সাংগঠনিক কর্মে বড় সাফল্য পেতে পারেন। উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের জোরে কার্যোদ্ধার। বিদ্যায় সাফল্য। ... বিশদ
কিছুদিন আগেই নবদ্বীপ পোস্ট অফিস থেকে কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিসে পাঠানো টাকা শিমুলতলায় লুট করা হয়। তদন্তে দেখা যায় এ কাজ বিপ্লবীদের। শুরু হয় সন্দেহভাজন অনন্তহরি সহ অন্যদের খোঁজে তল্লাশি।
ট্যাক্সির নম্বর টুকে নিয়ে তৎপর পুলিস রাতেই চালককে ধরে ফেলল। সে জানাল, আরোহীরা বরানগর বাজারে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে চলে গিয়েছেন। পরদিন সকালে ট্যাক্সিচালককে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে খুঁজে বের করা হল। জানা গেল দক্ষিণেশ্বরে একটি পুকুর ধারে নেমেছিলেন আরোহীরা।
পুলিস হদিশ পেয়ে গেল দক্ষিণেশ্বরের বাচস্পতি পাড়ার সাদামাটা দোতলা বাড়িটির। আসলে যেটি স্বদেশিদের বোমা তৈরি প্রধান কেন্দ্র। ব্রিটিশ সরকারকে সমঝে দিতে দিল্লি, আগ্রা, বেনারস, এলাহাবাদ সহ সর্বত্র ঝলসে উঠছিল এখানকার ‘কালীমায়ের বোমা’। দক্ষিণেশ্বরের অধিষ্ঠাত্রী ভবতারিণী দেবী কালিকার নামেই এই বোমা পরিচিত ছিল বিপ্লবী মহলে।
এ বাড়িতে তখন বহু বিপ্লবীর আনাগোনা। তাঁদের থাকা খাওয়াদাওয়া, বোমার মালমশলা ইত্যাদি বাবদ খরচ ক্রমশ বেড়ে চলায় সুরেশ চট্টোপাধ্যায় নিজের বসতবাটি বিক্রি করে এগারো হাজার টাকা দিলেন। প্রফুল্ল বসু দিলেন পরিবারের সমস্ত অলংকার। আরও অনেকে যতটা সম্ভব অর্থ জোগাড় করলেন। এদিকে জাল গোটানো শুরু করল পুলিস।
চুপ করে বসেছিল না অন্যপক্ষও। কিছু একটা আঁচ করে ৯ নভেম্বর চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায় নৌকা নিয়ে হাজির। আপাতত বাচস্পতি পাড়ার আস্তানা খালি করে সহযোদ্ধাদের গঙ্গা পেরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। কিন্তু ন’জনের মধ্যে পাঁচজন বিপ্লবীই সেদিন জ্বরে অচৈতন্য। ফলে বাধ্য হয়ে সেদিনের মতো পরিকল্পনা স্থগিত করা হল। স্থানাভাবের দরুণ নিরুপায় চৈতন্যদেব রাতে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন।
পরদিন ভোর পাঁচটায় দরজায় ঠকঠক শব্দ। দুধওয়ালা ভেবে দরজা খোলামাত্র চব্বিশ পরগনার অ্যাডিশনাল পুলিস সুপার মিস্টার ডাকফিল্ডের নেতৃত্বে বিশাল পুলিস বাহিনী তড়িৎ গতিতে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল।
দরজা খুলে দিয়ে প্রথমেই ধরা পড়লেন তরুণ বিপ্লবী রাখাল দে। দোতলায় উঠে পুলিস ধরে ফেলল উত্তরপ্রদেশ থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে আসা বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসির কৃতী ছাত্র রাজেন লাহিড়ীকে। পূর্বদিকের ঘর থেকে গ্রেপ্তার করা হল জ্বরে সংজ্ঞাহীন তিন বিপ্লবী— হরিনারায়ণ চন্দ্র, বীরেন্দ্র ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মাঝের ঘরে জ্বরে অচৈতন্য ধ্রুবেশ ও শিবরাম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁদের সুশ্রূষারত অনন্তহরি এবং বারান্দা থেকে ধরা পড়লেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
বরাতজোরে গ্রেপ্তারি এড়ানো চৈতন্যদেব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৪ নম্বর শোভাবাজার স্ট্রিটের গুপ্ত আস্তানার দিকে চললেন। কিন্তু ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পুলিস অনেক আগেই সেখানে পৌঁছে গেল। এখান থেকে গ্রেপ্তার হলেন প্রমোদরঞ্জন চৌধুরী ও অনন্ত চক্রবর্তী। ধরা পড়ার আগে সাধ্যমতো হাতাহাতি করে পুলিসকে কিছুক্ষণ আটকে রাখলেন প্রমোদ। সেই অবকাশে দোতলার গরাদভাঙা জানলা দিয়ে গলে পাইপ বেয়ে নেমে গেলেন কৃশকায় এক ব্যক্তি। পরবর্তীকালে যাঁকে সারা দেশ চিনল চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন নামে।
১১ জন বিপ্লবীকে নিয়ে চলল ‘দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলা’। আলিপুর বোমার মামলা বা মুজফফরপুর বোমার মামলার কথা তো আমরা ইতিহাস বইতে পড়েছি। এই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত অনন্তহরি মিত্র, হরিনারায়ণ চন্দ্র ও রাজেন লাহিড়ীর দশ বছর কারাদণ্ড হল। অনন্ত চক্রবর্তী ও প্রমোদরঞ্জন চৌধুরীর পাঁচ বছর ও বাকি সবার তিন বছর করে কারাদণ্ড।
এরপর রাজেন লাহিড়ীকে কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলায় উত্তরপ্রদেশে পাঠানো হয়। সেই মামলার রায়ে ১৯২৭-এর ১৭ ডিসেম্বর গোণ্ডা জেলে ফাঁসির মঞ্চে শহিদ হন তিনি। কারাবন্দি অবস্থায় আলিপুর জেলের থাকাকালীন দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলার বিপ্লবীরা হত্যা করেন আইবির স্পেশাল এসপিকে। প্রমোদরঞ্জন এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। এই মামলায় প্রমোদরঞ্জন, অনন্তহরি ও বীরেন্দ্রর প্রাণদণ্ড হয়। রাখাল, ধ্রুবেশ ও অনন্তর হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। পরবর্তীকালে হাইকোর্টে যদিও প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত বীরেন্দ্র সহ কয়েকজন বেকসুর খালাস পান। ১৯২৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের ভোর। কারাবন্দিদের অবিশ্রান্ত বন্দেমাতরম্ স্লোগানের মধ্যে দৃপ্ত পদক্ষেপে ফাঁসির মঞ্চে উঠে গেলেন অনন্তহরি ও প্রমোদরঞ্জন। দেশপ্রেমিকদের আত্মবলিদানে ‘কালীমায়ের বোমা’র আগুন অনির্বাণশিখা হয়ে থাকল দেশের স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাসে।