বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এখন চিকিৎসকরা রোগীর অসুখ সম্বন্ধে বিশদে জানার জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকুও ব্যয় করেন না। কারণ তাঁরা তাড়াতাড়ি কাজ সারতে চান। সময়ের অভাবে রোগীর অসুখের ইতিহাসটাই অজানা রয়ে যায়। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের রোগ পরীক্ষা সম্বন্ধে গভীরে জানেন। কিন্তু অনেকসময় কখন কোন টেস্ট করাতে হবে বা সেই টেস্টের রিপোর্টগুলিকে বিশ্লেষণই করতে পারেন না। বেশিরভাগক্ষেত্রেই তাঁরা সংখ্যার উপর বেশি জোর দেন। তাই রোগীর বদলে রোগীর রিপোর্টের চিকিৎসা চলে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি গড়ে তোলার পিছনে স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিচালনকারীদেরও দোষ কম নয়। তাঁর চান, একজন চিকিৎসক কম সময়ের মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে রোগী দেখুক। তাই চিকিৎসকদের শুধু দায়ী করে লাভ নেই।
কোনও চিকিৎসকের ক্লিনিক্যাল স্কিল কম থাকা একটি জটিল ও দীর্ঘকালীন সমস্যা। অসম্পূর্ণ শিক্ষাই এই সমস্যার মূল কারণ। এই হিসেবে দেখলে, আমরা যাঁরা মেডিক্যাল কলেজে পড়াই তাঁরাও এই সমস্যার জন্য দায়ী।
তাহলে কেন আমরা জেনেবুঝে আমাদের পড়ুয়াদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অবহেলা করতে শেখাই? এই প্রশ্নের উত্তরের দু’টি দিক রয়েছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত, সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজের মুল্যবোধ ও অগ্রাধিকার বদলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, ১৯৫০-এর দশকে আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন কঠোর শ্রম, আত্মমর্যাদা, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা, দায়বদ্ধতা এবং শ্রেষ্ঠত্বর পিছনে ধাওয়া করাটাই ছিল নিয়ম। আর এখন নির্দিষ্ট সময় কাজ করা, নিজের ব্যক্তিগত লাভ, নিজেকে পলিটিক্যালি কারেক্ট রাখার মতো কাজগুলিতেই সবাই ব্যস্ত থাকে। আত্মমর্যাদা এবং দায়বদ্ধতা প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। তার ফল হিসেবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রায় সকলেই নিজেদের মাঝারি মান নিয়েই বেশ খুশিতে রয়েছেন।
উত্তরের দ্বিতীয় পর্যায়ে বলব, শিক্ষকরা তেমন শিক্ষাই দিচ্ছেন যা তাঁরা নিজেরা পেয়েছেন। আজকের বেশিরভাগ মেডিক্যাল শিক্ষকরাই ৭০ দশকের আগে-পিছু প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সেই সময়েই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব বেশি মাত্রায় শুরু হয়। তাই তাঁরা নিজেরা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসা করতে শিখেছেন। এই বিষয়টিকে হাই-টেক মেডিসিন হিসেবে দেখা হয়। আর তাঁরা নিজেরা যেই পদ্ধতিতে শিক্ষিত, আজ নিজেদের ছাত্রছাত্রীদেরও সেই হাই-টেক মেডিসিন শিক্ষাই দিয়ে চলেছেন। অনেক শিক্ষক নিজেরাও হাই-টাচ মেডিসিন বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেননি।
এবার প্রশ্ন আসতে পারে, হাই-টাচ মেডিসিন বিষয়টি কী? উত্তর হল, রোগীর অসুখের ইতিহাস জেনে এবং রোগীর যথাযথ শারীরিক পরীক্ষা করে একজন চিকিৎসক অনেক তথ্য পান। এই তথ্যগুলিকে চিকিৎসক নিজের বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন। তথ্যের বিশ্লেষণ করার পর দেখতে হয় আদৌ কোনও রোগ পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে কি না। এবার রোগ পরীক্ষার প্রয়োজন হলে প্রথমে সহজ পরীক্ষাগুলি আগে করাতে হয়। এই গোটা বিষয়টিই হল হাই-টাচ মেডিসিন।
অন্যদিকে হাই-টেক মেডিসিন-এর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই চিকিৎসক রোগীর অসুখের ইতিহাস জানতে চান না এবং জরুরি শারীরিক পরীক্ষাগুলিও এড়িয়ে যান। এক্ষেত্রে চিকিৎসক সরাসরি রোগীর কাছ থেকে মূল সমস্যার কথা জানতে চান। তারপর সেই সমস্যার বিষয়ে জানতে একগাদা রোগ পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
যেহেতু হাই-টেক মেডিসিন পদ্ধতিতে চিকিৎসকরা রোগীর কাছ থেকে অসুখের ইতিহাস জানেন না এবং রোগীর শারীরিক পরীক্ষাও করেন না, এই কারণে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে নিবিড় সম্পর্কও গড়ে ওঠে না। অন্যদিকে হাই-টাচ মেডিসিন পদ্ধতিতে চিকিৎসক রোগীর মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার অর্থ— রোগ নয়, আমরা রোগীর চিকিৎসা করছি।
অর্থাৎ আধুনিক প্রযুক্তি যেমন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, ঠিক তেমনই চিকিৎসকদের অনেকাংশে মানসিকভাবে অলস করে দিয়েছে। প্রুযুক্তির উপর বিশ্বাস রাখতে রাখতে তাঁরা নিজেদের সর্বোত্তম হাতিয়ার মস্তিষ্কের ব্যবহারই কমিয়ে এনেছেন। তবে এই সমস্যার সমাধান কোথায়? সমাধান বেশ কঠিন। গোটা চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের এমন শিক্ষক চাই যাঁদের ভালো ক্লিনিক্যাল স্কিল রয়েছে, যাঁরা রোগীর অসুখের ইতিহাস নেওয়া শেখাবেন, যাঁরা রোগীর যথাযথ শারীরিক পরীক্ষা করতে শেখাবেন, যাঁরা কোন রোগ পরীক্ষা কখন করতে হবে সেই হিসেব জানেন, যাঁরা রিপোর্টের ফলাফল বিশ্লেষণ করা শেখানোর মতো আরও অনেক জরুরি কাজ করতে পারবেন। সর্বোপরি পড়ুয়াদের ভালো মূল্যবোধ তৈরি করার শিক্ষক চাই। পাশাপাশি ক্লাস রুমের বদলে আরও বেশি করে রোগীর মধ্যে পড়ুয়াদের ক্লাস নিতে হবে। হাতেকলমে তাঁদের আরও পক্ত করে তোলা দরকার। এভাবেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
(ধন্যবাদন্তে ডাঃ অখিল কে সঙ্গল)
অনুবাদক: সায়ন নস্কর