কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
ইতিহাসের লিখিত রূপের সূচনা আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। বর্তমানে আমরা ইতিহাস থেকে যত যুদ্ধবিগ্রহের গল্প জানতে পারি, তার মধ্যে ‘ব্যাটল অব মেগিড্ডো’ ইতিহাসে লিখিত প্রথম যুদ্ধকাহিনি। ১৪৭৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ( মতান্তরে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৮২/১৪৫৭ অব্দ) সেই যুদ্ধ কেমন ছিল— আজ রইল সেই অজানা গল্প।
মিশর ও মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যপথের মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন শহর মেগিড্ডো।
সেই সময়ে এই অঞ্চলের নাম ছিল কানান। বর্তমানে এর অবস্থান হাইফার দক্ষিণ-পূর্বে নাজারেথের কাছে ইজরায়েলের জ্যাজরেল উপত্যকায়। সুদূর অতীতে এক সময় মেগিড্ডোতে মিশরীয় ফ্যারাওদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল।
কিন্তু আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্রমশ এই সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হ্রাস পায়। বহিঃশত্রু দেশের একাংশ দখল করে নেয়। তখন অভিজাত সম্প্রদায়রা শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ফ্যারাওদের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫ শতকে মেসোপোটেমিয়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেশ কিছু রাজ্য অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে ছিল হিট্টাইট, মিটান্নি ও কাসাইটরা। মিশরের সামরিক ক্ষমতাকে টক্কর দেওয়ার মতো শক্তি স্থানীয় নগররাষ্ট্রগুলোর না থাকলেও এই রাজ্যগুলোর ছিল। মেগিড্ডো ও তার আশপাশের এলাকার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল তাদেরও। ফলে ফ্যারাও তৃতীয় থুতমোস যখন মিশরের পুরনো প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনতে যুদ্ধ অভিযান আরম্ভ করেন, মেগিড্ডো তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
ফ্যারাও তৃতীয় থুতমোসের রাজত্বের ২৩তম বছরে এক শুভদিনে থিবস থেকে কুড়ি হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করলেন। দশ দিনে প্রায় দেড়শো মাইল অতিক্রম করে তাঁরা গাজায় একরাত কাটালেন। তারপর পৌঁছলেন ইয়েহেম শহরে। ইয়েহেম থেকে মেগিড্ডো বেশি দূরে নয়। দুই শহরের মাঝে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণি। ফ্যারাওয়ের চরেরা খবর আনল— তিনটি পথ দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। পাহাড়ের উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে দুটি প্রশস্ত রাস্তা, একটু ঘুরপথ হলেও সেনাদল নিয়ে সে পথে যাওয়া সম্ভব। আরও একটি পথ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ গিরিখাদ, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু বিপজ্জনক পথ। সেনাদের পার হতে হবে একটা লাইন করে, যুদ্ধরথ নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। শত্রুরা এখানে ফাঁদ পেতে রাখলে খুব সহজেই ধ্বংস করে দিতে পারবে তাদের। থুতমোস তাঁর সেনাপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। সবাই মতামত দিলেন উত্তর বা দক্ষিণের যেকোনও একটা রাস্তা বেছে নিতে। কিন্তু ফ্যারাওয়ের ধারণা হল সেনাপতিরা যা বলছেন, সেটা তাঁর শত্রুপক্ষেরও মাথায় আসবে। তাই তিনি সেনাদের গিরিখাদ ধরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
ফ্যারাওয়ের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কাদেশের রাজা তাঁর পদাতিক সেনাদের রেখেছিলেন উত্তর আর দক্ষিণ পথের পাহারায়। রথবাহিনী ছিল মেগিড্ডোর সামনে। তিনি ভেবেছিলেন, উত্তর বা দক্ষিণ দিক থেকে ফ্যারাও অগ্রসর হলে পদাতিকেরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে তাদের টেনে নিয়ে আসবে রথবাহিনীর কাছে, এরপর সম্মিলিত সেনাদল বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে মিশরীয়দের উপর।
আর গিরিখাদে ছিল অল্প কিছু সেনা। থুতমোসের সেনারা তাদের কচুকাটা করে এগিয়ে গেল এবং নিরাপদেই তারা পৌঁছে গেল মেগিড্ডোর পার্শ্ববর্তী কি না উপত্যকায়। থুতমোস তার সেনাদের নিয়ে কিনায় শিবির স্থাপন করলেন। ফ্যারাওয়ের এ হেন চমকপ্রদ দূরদর্শিতায় কাদেশের রাজার সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল। তিনি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তাঁর সমস্ত সেনা নিয়ে মেগিড্ডো শহরের দুর্গের কাছে শিবির স্থাপন করলেন। পরের দিনটি ছিল মিশরীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে তৃতীয় মরশুমের প্রথম মাস। সকাল থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দু’পক্ষ। থুতমোস তাঁর সেনাবাহিনীকে সাজাতে গিয়ে লক্ষ করলেন, কাদেশের সেনাবাহিনী তখনও বিশৃঙ্খল অবস্থায়। অত্যন্ত দক্ষতা এবং তৎপরতার সঙ্গে ফ্যারাও তাঁর বাহিনীকে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে সাজিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাদেশের বাহিনীর উপর। এই অতর্কিত আক্রমণে কাদেশের সেনাবাহিনী ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল এবং মুহূর্তের মধ্যেই পরাজয় বরণ করল। শত্রুপক্ষের প্রায় আট হাজার সেনা নিহত হল। আর জখম প্রায় সাড়ে তিন হাজার। অন্যদিকে, ফ্যারাওয়ের বাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার।
যুদ্ধ শেষে বিজয় উল্লাসে মত্ত হয়ে মিশরীয় সেনারা অবাধ লুঠপাট চালাতে শুরু করে। এই সময় নগরের প্রাচীরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাদেশের রাজা রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান। ফলে কানানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনতে সাত মাসের দীর্ঘ অবরোধ করা হয়।
অবশেষে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মেগিড্ডোর দরজা ফ্যারাওয়ের সামনে খুলে যায়। তিনি নমনীয় নীতি গ্রহণ করেন। মেগিড্ডো বিজয় তৃতীয় থুতমোসকে শক্তিশালী ফ্যারাও হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে কানানের উত্তরাংশে মিশরীয় আধিপত্যের সূচনা হয়। মেসোপোটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যপথ নিষ্কণ্টক হওয়ায় মিশরের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফ্যারাও তৃতীয় থুতমোসের সম্মানে নির্মিত থিবসের মন্দিরে বিস্তারিতভাবে লিখে রাখা হয় এই কীর্তির কথা। যা কোনও যুদ্ধের প্রথম লিখিত বর্ণনা।