ব্যবসা সূত্রে উপার্জন বৃদ্ধি। বিদ্যায় মানসিক চঞ্চলতা বাধার কারণ হতে পারে। গুরুজনদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন ... বিশদ
পুজোর সিজন এখন শুরু হয় গণেশপুজো থেকে। বিশ্বকর্মা, দুর্গা, লক্ষ্মী, ছট, কালী হয়ে জগদ্ধাত্রীতে এসে শেষ হয়। প্রতি পুজোতেই এখন কমবেশি বাজি-পটকা ফাটে, কালীপুজোতে যা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। পুজো ছাড়াও খেলার মাঠে, রাজনৈতিক দলের বিজয়োৎসব, এমনকী বিয়েবাড়িতেও এখন বাজি পটকার রমরমা। বাজি থেকে বিপত্তি হতে পারে তিনভাবে। কানের ক্ষতি হতে পারে, চোখে আগুনের ফুলকি পড়তে পারে, শরীরের অংশবিশেষ পুড়ে যেতে পারে। কানের কথাই আগে বলি।
কীভাবে শুনি: বড় জটিল আমাদের শ্রবণ পথ। কানের তিনটে ভাগ বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ, অন্তঃকর্ণ। বহিঃকর্ণে থাকে সুড়ঙ্গের মতো কর্ণনালী যা শেষ হয় কানের পর্দায়। মধ্যকর্ণে থাকে তিনটে ছোট হাড় (মেলিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস) কিছু মাংসপেশি, তন্তু, রক্তনালী ইত্যাদি। অন্তঃকর্ণ হল কানের আসল অংশ, যার আরেক নাম ল্যাবাইরিন্থ, যার আবার দুটো অংশ। বাইরেরটা হাড়ের তৈরি বোনি ল্যাবাইরিন্থ আর ভিতরটা নরম মেমব্রেনাস ল্যাবাইরিন্থ। এই দু’য়ের মাঝে থাকে স্পেরিলিম্ফ এবং এন্ডোলিম্ফ নামক তরল পদার্থ। অন্তঃকর্ণে অন্যান্য অংশগুলো হল ভেস্টিবিউল, সেমি সার্কুলার ক্যানাল এবং ককলিয়া। এই ককলিয়াই আমাদের আসল শোনার জায়গা। এর হেয়ার সেল প্রচণ্ড শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহিঃকর্ণ থেকে শব্দতরঙ্গ মধ্যকর্ণ হয়ে অন্তঃকর্ণে পৌঁছয়। যেখানে শব্দতরঙ্গ বৈদ্যুতিক তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে ব্রেনে পৌঁছয়। শব্দের তীব্রতা অর্থাৎ শব্দ কতটা জোরে হচ্ছে তা মাপবার জন্য একটি এককের ব্যবহার করা হয়ে থাকে যার নাম ডেসিবেল। এর সঙ্গে দেড় দশক ধরে আমরা দারুণভাবে পরিচিত হয়ে গেছি। শব্দবিজ্ঞানীরা অনেকদিন আগেই জানিয়েছিল ৬৫ ডেসিবেলের বেশি তীব্রতার শব্দ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। খুব বেশি হলে ৮৫ ডেসিবেল পর্যন্ত আমরা সহ্য করতে পারি। এর বেশি হলে কানে নানা ক্ষতি হয়। আমাদের শ্রবণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। হার্টের গতি ও রক্তচাপ বাড়তে পারে। দেখা দিতে পারে অনিদ্রা, অস্থিরতা নানা ধরনের স্নায়ু রোগ।
১৪০ ডেসিবেলের শব্দ শরীরে ব্যথা সৃষ্টি করে। ১৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে পারে।
কী কী ক্ষতি হতে পারে: প্রধানত চার ধরনের ক্ষতি হতে পারে শব্দবাজি থেকে—
কানে সাময়িক তালা ধরতে পারে ও ব্যথা হতে পারে।
কানের পর্দা সরাসরি ফেটে যেতে পারে।
অন্তঃকর্ণের স্নায়ুতে চোট লাগার জন্য কানে সাময়িক বা চিরস্থায়ী বধিরতা দেখা দিতে পারে।
কানে ভোঁ ভোঁ করতে পারে, মাথা ঘুরতে পারে, বমিও হতে পারে।
কী করবেন: বাড়ির বাইরে থাকলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুন। বাইরের শব্দের উৎপাত থেকে বাঁচতে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিন। গরম তেল, জল বা বাড়িতে পড়ে থাকা পুরনো কানের ড্রপ কখনও কানে দেবেন না। দোকানে বলে সদ্য কিনে আনা কানের ড্রপও দেওয়া উচিত নয়। কানে বরং শুকনো তুলো গুঁজে দিন। অস্থিরতা কমাতে অ্যালপ্রাজ্যোলাম জাতীয় বড়ি বা ০.২৫ মাত্রা খেতে পারেন। কান থেকে রক্ত গড়ালে কানে তুলো গুঁজে ডাক্তারের কাছে যান বা হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে যান। তবে যাই করুন রাতারাতি কানের তালা খুলে যাবে এমনটা কখনও ভাববেন না। সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন কান থেকে জল গড়াচ্ছে সত্ত্বর ডাক্তার দেখাবেন। কানে কম শুনলে, তালা ধরলে ভোঁ ভোঁ করলে কানের অডিওমেট্রি পরীক্ষা করে শ্রবণ ক্ষমতা পরীক্ষা করতে হবে। অন্তঃকর্ণের ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য প্রয়োজনে করতে হবে ইলেক্ট্রো ককলিয়াগ্রাফ। পর্দা ফেটে গেলে পরবর্তীকালে ম্যাটারিনগোপ্লাস্টি করে পর্দা জুড়ে নিতে হবে। কানের নার্ভের স্থায়ী ক্ষতি হলে, কানে হেয়ারিং এড নিতে হতে পারে।
আঙুল পুড়ে গেলে: হাউসস্টাফশিপ পিরিয়ড একবার কালীপুজোর রাতে একবার ডিউটি করতে হয়েছিল আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে। ৩৬ বছর আগে সেই রাতের স্মৃতি আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল। তখন শব্দবাজিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। একের পর এক হাত পোড়া, গা পোড়া সারা শরীর ঝলছে যাওয়া, মাথা, চোখ, চুল পুড়ে যাওয়া রোগী ঢুকছে এমার্জেন্সিতে। তাঁদের চিৎকার আর পোড়ার গন্ধে বার বার দমবন্ধ হয়ে আসছিল আমার। হাইকোর্ট, পুলিস, প্রশাসন সর্বোপরি জনগণ কিছুটা সচেতন হওয়ায় কিছুটা অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবু কালীপুজোর ক’দিন আগুনে অনেকের হাত-পা, মুখ পুড়বে। তখন কী করবেন জেনে নিন।
জল ঢালবেন পুড়ে যাওয়া জায়গায়। না, বরফ ঠান্ডা জল বা বরফ নয়। ঢালবেন স্বাভাবিক (১০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) তাপমাত্রার বা অল্প ঠান্ডা জল। আবার বলছি বরফ নয়, কারণ অতিরিক্ত ঠান্ডায় রক্তবাহী নালীগুলি সঙ্কুচিত হয়ে পুড়ে যাওয়া অংশটিতে রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেয়। কতক্ষণ ধরে জল ঢালবেন? যতক্ষণ না ব্যাথা-জ্বালা কমে। তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন একঘণ্টার বেশি সময় জল ঢাললে কোনও লাভ হয় না।
এবার জেনেনিন কেন ঢালবেন জল?
এরফলে গভীর ক্ষত হয় না ত্বকে। পুড়ে যাওয়া অংশটি ফুলে ওঠে না, ব্যথা কমে। জল ঢাললে পুড়ে যাওয়া অংশ থেকে তাপ দ্রুত বেরিয়ে যায়। ত্বকের কোষ থেকে হিস্টামিন ও কাইনিন বেরোনো কমে যাওয়ার ফলে ক্ষতি কম হয়, ক্ষতিটা ত্বকের গভীর স্তর পর্যন্ত পৌঁছয় না। আরেকটা কথা পোড়া জায়গায় গাদা গাদা বার্নল লাগাবেন না, ফোস্কা পড়লে গেলে দেবেন না। শুধু জল ঢেলে, ব্যাথার ওষুধ খেয়ে জায়গাটা পরিষ্কার কাপড় বা গজ দিয়ে ঢেকে ডাক্তারের কাছে যাবেন।
বিপত্তি যখন চোখে: বাজিতে থাকে নানারকম রাসায়নিক, যার কোনওটি শরীরের পক্ষে ভালো নয়, চোখের জন্যও তো নয়ই। আগুনের ফুলকি বা সালফারের গুড়ো চোখে ঢুকে যেতে পারে। একদম চোখ রগড়াবেন না। কোনও ঘরে পড়ে থাকা ড্রপ বা মলম চোখে দেবেন না। বারে বারে চোখে পরিষ্কার জলের ঝাপটা দিন। অন্ধকারে চোখককে বিশ্রাম দিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নিন। অনেক সময় বাজি থেকে চোখের কর্নিয়া পুড়ে যেতে পারে। কাজেই সাবধান!
তবে কী বাজি পোড়াবেন না: পোড়াবেন, তবে সাবধানে। নিজের ও পরের ক্ষতি না করে। শব্দবাজি, রকেট বাদ দিয়ে অন্য আতসবাজি পোড়ান।
যদি বাজি পোড়াতেই হয় তবে কিছু সাবধানতা আপনাকে অবলম্বন করতেই হবে—
জনমুখর পরিবেশে বাজি পোড়াবেন না। খোলা ছাদ, বাড়ির উঠোন বা মাঠে বাজি ফাটান। শব্দ বাজি না ফাটিয়ে আলোক বাজি ফাটান।
ঢিলেঢালা সিন্থেটিক পোশাক পরবেন না। সুতির আঁটোসাটো পোশাক পরুন। জুতো মোজা পরুন বা চামড়ার চটি। শিশুদের তাই পরাবেন।
বাজির বারুদ যেন ঘরে না পড়ে। অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে। চোখে গেলে কনজাংটিভাইটিসও হতে পারে।
শিশুদের নাগালে বাজি রাখবেন না। ওদের একা একা বাজি পোড়াতে দেবেন না। নখ কেটে দেবেন। একটা লম্বা লাঠির মাথায় আলোকবাজি বেঁধে শিশুদের পোড়াতে দিন।
বাজি পোড়াবার জায়গায় একবালতি জল রাখবেন। আধপোড়া বাজিতে জল ঢেলে দেবেন।
ড্যাম্প ধরা বাজি পোড়াবেন না। পোড়াবার আগে রোদে দিয়ে দেবেন। পলতে ঠিক আছে কিনা, দেখে নেবেন। রকেট বা হাউই বাজি একটা লম্বা খালি বোতলে খাড়া করে রেখে আগুন দেবেন, যাতে বাজিটি উল্টোপাল্টা জায়গায় গোঁত্তা না মারে। শিশুরা যেন এগুলি না ফাটায়।
বাজির মুখোমুখি পড়ে গেলে দু’হাতে দু’কান চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে হাঁটুতে মাথা গুংজে বসে পড়বেন।
শেষ কথা হল, বাজি পোড়াতে হলে নিজের এবং প্রতিবেশির কথা মাথায় রাখুন। বাজি থেকে যে কোনও মানুষের প্রাণ সংশয় হতে পারে, এটা ভুলে যাবেন না।