বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
ডাঃ সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ
শুরুর কথা
সেই ১৯২৮ সালে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করেছিলেন অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন। আর তারপরেই, সেই আদ্যিকালেই তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, অ্যান্টিবায়োটিক এমন এক ওষুধ যা মূর্খদের হাতে পড়লে মানবজাতির কাছে অভিশাপ হয়ে উঠবে! ঘটনাচক্রে পেনিসিলিন বাজারজাত হওয়ার কয়েকবছরে মধ্যেই দেখা পেনিসিলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে বহু রোগীর মধ্যে!
প্রশ্ন হল কী এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স?
এককথায় ব্যাকটেরিয়ার বিশেষ ধরনের বিবর্তন হয় অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে! ফলে ওই রোগ উদ্রেককারী ব্যাকটেরিয়াকে আর নষ্ট করতে পারে না অ্যান্টিবায়োটিক। আসলে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অ্যান্টিবায়াোটিক হল মূল অস্ত্র। কিন্তু সেই অস্ত্র কীভাবে চালনা করা হয়, তার ধরা কতটা এসব যদি ব্যাকটেরিয়া আগে থেকেই বুঝতে পারে? আর কী! ব্যাকটেরিয়া নিজের মধ্যে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে এবং নিজেও সেই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে বিশেষ অস্ত্র তৈরি করবে যাতে সেই অ্যান্টিবায়োটিক আর তাকে মেরে ফেলতে না পারে! অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ তাই খুব গুরত্বপূর্ণ। ডোজ শেষ না হলে ব্যাকটেরিয়া মারাও যাবে না, উপরন্তু অল্পমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের সংস্পর্শে এসে তারা নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারবে।
প্রশ্ন হল, অল্পমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া পরিচিত হচ্ছে কীভাবে?
অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ: অ্যান্টিবায়োটিকের নির্দিষ্ট ডোজ থাকে সে কথা আগেই বলা হয়েছে। কোনও রোগীকে পাঁচদিন দুটি করে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে বলার পরেও তিনি দুদিন দুটি করে ওষুধ খাওয়ার পর বন্ধ করে দিলে হতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।
মাছ চাষ: মাছের রোগ-বিরেত নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও মড়ক আটকাতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এই মাছ খাওয়ার পরে সুস্থ মানুষের দেহেও সামান্য মাত্রায় হলেও অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করে।
হাসপাতালের ড্রেন: হাসপাতালে বহু রোগী ভর্তি থাকেন। সেই রোগীর মল-মূত্র হাসপাতালের ড্রেন থেকে বেরিয়ে মাটিতে মিশছে! এমনকী ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ জলের আধারে মেশাও অসম্ভব নয়।
পুরনো ওষুধ: অব্যবহৃত পুরনো ওষুধ মাটিতে মিশে বা পানীয় জলের সঙ্গে কোনওভাবে মিশে গেলেও হতে পারে বিপদ।
পশুখাদ্য: শুধুমাত্রা খাদ্য হিসেবে চাষ করা হয় এমন প্রাণীর মাংসেও আজকাল মিলছে অ্যান্টিবায়োটিক। বিশেষ করে মুরগির খাদ্যের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য। এই ধরনের চিকেন খেলে, সেখান থেকেও হতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স!
অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে কীভাবে ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়ারা বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছে এবং ধীরে ধীরে শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।
এছাড়াও একটা কারণ আছে যেটির সম্পর্কে বলা দরকার—
অতি ব্যবহার: সামান্য অসুখ-বিসুখে বারবার অ্যান্টিবায়োটিক খেলে খেলে হতে পারে এমন রেজিস্ট্যান্স। কারণ আমাদের শরীরে যেমন খারাপ ব্যাকটেরিয়া ঢোকে তেমনি কিছউ বন্ধু ব্যাকটেরিয়াও থাকে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক খারাপ ও ভালো উভয় ব্যাকটেরিয়ায় মেরে ফেলে। এদিকে বারবার, ছোটখাট কারণে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে এই বন্ধু ব্যাকটেরিয়াগুলিও অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নেয়। পরবর্তীকালে শরীরে খারাপ ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করার পর ওই ভালো ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিনটি দিয়ে তারাও নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলবে! এই প্রক্রিয়াকে বলে জিন ট্রান্সফার।
পরিসংখ্যান
বিভিন্ন সংস্থার করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমাদের দেশেই সবচাইতে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা হয়! ফলে রেজিস্ট্যান্সও বেশি হয়!
২০১০ সালে এদেশে মারাত্মক এক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কথা শোনা যায়। এই রেজিস্ট্যান্ট অ্যান্টিবায়োটিকের নাম ছিল নিউ দিল্লি মেটালো-বেটা-ল্যাকটামেস-১ (এনডিএম-১)। এনডিএম হল এমন একটা উৎসেচক, যা খুব শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রুপকে (কার্বপেনেম) ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এই উৎসেচক অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পাওয়া যায়। এই উৎসেচক প্রথম ভারতের ব্যাকটেরিয়া থেকে মেলে। অতএব বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর!
মনে রাখতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যাওয়া মানে, রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র শূন্য হয়ে পড়া!
এখন পরিবেশে অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আছে। কতকগুলি সামান্য শরীর খারাপের জন্য দায়ী থাকে। কিছু ব্যাকটেরিয়া আবার মারাত্মক রকম শরীর খারাপের জন্য দায়ী থাকে। এখন,অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার না হলে, সব ধরনের ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেই প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হবে। ফলে একসময় যে কোনও রোগ সারানো অসম্ভব হয়ে যাবে। বিশেষ করে প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলি একবার যদি নিজেদের মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, তাহলে আমাদের প্রাক অ্যান্টিবায়োটিক যুগে ফিরে যেতে হবে!
তাহলে উপায় কী?
পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু হওয়ার পিছনে বড় বড় কারণগুলির সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সকেও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজেশন।
সাম্প্রতিক বেশ কিছু নামী ব্যক্তিত্ব যেমন রাজনীতিক, অভিনেত্রীর হ্যাসপাতালে মৃত্যুর কারণের দিকে নজর রাখলেই জানা যাবে, তাঁদের মৃত্যুর পিছনে দায়ী ছিল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স!
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখন দরকার—
১) অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
২) অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প খোঁজা!
প্রথমটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার:
আইন: অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে আইন প্রণয়ন করার চেষ্টা চলছে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে অ্যান্টিমাইক্রবিয়াল স্টুয়ার্ডশিপ! ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজেশনের তরফে সবার জন্য মনোগ্রাহী আইন তৈরির চেষ্টা করে চলছে। ফলে ওষুধের দোকান থেকে হুটহাট ওষুধ কিনে খাওয়া বা গ্রামের কোয়াক চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ হবে। এছাড়া মডার্ন মেডিসিন প্র্যাকটিস করেন এমন চিকিৎসকদের যথেচ্ছ মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রাশ টানা যাবে।
সংক্রমণ রোধ: নতুন করে সংক্রমণ না হলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার দরকার পড়বে না। তাই সংক্রমণ ঠেকানো খুব জরুরি। এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলিকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, হাসপাতালে ভর্তির পর রোগীর যেমন রোগ সারে তেমনই বহু জীবাণুও সেখানে বাস করে। ফলে
সঠিক পদ্ধতিতে অপারেশন না করলে, অপারেশন থিয়েটারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর না রাখলে, গ্লাভস পরার নিয়ম না মানলে, রোগীর পরিচর্যা না করলে ফের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এই নিয়ম মানার পাশাপাশি, হাসপাতালের স্যানিটেশন ব্যবস্থার দিকেও নজর দিতে হবে। অর্থাৎ হাসপাতালের বর্জ্য যাতে নদীতে না মেশে বা মাটির সঙ্গে মিশে ফের দূষণ ও সংক্রমণ না ছড়াতে পারে সেই দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
ওয়ান হেলথ: আগেই বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের পিছনে কম ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, গবাদি পশু, খাদ্য হিসেবে প্রতিপালন করা পশুর ক্ষেত্রে যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, মাটিতে, জলে অ্যান্টিবায়োটিক মেশা সমানভাবে গুরত্বপূর্ণ! ফলে এমন একটা আইন আনতে হবে যাতে, এই সমস্ত বিষয়গুলি একই আইনের আওতায় চলে আসে। অতএব হাসপাতালের বর্জ্য হোক বা কোনও ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার বর্জ্য, তা যেন কোনওভাবেই নদীতে বা মাটিতে না মেশে তা নিশ্চিত হবে এই আইনের মাধ্যমেই। একই সঙ্গে পশুখাদ্যের সঙ্গে অবৈজ্ঞানিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক মেশানোও বন্ধ করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প
ব্যাকটেরিওফাজ: ব্যাকটেরিয়া খেকো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিওফাজ দিয়ে চিকিৎসা করা শুরু হয়েছিল প্রথম সোভিয়েত রাশিয়ায়। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্তে ব্যাকটেরিওফাজ দিয়ে চিকিৎসাপ্রণালী বাধাপ্রাপ্ত হয়। সাম্প্রতিককালে ব্যাকটেরিওফাজ নিয়ে ফের নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। এমনকী মাত্র দু’বছর আগে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সান দিয়েগোর সাইকিয়াট্রি বিভাগের এক অধ্যাপকের প্যাংক্রিয়াসে অ্যাসিনেটোব্যাকটর জীবাণুর সংক্রমণ হয়। কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই তাঁর শরীরে কাজ করছিল না। অবশেষে আমেরিকার নৌবাহিনীর ল্যাবরেটরি থেকে পাঠানো ব্যাকটেরিওফাজ দ্বারা ওই অধ্যাপকের চিকিৎসা হয় এবং তিনি সেরে ওঠেন। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, রোগ সারাতে আপাতত ভবিষ্যত বলতে ব্যাকটেরিওফাজ। এই নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার। যতবেশি গবেষণা হবে, ততই মানুষ উপকৃত হবেন। ইতিমধ্যে ভারত সরকারের চিকিৎসা গবেষণা বিভাগ (আইসিএমআর) সম্প্রতি জাতীয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হাব তৈরি করার কথা ঘোষণা করেছে কলকাতায়। এই গবেষণাগারে সারা দেশের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে গবেষণা নিয়ন্ত্রিত হবে।