বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
এখন দেখা যাক কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ত্বরান্বিত করছে আইভিএফ-এর সাফল্য—
ইনট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন (আইসিএসআই): পুরুষ সঙ্গীর স্পার্ম-এর সমস্যার জন্যও কোনও কোনও দম্পতির সন্তানলাভে সমস্যা হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সিমেনে স্পার্ম কাউন্ট শূন্য। অবশ্য বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় সিমেনে স্পার্ম না থাকলেও দেহের ভিতরে স্পার্ম তৈরি হচ্ছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বায়োপ্সির মাধ্যমে টেস্টিস থেকে স্পার্ম বের করে আইভিএফ করা যায় (টেস্টিকিউলার স্পার্ম এক্সট্রাকশন)। এরপর সূক্ষ্ম নিডলের মধ্যে স্পার্ম নিয়ে ডিম্বাণু’র মধ্যে ইনজেক্ট করে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে আইসিএসআই। স্পার্ম কাউন্ট কম থাকা ব্যক্তি বা নন মোটাইল স্পার্ম-এর ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
লেজার অ্যাসিস্টেড হ্যাচিং: সাধারণ মুরগি বা হাঁসের ডিম আমরা সবাই দেখেছি। ডিমের ভিতরে বাচ্চা বেড়ে ওঠে। আর যত বেড়ে ওঠে ততই নড়াচড়া করে ও শেষে ডিমের খোলা ভেঙে বেরিয়ে আসে। নিষেকের পর ব্লাস্টোসিস্ট দশায় বিভাজন হওয়া কোষের বাইরে এইরকম একটি শেল বা খোল থাকে যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় ‘জোনা পেলুসিডা’ বলে। এই শেল বা খোল ভেদ করে ভ্রূণটি। তবে ভ্রূণের বাইরের আবরণ খুব মোটা হলে এমব্রায়ো ইমপ্ল্যান্ট সফল হয় না। সেক্ষেত্রে ঘটে আইভিএফ ফেলিওর। তাই আইভিএফ ফেলিওর এড়ানোর জন্য, ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের আগে লেজারের সাহায্যে, ভ্রূণের বাইরের পুরু আবরণকে পাতলা করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিকে বলে লেজার অ্যাসিস্টেড হ্যাচিং। দুইবার বা তার বেশি অসফল আইভিএফ-এর ক্ষেত্রে এবং মহিলার বয়স ৩৭ বছরের ঊর্ধ্বে হলে এই হ্যাচিং পদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকরী প্রমাণিত হতে পারে।
এগ ফ্রিজিং: মহিলাদের সন্তান নেওয়ার উপযুক্ত সময় হল ২০ থেকে ৩০ বছর বয়স। এরপর যত বয়স বাড়ে, ততই ওভামের সংখ্যা এবং গুণগত মান হ্রাস পেতে থাকে। বিশেষ করে ৩০ বছর বয়সের পর থেকে এই সমস্যা শুরু হয়। এরপর ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ধারণ জটিল হয়ে যায়। আর ৪০ পেরনোর পর সন্তানধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সমস্যা হল, সব মহিলার পক্ষে ৩৫ বছরের আগেই বিয়ে করা এবং সন্তান নেওয়া সম্ভব হয় না ব্যক্তিগত এবং পেশাগত কারণে। তবে তাঁরা চাইলে, কম বয়সেই (৩৫ বছর বয়সের আগেই) এগ ফ্রিজিং পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন। পরবর্তীকালে তাঁরা বেশি বয়সেও সন্তানধারণ করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে মিস ওয়ার্ল্ড ডায়ানা হেডেনের কথা বলা যায়। তিনি ৩৪ বছর বয়সে এগ ফ্রিজ করিয়েছিলেন। এরপর ৪২ বছর বয়সে, ওই এগ-এর সাহায্যে আইভিএফ-এর মাধ্যমে সুস্থ-স্বাভাবিক বাচ্চার মা হন। অর্থাৎ, কর্মব্যস্ত মহিলারা ৩৫ বছর বয়স পেরনোর আগে এগ ফ্রিজিং পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় একজন মহিলার ওভারি থেকে সুস্থ স্বাভাবিক ওভাম বা ডিম্বাণু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে রাখা হয় ল্যাবরেটরিতে। এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে বলে এগ ফ্রিজিং। ফলে বছর পাঁচেক বা ছয়েক পরে ওই মহিলা মা হতে চাইলে আইভিএফ প্রক্রিয়ায় সাফল্যের হার অনেক বেশি হয়। কারণ ডিম্বাণু ফ্রিজিং প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত ওভামের গুণগত মান অটুট থাকে।
ডিম্বাণু ফ্রিজিং পদ্ধতির অন্যান্য সুবিধাও রয়েছে। কোনও মহিলার ক্যান্সার ধরা পড়লে তাঁকে অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির মতো দীর্ঘ চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি থেকে ডিম্বাণু-এর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এমনকী আসতে পারে প্রিম্যাচিওর মেনোপজ! সেক্ষেত্রে ক্যান্সার বা বড় অসুখ ধরা পড়ার পরেই ও চিকিৎসা শুরু করার আগেই ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলা এগ ফ্রিজিং পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন। এরপর সম্পূর্ণ চিকিৎসাপ্রক্রিয়া শেষ করার পরে তাঁর সংরক্ষিত ওভামের সাহায্যে মা হতে কোনও বাধা থাকে না। তবে শুধু এগ নয়, স্পার্ম সংরক্ষণ করাও সম্ভব।
ব্লাস্টোসিস্ট কালচার: ওভাম এবং স্পার্ম মিলিত হলেই শুরু হয় ভ্রূণ তৈরির প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক অবস্থায় ওভাম ও স্পার্মের মিলন হওয়ার পরবর্তী ৫ থেকে ৯ দিনের মধ্যে ভ্রূণটি ইউটেরাসে প্রোথিত হয়। নিষেক হওয়া থেকে শুরু করে ইউটেরাসে প্রোথিত হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে মোটমুটি দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। ‘ক্লিভেজ’ এবং ‘ব্লাস্টোসিস্ট’ দশা। আগে, আইভিএফ প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকরা সাধারণত ‘ক্লিভেজ’ দশাতেই ভ্রূণকে ইউটেরাসে স্থাপন করতেন। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখা উচিত, আইভিএফ পদ্ধতিতে সাধারণত স্ত্রী ও স্বামীর শরীর থেকে একাধিক ওভাম ও স্পার্ম সংগ্রহ করে অনেকগুলি ভ্রূণ তৈরি করা হয়। আগে নিষেকের এক থেকে দু’দিনের মধ্যে গর্ভাশয়ের মধ্যে ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত করা হতো। তবে এই এমব্রায়োগুলির মধ্যে কোনটি বেশি সুস্থ বা কোন ভ্রূণের বৃদ্ধি ভালো হচ্ছে তা জানার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে ব্লাস্টোসিস্ট কালচারের সাহায্যে ল্যাবরেটরিতে ভ্রূণের বৃদ্ধি কেমন হচ্ছে তা জানা যায়। তাই এখন একাধিক ভ্রূণ তৈরি করা হলেও, শুধুমাত্র সুস্থ এবং স্বাভাবিক ভ্রূণ চিহ্নিত করে সেই ভ্রূণকেই প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে আইভিএফ পদ্ধতিতে সাফল্যের হার।
প্রিইমপ্ল্যান্টেশন জেনেটিক টেস্টিং অব অ্যানিউপ্লয়ডিস (পিজিটিএ): কিছু মহিলা খুব বেশি বয়সে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন। মোটামুটি ৩৮ বা তার বেশি বয়সে সন্তান এলে স্বাভাবিকভাবেই ভ্রূণে জিনগত কিছু সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া যাঁদের বারংবার মিসক্যারেজের ইতিহাস থাকে তাঁদের ক্ষেত্রেও ভ্রূণে জিনগত সমস্যা দেখা দেওয়ার ভয় থেকেই যায়। তাই বেশি বয়সে আইভিএফ করাচ্ছেন বা আগে বারবার মিসক্যারেজ হয়েছে এমন মহিলার ইউটেরাসে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করানোর আগেই, পিজিটিএ পরীক্ষার মাধ্যমে এমব্রায়োর জিনগত ত্রুটি নির্ধারণ করা সম্ভব। আগেই বলা হয়েছে, আইভিএফ পদ্ধতিতে একাধিক এমব্রায়ো তৈরি করা হয়। ফলে একাধিক ভ্রূণের মধ্যে যেগুলি সুস্থ, শুধুমাত্র সেগুলিকেই ইউটেরাসে প্রতিস্থাপন করা হয়।