পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
‘স্লিপার হিট’ ফিল্ম কাকে বলে জানেন? যে সমস্ত ছবি অনেকদিন পরও লোকে দেখতে থাকে, অথচ যখন সেটি মুক্তি পেয়েছিল তখন এতটা খ্যাতি পায়নি বা মুক্তির সপ্তাহে অমুক বনাম তমুক-এর বক্স অফিস আয়ের শিরোনামে যে ছবির নাম শুনতে পাওয়া যায়নি। প্লাস্টিক দূষণকে এক অর্থে পরিবেশ দূষণ ও মানব সভ্যতার শত্রুদের মধ্যে অন্যতম ‘স্লিপার হিট’ বলা চলে। দীর্ঘদিন ধরেই প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকের কথা শুনে আসছি, একটা জেনারেশন তো রচনা লিখে বড় হয়ে গেল প্লাস্টিককে নিয়ে, কিন্তু প্লাস্টিক দূষণ প্রতিহত করা গেল কই? এখন চতুর্দিকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কথা বেশ খানিকটা শোনা যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কোনও বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক নয়, বরং যে কোনও প্লাস্টিক কণা বা ফ্রাগমেন্ট যার আকার ৫ মিলিমিটারের কম। মাইক্রোপ্লাস্টিক কথাটি প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র জীববিজ্ঞানী রিচার্ড টমসন প্রথম প্রচলন করেন ২০০৪ সালে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে বেশি চিন্তার কারণ কী? কারণ এরা অনেকটা ছোট হওয়ায় খালি চোখে ভালো করে দেখা যায় না, তাই খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে মিশে গেলেও বুঝতে সমস্যা হয়; তাছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করার সময় বড় প্লাস্টিক সরানো হলেও এগুলি পুরোপুরি সরানো গেল কি না সেটা বোঝাও কঠিন। কোথা থেকে আসে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক? উৎস অনেক হলেও প্রধানত টেক্সটাইল শিল্প ও প্রসাধনী শিল্প থেকেই মূল ভাগটা আসে। পরিবেশে প্রবেশ করার সময়ই যেগুলি ৫ মিলিমিটার-এর কম আকারের ছিল সেগুলিকে প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে; আর দীর্ঘদিন ধরে বড় প্লাস্টিক ক্ষয় পেয়েও ছোট আকার নেয়, এদের সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে। আকার এক মাইক্রোমিটারের কম হলে তাকে আবার ‘ন্যানো প্লাস্টিক’ বলে। আকার যাই হোক, মূল সমস্যাটা হল মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবার নিয়ে। কৃত্রিম পলিমার হওয়ায় এগুলির ক্ষয়-এর হার অন্যান্য জৈব পদার্থের তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু জীবজগতের ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ক্ষয়। পুরনো জিনিসের ক্ষয় ক্রমে নতুন গড়তে সাহায্য করে। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু এই পরিবর্তনশীল বাস্তুতন্ত্রের মাঝে প্লাস্টিক ঢুকে গিয়েই যত ঝামেলা। অনেকভাবেই এই ক্ষতি হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্জ্য প্রধানত জমতে থাকে জলাশয়গুলিতে। ক্রমে তা নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে বাহিত হয়। অনেক শিল্পজাত বর্জ্য তো আবার কৃত্রিম খাল ও নদীনালার মাধ্যমে সমুদ্রে পড়ে। এতে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয় জলজ প্রাণীদের। তারা খাবার মনে করে এগুলি খেতে যাকে, তাদের শরীরে এগুলি জমতে থাকে। এতে জলের ইকোসিস্টেম তো নষ্ট হয়ই, পরন্তু যেসব জলজ প্রাণীকে মানুষ খাদ্য হিসাবে ভক্ষণ করে, তাদের মাধ্যমে মানবদেহে এগুলি আবার জমতে থাকে। এছাড়া সমুদ্রের উপর বা অন্যান্য জলাশয়ের উপর ভাসমান প্লাস্টিক জলের অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দিতে থাকে। এতেও জলজ প্রাণীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু প্রাণীরাই নয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটিতে জমে মাটিকে দুর্বল করে দেয়। ফলে সমুদ্রের তলদেশের মাটি দুর্বল হতে থাকে, যার সুদূরপ্রসারী ফল ক্রমবর্ধমান নানারকম ঘূর্ণিঝড় এবং সুনামির মতো ঘটনা। ২০১৪-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ৯৩০০০-২৩৬০০০ মেট্রিক টন মাইক্রোপ্লাস্টিক জমে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাসাগরের তলদেশে। ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাক’ বা উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভাসমান যে বর্জ্যস্তূপ, তার ‘আনুমানিক’ প্রায় ৩০ শতাংশই মাইক্রোপ্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। আর এই ‘আনুমানিক’ শব্দটাই এখানে সবথেকে ভয়ঙ্কর। এর মানে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশকে কতটা ক্ষতি করছে তা জানার জন্য আরও তথ্য প্রয়োজন, অর্থাৎ পুরোটা আমরা জানি না। অর্থাৎ যা জানি তা হতে পারে ‘হিমশৈলের চূড়া’ মাত্র। উপরের ওজন থেকে বিষয়টা পরিষ্কার না হবারই কথা। অনেকেই হয়তো জানেন সিডিসি-এর সমীক্ষা বলে, ধূমপায়ীদের আয়ু গড়ে অ-ধূমপায়ীদের চেয়ে ১০ বছর কম। কিন্তু প্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে এত বৃহদাকারে সমীক্ষা এখনও হয়নি। যেটুকু তথ্য মিলেছে তা এরকম—মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমতে পারে, প্রধানত এন্ডোক্রিন সিস্টেম বা হরমোন তন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, বন্ধ্যত্ব, লিভার ও কিডনির সমস্যা, হার্টের সমস্যা সবই হবে। চোখ, মস্তিষ্কের নানা রোগ, বাদ নেই কোনও অঙ্গই। এ তো গেল ক্রনিক রোগ। আছে ক্যান্সারের আশঙ্কাও। ভিনাইল ক্লোরাইড প্রমাণিত কারসিনোজেন, যা একটি প্লাস্টিকজাত দ্রব্য। আর সবথেকে খারাপ ব্যাপার হল, ধূমপান তো লোকে জেনেবুঝে করেন। যিনি খান তার ক্ষতি হয়। কিন্তু প্লাস্টিক থেকে ক্ষতি হয় সার্বিক। এমনকী আমার আপনার বা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও মুক্তি নেই এই বিষ থেকে। এই যেমন প্লাস্টিকের বোতলের পানীয় জল। অনেকেই শুনেছেন দীর্ঘদিনের পুরনো প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়া উচিত না। কিন্তু জানেন কি ২০১৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯০ শতাংশ পানীয় জলের নতুন বোতলেই মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবার। একটি বিশেষ ব্র্যান্ডে তো ১ লিটার জলে ১০ হাজার মাইক্রোফাইবার পাওয়া গেছে! মনে রাখতে হবে, এই সমীক্ষা মাত্র ৯টি দেশে করা, যার বেশিরভাগই উন্নত দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অবস্থা নিশ্চয় আরও ভালো হবে এটা আশা করা যায় না। শুধু মাটিতে এবং দেহে জমতে থাকাই নয়; সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল-এর নতুন রিপোর্ট বলছে প্লাস্টিক শিল্প হচ্ছে বর্তমানে গ্রিন হাউস গ্যাসের (যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জন্য দায়ী) দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস এবং দ্রুততম প্রসারণশীল উৎস। অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।
১৯৫০ সাল নাগাদ যখন বিজ্ঞানীরা প্রথম মনে করলেন প্লাস্টিক থেকে পরিবেশের সমস্যা হতে পারে, তার পরে আজ অবধি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী আগামী মাত্র পাঁচ বছরেই তা আরও ২৫ শতাংশ বাড়বে।
এই যখন অবস্থা, কীভাবে এর সমাধান করা যায়? প্রথম কথা, প্লাস্টিক সত্যিই আমাদের অনেক কাজে লাগে, যা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথম কাজ হল এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বিকল্প খোঁজা যা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণায় ব্যস্ত। বর্তমানে ভারতে ৫০ মাইক্রোনের কম মোটা প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। শোনা যাচ্ছে কেরল সরকার আগামী ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে অনেক রকম প্লাস্টিকের উৎপাদন নিষিদ্ধ করতে চলেছে। যা অত্যন্ত আশাপ্রদ পদক্ষেপ। এছাড়া দেখা গেছে আধুনিক বর্জ্য নির্মূলকরণ কেন্দ্রগুলি পরিবেশ থেকে প্রায় ৯৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য সরিয়ে ফেলতে সক্ষম, যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এদের সাফল্য আরও বাড়াতে হবে। এছাড়া ‘পুনর্ব্যবহার’ বা রিসাইক্লিং তো একটি পরিচিত পদক্ষেপ। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ কী কী করতে পারি? দৈনন্দিন জীবনে অনেক ছোট পদক্ষেপই আপনি নিতে পারেন। কাচের বা স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত শংসাপ্রাপ্ত ধাতব পাত্রে জল খান, প্লাস্টিকের কাপ-এর বদলে মাটির ভাঁড় বা কাগজের পাত্র ব্যবহার করুন, চট বা কাপড়ের ব্যাগ বেশি ব্যবহার করুন। সবাই মিলে চেষ্টা করলে প্লাস্টিকজাত বর্জ্যও কম তৈরি হবে, সমস্যাগুলিও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
এখনই পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে পরিবেশ সংক্রান্ত বড় ধরনের ঘটনা কিন্তু পৃথিবীতে ঘটবেই, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। সবার ইতিবাচক অংশগ্রহণ ছাড়া এ সমস্যার নিরাময় সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যও আপনার, পরিবেশও আপনার। ‘করতে হবে’ থেকে ‘করছি’-তে না উপস্থাপন করলে হয়তো মানবসভ্যতার কফিনে শেষ ‘মাইক্রো’ পেরেকটি কোনও যুদ্ধ বা বহিরাগত উল্কা নয়, সবার অন্তরালে থেকে এই ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ই পুঁতে ফেলবে!