দীর্ঘ লকডাউনে বাড়িতে বন্দী ছোট থেকে বড় সকলেই। খেয়াল করে দেখেছেন কি, ইতিমধ্যেই বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষতঃ ঘাড়ে, কাঁধে, কনুই ও কবজিতে একটা ব্যথা এবং শক্তভাব টের পাচ্ছেন? আসুন জেনে নিই বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন এবং এই সমস্য দূরই বা করবেন কীভাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারই এই সমস্যার মূল কারণ! মেডিক্যাল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের কর্ণধার এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মৌলীমাধব ঘটক জানাচ্ছেন, লকডাউনে সময় কাটানোর জন্য প্রত্যেকেরই এখন প্রধান সঙ্গী হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজির থাকা হোক বা ওয়েব সিরিজ দেখা— সব ক্ষেত্রেই একটাই সমাধান হল মোবাইল। একমাসেরও বেশি সময়ের এই লকডাউনে মোবাইল ব্যবহার যে বেড়েছে একথা অনস্বীকার্য। আর লকডাউন চলার কারণে রোজকার শারীরিক পরিশ্রমে এমনিতেই বড়সড় ঘাটতি হয়েছে। সাধারণ হাঁটাহাঁটিও প্রায় বন্ধ। ফলে শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশি ও হাড়ের জয়েন্টের সচলতা কমে গিয়েছে। একইসঙ্গে বিরতিহীন মোবাইল ব্যবহারের কারণে শরীরের নির্দিষ্ট কতকগুলি মাংসপেশির ওপরেই কেবল চাপ পড়ছে বেশি। কেউ চিত হয়ে শুয়ে হাতে মোবাইল ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তো কেউ আবার পাশ ফিরে শুয়ে। কেউ পিঠের তলায় বালিশ দিয়ে, কেউ বা আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে বসে থাকছেন। দীর্ঘসময় ধরে এমন অস্বাভাবিক শারীরিক ভঙ্গীমায় বসে বা শুয়ে থাকার কারণেই চাপ পড়ছে ঘাড়, পিঠ ও কোমরের পেশিতে। শুরু হচ্ছে ব্যথা। এমনকী পেশিতে খিঁচুনি ধরাও আশ্চর্য নয়। এখানেই শেষ নয়, হাত ভাঁজ করে দীর্ঘসময় মোবাইল ব্যবহার করার জন্য কাঁধ, কনুই ও কবজির জয়েন্টে যেমন অনমনীয় ভাব দেখা যাচ্ছে, তেমনই হাতের পেশিগুলিতেও রক্তসঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে মোবাইল ব্যবহারকারীর হাতে অসহনীয় ব্যথার উদ্রেক ঘটছে। কিন্তু কীভাবে এর থেকে মুক্তি মিলবে? এ বিষয়ে ডাঃ ঘটক জানাচ্ছেন, এইধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমত, সারাদিনের মধ্যে সকাল ও সন্ধেবেলায় অন্তত ৩০ মিনিট করে মোট এক ঘণ্টা এক্সারসাইজ করতেই হবে। ছোটবেলায় পিটি করার মতো ঘাড়, হাত, কোমর ও পায়ের এক্সারসাইজ করতেই পারেন। এছাড়া ছাদে বা বাগানে হাঁটতেই পারেন। তাও সম্ভব না হলে ঘরের মধ্যেই হাঁটুন এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। হাঁটলে বা এক্সারসাইজ করলে শরীরের সব পেশি ও জয়েন্টের সচলতা বজায় থাকে। সঙ্গে প্রাণায়ামের মতো শ্বাসের এক্সারসাইজও করতে পারেন। এর সাথে সাথে একটানা মোবাইল ব্যবহার করতে হলে চেষ্টা করুন প্রতি আধঘণ্টা অন্তর শরীরের ভঙ্গীমা পরিবর্তন করার। আধঘণ্টা অন্তর মেঝেতে দাঁড়িয়ে হাত দুটি শরীরের সামনের দিকে টানটান করে ধরুন। কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করুন ও ফের প্রসারিত করুন। এছাড়া ঘুরিয়ে নিন কব্জি দুটিকেও। বারকয়েক ওঠবোসও করতেও পারেন।
তবে শুধু ব্যথাবেদনাই নয়, দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল ব্যবহারে মাথাচাড়া দিতে পারে অন্যান্য সমস্যাও। ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সস (কলকাতা) হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট ডাঃ আশিস দত্ত জানাচ্ছেন, দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল ব্যবহার করলে অনেক সময়ই কব্জিতে ঝিনঝিন, অবশ এবং ব্যথাভাব দেখা যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই ধরনের সমস্যায় ভোগা মানুষের মধ্যে অনেকরই হয়তো লকডাউনের আগে থেকেই কব্জিতে এমন সমস্যা ছিল। সেইসময় তাঁরা উপসর্গগুলিকে অবহেলা করেছেন। অথচ এমন লক্ষণ করপাল টানেল সিনড্রোম নামে একধরনের স্নায়ুরোগের দিকে ইঙ্গিত করে। তাই দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে গিয়ে কব্জির নানা সমস্যায় ভুগলে অবশ্যই একবার স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াটাও ভীষণ জরুরি।
মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিয়ে সতর্ক করছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আশিস মিত্র। তিনি জানাচ্ছেন, লকডাউনে সময় কাটানোর জন্য মোবাইল ফোনের বিকল্প নেই। তবে রাত জেগে মোবাইলে ওয়েব সিরিজ দেখার প্রবণতা ডেকে আনতে পারে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগ। এছাড়া যাঁরা মাইগ্রেন-এর সমস্যায় ভোগেন তাঁদের ঘনঘন মাথাব্যথার সমস্যাও মাথাচাড়া দিতে পারে। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহারে চোখের উপর চাপ তো পড়েই। চোখের পাওয়ার বাড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মুশকিল হল, কারও আগে থেকে গ্লকোমা থাকলে চোখের টেনশন বাড়তে পারে বিরামহীন মোবাইল ব্যবহারে। এমনকী বাড়তে পারে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও। তাই একটানা মোবাইল ব্যবহার না করে আধঘণ্টা-এক ঘণ্টা পরপর একটু বিরতি দেওয়াই ভালো।
লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক