসলে কোনও ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার পড়ে বাহক বা কোনও লিভিং অর্গ্যানিজম-এর। এখন ভাইরাসের প্রকোপে বাহকের (এক্ষেত্রে মানুষ) মৃত্যু হলে, ভাইরাস সেই মৃতদেহেই আটকে পড়ে। একসময় মারাও যায়। অর্থাৎ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য বাহকের বেঁচে থাকা খুব জরুরি।
নিপা, ইবোলা ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রাণহানির হার ছিল অত্যন্ত বেশি। কিন্তু এই ভাইরাসগুলির সংক্রমণের হার ছিল কম। তাই নিপা বা ইবোলা সারা পৃথিবীতে অতিমারী ডেকে আনতে পারেনি।
মোট কথা যে ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণহানির হার বেশি, সেই ভাইরাসের সংক্রমণের হার কম। নোভেল করোনা ভাইরাস মারাত্মক প্রাণঘাতী নয় বরং অনেক বেশি সংক্রামক। একজন থেকে চারজনের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে।
মিউটেশন কতটা সত্যি!
নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স-এর পরিবর্তন হয়েছে এবং বেশ কতগুলি মিউটেশন হয়ে গিয়েছে। তবে মিউটেশন হওয়ার পরে ভাইরাস যে বিরাট ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে বা দুর্বল হয়েছে, এমন নয়। মিউটেশনের আগে ও সংক্রমণের পরে কোনও ব্যক্তির দেহে যেমন ধরনের শারীরিক উপসর্গ দেখা যাচ্ছিল, মিউটেশনের পরেও একই ধরনের উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছে। আর একটা কথা, সদ্য করোনা ভাইরাস রূপ দেখাতে শুরু করেছে। এত দ্রুত ভাইরাস মিউটেশনের মাধ্যমে দুর্বল হতে পারে না। আরও সময় লাগবে।
প্রকৃত সত্য
এই আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। ভাইরাস দুর্বল হয়েছে বলে মৃত্যুহার কমেছে, এমন নয়। বরং পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে বলেই প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। সেই কারণেই মৃত্যুহার কমেছে। এমনই মনে হচ্ছে।
তবে কি ভ্যাকসিনই শেষ কথা?
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ‘অ্যান্টিবডি’ দিয়ে
এই ধরনের ভাইরাস পুরোপুরি প্রতিহত করতে পারে না। বরং সেল মিডিয়েটেড ইমিউনিটি দিয়ে রোগ আটকানোর চেষ্টা করে। এই ধরনের ইমিউনিটি’র কিছু মেমরি সেল রয়ে যায় শরীরে।
ফলে পরবর্তীকালে ওই একই গোত্রের ভাইরাস বা ওই ভাইরাস শরীরে ঢুকলে মেমরি সেলগুলি সতর্ক হয়ে গিয়ে ভাইরাসকে প্রতিহত করে।
অতএব কোনও ব্যক্তিকে ভ্যাকসিন দেওয়া হলে, তার দেহে কিছু ‘মেমরি টি সেল’ বা রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৈরি সৈনিক কোষ তৈরি হবে। এই টি সেল-এর মেয়াদ কতদিন, তা ভবিষ্যৎই বলবে। তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে দূরত্ববিধি মেনে চলা, মাস্ক আর অতি অবশ্যই ভ্যাকসিন—এই তিনটিই হতে চলেছে সভ্যতার প্রধান অস্ত্র।