পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
মার্চ মাসের মাঝামাঝি যখন কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে করোনা ভাইরাস আমাদের জীবনে বর্গীহানা দিল, দুশ্চিন্তা কাটাতে আমরা সবাই একে-অপরকে আশ্বস্ত করতে লাগলাম – ‘ওঃ! ভ্যাকসিন এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’ বা ‘চিন্তার কিছু নেই, ভ্যাকসিন তো আসছেই’, ইত্যাদি।
এই আশা অমুলক নয়। এডওয়ার্ড জেনারের আমল থেকে নানা রোগের টিকাকরণ যে কত কোটি প্রাণ বাঁচিয়েছে, ইয়ত্তা নেই। তাই, গত তিন মাস ধরে সবার ব্যাকুল প্রশ্ন–‘এখনো ভ্যাকসিন তৈরি হল না?’ কিন্তু, ‘উঠল বাই, ভ্যাকসিন চাই’ বললেই ভ্যাকসিন তৈরি হয় না। সেই প্রস্তুতির বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া দীর্ঘ। প্রথমে আসে প্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। যেখানে ইঁদুর আর বাঁদরদের শরীরে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দেখতে হয়। সেখানে সফল হলে আসে ফেজ ১ ট্রায়াল। অল্প কিছু মানুষের ওপর প্রয়োগ। যদি এঁদের শরীর জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সফল হয়, তখন আসে ফেজ ২ আর ফেজ ৩ পরীক্ষা। যেখানে কয়েকশো থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া মাপা হয়; পরীক্ষা হয় অ্যালার্জি বা অন্য কোন রোগ বাসা বাঁধছে না তো? বুঝতেই পারছেন, এ কাজে অযথা হড়বড় করলে হিতে বিপরীত হবে। তাছাড়া, শুধু ঠিকঠাক ভ্যাকসিন বানালেই হল না। ল্যাবে ছোট্ট করে বানানো এক জিনিস। কোটি কোটি মানুষের জন্যে কারখানায় প্রস্তুত করা, বিশেষ কাঁচের তৈরি আম্পুলে প্যাকেজ করা, ঠাণ্ডা অবস্থায় দেশে ও বিদেশে এক্সপোর্ট করা এক সুবিশাল, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
তবে, এতে মুষড়ে পরার কিছু নেই। কারণ, এ কথা অনস্বীকার্য যে নতুন করোনা ভাইরাসকে পরাস্ত করতে পৃথিবী জুড়ে যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, এমনটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে কখনও হয়নি। এই মুহূর্তে ১৪৫টির বেশি ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে! মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে অন্তত ১৭টি ভ্যাকসিন হিউম্যান ট্রায়ালে ঢুকে পড়েছে! নানাভাবে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। প্রথাগত পদ্ধতি যেমন আছে, তেমনই আছে আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যবহার।
এই মুহূর্তে যে কয়েকটি ভ্যাকসিন প্রকল্প অগ্রগণ্য সেগুলি হল—
১. একটি মার্কিন সংস্থা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরএনএ ভ্যাকসিন তৈরি করছে। প্রথম দুটি পর্বে ফলাফল বেশ সন্তোষজনক। এ মাসে তৃতীয় পর্বের পরীক্ষা শুরু হবে এবং সংস্থাটির আশা, সামনের বছরের প্রথমদিকে তাঁরা টিকা বাজারে ছাড়তেও পারবেন।
২. অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি বহুজাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগেও তৈরি হচ্ছে টিকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের পরীক্ষা চলছে ইংল্যান্ডে। কিন্তু, ওখানে যেহেতু সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা কমে গিয়েছে, তাই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা বুঝতে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিল—যেখানে পুরোদমে মহামারি এখনও চলছে, এর পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
৩. জার্মান, মার্কিন আর চিনের একটি সংস্থা হাত মিলিয়েছে করোনার ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে। প্রাথমিক দুটি পর্বে অল্প কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও, তিন সংস্থার একটি সিইও আশাবাদী যে, ২০২০ শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা কয়েক মিলিয়ন টিকার অ্যাম্পিউল বাজারে আনতে পারবেন।
৪. একটি আমেরিকান সংস্থা র আধুনিক ডিএনএ টিকা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবকের ওপরে। ৩৪ জনের ফলাফল বেশ ভাল, কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও নেই। এবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের কাজ শুরু হবে।
৫. মার্চ মাসে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চেষ্টা করেছিলেন, যাতে করোনা টিকা তৈরির টিকা তৈরিতে যুক্ত একটি কোম্পানি তল্পিতল্পা গুটিয়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেয়। কারণ, এদের ভ্যাকসিনও সফল হতে পারে। জুন মাস থেকে ফেজ ১ ট্রায়ালের কাজ চলছে।
৬. একটি খ্যাতনামা মার্কিন সংস্থা তৈরি করছে এমন একটি টিকা, যাতে আছে ন্যানোপার্টিক্যালস বা অতি ক্ষুদ্র কণা। সেগুলির গায়ে আটকে দেওয়া হয়েছে করোনা ভাইরাসের প্রোটিন। শরীরে দেওয়া হলে এই ন্যানোপার্টিক্যালস আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চাগিয়ে তুলবে; ভবিষ্যতে আসল ভাইরাস ঢুকলে, শরীর দ্রুত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকবে।
৭. মে মাসে প্রথম পর্বের ট্রায়ালে সফল হয়েছে একটি চিনা কোম্পানি। এদের সহযোগী হল বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এবং আকাদেমি অব মিলিটারি মেডিক্যাল সায়েন্সেস । দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়ালে বেশ ভাল ফলাফল দেখায় চিনা সেনাবাহিনী এই টিকাকে ‘স্পেশালি নিডেড ড্রাগ’ বলে সম্বোধন করেছে। সব সৈন্যকে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হচ্ছে।
৮. চিনা সরকারি সংস্থা প্রথম দুই পর্ব সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরসাহির সঙ্গে চুক্তি করেছে ফেজ ৩ পরীক্ষার জন্যে।আরও ৬-৭ টি পরীক্ষামূলক টিকা নিয়ে চিনা বিজ্ঞানীমহল মার্কিন প্রেসিডেন্টকে টেক্কা দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে।
৯. এছাড়া লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ, জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি’র সহযোগী এক সংস্থা, এক ফরাসি নামজাদা ওষুধ কোম্পানি, রুশ সরকারের গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বিখ্যাত একাধিক বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা সবাই করোনার বিরুদ্ধে নেমে পড়েছে। একই সঙ্গে ইতিহাসে নিজের নাম চিরস্থায়ী করে রাখা আর কোটি কোটি ডলারের মুনাফা কে ছাড়তে চাইবেন?
১০. আসা যাক ভারতের কথায়। বেশ কয়েকটি ভারতীয় কোম্পানি ভ্যাকসিন বানাবার চেষ্টা করছে। তবে, হায়দারাবাদের ভারত বায়োটেক কোম্পানির টিকা তো এখন সংবাদের শিরোনামে। এই মাসেই তাঁরা এক হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবকের ওপর ফেজ ১ এবং ফেজ ২ পর্বের পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবেন। তবে, ১৫ই আগস্টেরর মধ্যে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিকভাবে সম্ভব নয়। স্বাধীনতা দিবসের মধ্যেই ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে যাবে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে বিজ্ঞানীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ইন্ডিয়ান আকাদেমি অব সায়েন্স লিখিত প্রতিবাদ করেছে। ভ্যাকসিন নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু ‘আগে গেলে বাঘে খায়, পরে গেলে সোনা পায়’ প্রবাদটি এক্ষেত্রে ভুললে চলবে না।
১১. তাছাড়া, অক্সফোর্ডের টিকার সাফল্যর জন্যে আজ ভারতবাসী প্রার্থনা করতেই পারেন। কারণ, এঁদের অন্যতম পার্টনার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক পুনার সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া । বহুদিনের এই প্রতিষ্ঠান বছরে সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন বানাবার ক্ষমতা রাখে। কর্ণধার আদার পুনাওয়ালা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, তাঁরা যদি সফলভাবে টিকা বানাতে পারেন, সিংহভাগ টিকা ভারতবাসীর টিকাকরণেই ব্যবহৃত হবে। বিদেশে রপ্তানি করা হবে না। তারা আরও একটি সংস্থার সঙ্গে আরও একটি করোনা টিকা তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছে। কোনটা শেষ পর্যন্ত সফল হবে তা তো সঠিক কেউ জানেন না।
কোন সন্দেহ নেই, ভ্যাকসিন তৈরিতে আজ না হয় কাল সাফল্য আসবে। অন্তত আংশিক সাফল্য আসবেই। তবে, মনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিন সব দেশেরই লাগবে। তাই, বিদেশি ভ্যাকসিন হলে সরবরাহ হতে সময়ও লাগবে। দামও হবে কয়েক হাজার কোটি ডলার। তাই, প্রথমদিকে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে কিছু ভ্যাকসিন যদি আমদানি করতেও হয়, ভারতে তৈরি ভ্যাকসিনই হওয়া উচিত আমাদের প্রধান আশা।