পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
মা তখন নিশ্চিত মনে এক্সারশন ট্রিপে চলে গেল।
পুপুল বাবার কাছে ভালোই আছে। সবই চলছিল ঠিকঠাক হঠাৎ পুপুলের বাবার অফিসের কাজে একদিন বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে গেল। যেতেই হবে। এড়ানো যাবে না। বাবা বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। পুপুলকে কোথায় রেখে যাবেন? ভাবতে ভাবতে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘একদিনের তো ব্যাপার পুপুল, তোকে আমার সঙ্গেই নিয়ে যাব। বেশি দূর তো নয়, এই তো ঝাড়গ্রাম। অফিসের গাড়িতে যাব দু’জনে। ওরা নিশ্চয় আমাকে ভালো হোটেলের ঘরে রাখবে। তুইও আমার সঙ্গে থাকবি।’
পুপুল একটু ভেবে বলল, ‘ঝাড়গ্রাম? সে আবার কেমন জায়গা? ভালো হবে?’
—এর চেয়ে ভালো আর কিছুতেই হবে না।
বাবা অফিসের কাজে বেরনোর আগে পুপুল হোটেলের রুমে বসে বলল, ‘তুমি চলে গেলে আমি বোর হব বাবা।’
—তোর হোমওয়ার্ক করে ফেল। নয়তো একটু টিভি দেখ।
—হোমওয়ার্ক সকালেই সব করে ফেলেছি। আর টিভি দেখতে আমি ভালোবাসি না।
—মোবাইলে গেম খেল।
—সে তো গাড়ি বা বাড়িতে বসেই খেলা যায়। এই ঝাড়গ্রামের হোটেলে বসে ভালো লাগে? বাবা, এখানে দেখার কিছু নেই?
—আমি জানি না সেই সব। কাজে এসেছি দু-একবার। ঠিক আছে, আমি কাজের জায়গায় পৌঁছে গাড়িটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার বন্ধু শ্যামল একবার বলেছিল, এখানে নাকি মন্দির-টন্দির আছে। নদীও আছে একটা। তোর ড্রাইভার আঙ্কেল খোঁজখবর করে ঘুরিয়ে আনবে তোকে। ঠিক আছে? খুশি?
হেসে মাথা দোলাল পুপুল।
ড্রাইভার আঙ্কেল বলল, ‘বাবুসাহেব, তুমি কী দেখতে চাও? একটা বড় বাগান আছে এখানে, নাম ক্রিস গার্ডেন। প্রচুর ফুল ফোটে। সবাই দেখতে যায়, যাবে?’
মাথা নাড়ল পুপুল, ‘না, মা ফুল খুব ভালোবাসে। মাকে ছেড়ে ফুলের বাগান দেখতে যাব না।’ মন খারাপ হবে। অন্য কোথাও যাওয়া যায় না?’
—যায়। বেলপাহাড়ি আছে, গোপীবল্লভপুর আছে আবার ঝাড়গ্রামের মধ্যেও কিছু জায়গা আছে—তবে আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। স্যার বলে দিয়েছেন, তোমাকে নিয়ে যেন লাঞ্চের আগেই ফিরে আসি। উনি তোমার সঙ্গে হোটেলে একসঙ্গে লাঞ্চ করবেন।
—তাহলে তুমি ঠিক কর কোথায় যাব। তুমি চেনো সব জায়গা?
—সে একজন গাইড জোগাড় করে নেওয়া যাবে। আমার জেঠুর বাড়ি এখানে। তাহলে বাবুসাহেব, চল তোমাকে আগে চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির দেখাই। তারপর একটা নদী দেখাতে নিয়ে যাব। ভারী মিষ্টি তার নাম—ডুলুং। হেঁটে হেঁটে একেবারে নদীর কাছে চলে যেতে পারবে।
—তাই নাকি! নদীর একেবারে কাছে? হাত দেওয়া যাবে? আমি কখনও নদী ছুঁয়ে দেখিনি। রূপনারায়ণ, কংসাবতী, দামোদর—এসব গাড়িতে বসেই দেখেছি। আর গঙ্গার ধারে গেছি কিন্তু মা আমাকে জলে নামতে দেয়নি। তুমি নামতে দেবে ডুলুং নদীতে?
—জল কম থাকলে ছপছপ করে নদীর মধ্যে নেমে যাওয়া যাবে।
—চল-চল আঙ্কেল, এখনই যাই। মন্দির পরে দেখব। সোজা ডুলুং নদীর ধারেই চলে যাই আমরা।
—নদী দেখতে গেলে আগে কনকদুর্গা মন্দির পড়বে। তার পেছনেই ডুলুং নদী। মন্দির থেকে হেঁটে যেতে হয়। ওখানে গাড়ি যাবে না। তাছাড়া মন্দিরের কাছে তোমাকে আর একটা মজার জিনিস দেখাব। দেখবে কত কত হনুমান! লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলছে! কিন্তু কাউকে কামড়ায় না, আছড়ায় না। শুধু হাতে খাবার দেখলে কেড়ে খেয়ে নেয়।
‘পেটুক হনুমানগুলো খুব জেন্টেল বুঝি?’ হাসতে হাসতে বলল পুপুল।
পুপুল গাড়ির সিটে জানলার ধারে বসেছে।
ড্রাইভার আঙ্কেল একজন গাইড নিয়েছে সঙ্গে। সেই গাইড আঙ্কেল আর ড্রাইভার আঙ্কেল লোকেদের জিজ্ঞেস করতে করতে এগচ্ছে।
পুপুল চলন্ত গাড়ির ভেতর থেকে বাইরেটা দেখছে। দু’পাশে শালবন কতশত শাল গাছ পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। গাইড বলছিল, ‘এই শাল গাছের জঙ্গলই জঙ্গলমহলের আসল সৌন্দর্য!’
এত শাল গাছ, যেন ফুরচ্ছেই না। তারপর ইউক্যালিপটাস গাছও আছে। পুপুলের মনে হল। ইউক্যালিপটাসের সোজা কাণ্ডগুলিতে কেউ যেন হোয়াইট ওয়াশ করে দিয়েছে।
গাড়ি যেতে যেতে হঠাৎই পুপুলের নজরে পড়ল। দুপাশে অনেক গাছ ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে পড়ে আছে। আর সেখানে গাঢ় কমলা রঙের অনেক ফল পড়ে আছে।
—ওগুলো কী গাছ?
—ওগুলো সব খেজুর গাছ। তুমি তো কলকাতায় থাক। তাই কখনও দেখনি। গ্রামের দিকে প্রচুর খেজুর গাছ দেখা যায়। এখনও পাকেনি ভালো করে। নাহলে তোমাকে পেড়ে খাওয়াতাম।
—দরকার নেই গাইড আঙ্কেল। তাড়াতাড়ি ডুলুং নদীর ধারে চল যাই।
কনকদুর্গা মন্দির আগে পড়ল। ওরা হেঁটে হেঁটে মন্দিরের কাছে যাচ্ছিল। হঠাৎ ডানদিকের একটা গাছের দিকে পুপুল চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই দেখ আঙ্কেল, গাছে একটা হনুমান বসে আছে। আরে একটা নয়তো, একটা, দুটো, তিনটে, চারটে-পুরো ফ্যামিলি মনে হচ্ছে।’
—এবার বাঁদিকে দেখ।
—আরে এখানেই একটা ফ্যামিলি বসে আছে। কী মজা। আমাদের দেখছে পিটপিট করে।
—আর সামনে?
—ও বাবা! একটা কত বড় হনুমান বসে আছে। পেটের কাছে আবার একটা বাচ্চাও। দেখ, দেখ, আমাদের দেখে গাছ থেকে আর দুটো নামল।
—ওরা ভাবছে, আমরা ওদের খাওয়াব। চল, ডুলুং দেখে ফেরার পথে ওদের খাইয়ে যাব।
ওরা আর খানিকটা এগিয়ে এসে দূর থেকেই নদীটা দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি পা ফেলতে লাগল পুপুল। রাস্তার দু’পাশেই মোটা জাল দিয়ে জঙ্গলটাকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। সেদিকে দেখিয়ে আঙ্কেল বলল, ‘ওই ঢিপিগুলো কীসের বল তো?’
—উইয়ের ঢিপি?
—না। এগুলো সাপের ঢিপি। পুরো ঢিপিটায় কতগুলো গর্ত দেখছ? এগুলো দিয়ে ওরা ভেতরে ঢোকে-বেরয়। দু’পাশেই অনেকগুলো ঢিপি দেখতে পেল পুপুল। একটা তো তিন ফুটেরও বেশি উঁচু। কিন্তু সেইসব দেখার থেকেও ও সামনের ডুলুংয়ের দিকে ছুটে যেতে চাইল। এত কাছে আস্ত একটা নদী। কী সুন্দর এঁকে-বেঁকে চলে গেছে দু’দিকে। পায়ে পায়ে হেঁটে দিব্যি নদীর জলে নামা যায়। কোনও বাধা নেই। বোল্ডারও নেই।
—নদীতে নামব আঙ্কেল?
—নামো, কিন্তু বেশি দূর যেও না। কোথায় কতটা গভীর, ভেতরে পাথর আছে কি না জানি না তো। যদি পিছলে পড়ে যাও, খুব খারাপ হবে।
আর খারাপ হবে। ডুলুং তখন পুপুলকে ডাক দিয়েই ফেলেছে। ও ছপছপ করে নদীতে নেমেই পড়ল। কী পরিষ্কার জল! নীচে শুধু বালি আর কাঁকর। একটুও কাদা নেই কোথাও। নিজের পা’দুটো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পুপুল স্বচ্ছ জলের মধ্যে দিয়ে। আরও দু’পা এগল পুপুল। আরও সুন্দর জল, কাচের মতন। খুব আনন্দ হচ্ছে পুপুলের। সে একটা নদীতে দাঁড়িয়ে আছে!
ছপছপ করে লাফাল। জল ছিটকে উঠল চারদিকে। বারবার লাফাতে লাগল পুপুল। বারবার জল ছিটকোতে লাগল। খুব আনন্দ হচ্ছে ওর। আরও ভিতরে একটু এগিয়ে গেল। জল গোড়ালি ছাড়িয়েও এখন অনেকটা উপরে।
পড়ে যাবে বলে একটুও ভয় করছে না পুপুলের। পড়বে কী করে? ঢেউ তো নেই। শুধু হাওয়ার সঙ্গে জলের উপরটা তিরতির করে কাঁপছে। সেই জলের ওপর মেঘ ভর্তি আকাশের ছবিটা রিফ্লেক্ট করছে। আবার ভেঙেও যাচ্ছে কেঁপে কেঁপে। নিচু হয়ে পুপুল এবার হাতের দুটো পাতা ডুবিয়ে দিল। আরে, হাত দুটোও দেখা যাচ্ছে! হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে জলে খেলতে লাগল—ছপছপ-ছপছপ। যেমন খুশি শব্দ করতে পারছে জল নিয়ে। শুধু তাই নয়, নদীটাও এই খেলায় পুপুলের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে যেন। নদীর ধারে ধারে খালি পায়ে ছুটে বেড়াতে লাগল পুপুল।
—এখানে সাঁতার কাটা যাবে গাইড আঙ্কেল?
—এখন যাবে না। গ্রীষ্মের সময় তো। জল কমে গেছে। যখন বর্ষার জল পাবে একেবারে ভরে যাবে নদী, ওই সিঁড়িগুলো পর্যন্ত জল উঠে যাবে, অনেক চওড়া হয়ে যাবে। জেগে উঠবে নদী। আরও বড় বড় ঢেউ উঠবে। সেই সময় সাঁতার কাটা যাবে বাবুসাহেব।
—ও, এখন তাহলে ডুলুং বিশ্রাম করছে? তাই অলস মুড তোমার? ও ডুলুং, কখন তুমি কলকল করে বয়ে যাবে?
জল নিয়ে খেলেই চলেছে পুপুল। কাঁকর, বালি নেড়ে-ছুড়ে, এলোমেলো করে জলে ঘেঁটে দিচ্ছে। আর কথা বলে চলেছে ডুলুং নদীর সঙ্গে, ‘শোনো ডুলুং, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এমন করে নদীর মধ্যে বসে, দাঁড়িয়ে, ঝুঁকে কখনও কোনও নদী আমাকে খেলতে দেবে না। এমন লক্ষ্মীসোনা নদী বোধহয় আর কোথাও নেই।’
‘ডুলুং সোনা’। পুপুলের মা যেমন আদর করে ‘পুপুল সোনা’ বলে ডাকে। ঠিক তেমন করে পুপুল ডেকে উঠল নদীটাকে, ‘তোমার কাছে আমি আবার যখন আসব, আমার মাকেও নিয়ে আসব। আর তখন তুমি জেগে ওঠে খলখল করে ধেয়ে চলবে তো? আমিও তখন তোমার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটব। সুইমিং পুলেই সাঁতার কাটি। নদীতে তো কখনও কাটিনি। ডুলুংয়ের মধ্যেই কাটব।
‘এবার চল বাবুসাহেব, দেরি হয়ে যাবে।’ ড্রাইভার আঙ্কেল ডাকল পুপুলকে।
—দাঁড়াও যাচ্ছি। ডুলুংয়ের সঙ্গে গল্প করছি তো!
ডুলুংয়ের স্বচ্ছ জলে হাত রেখে পুপুল বলল, ‘তোমার কাছে আমার মনটা রেখে গেলাম ডুলুং। এখন চলে গেলেও তোমার ধারেই রইলাম। বাড়ি গিয়ে চোখ বুজলেই তোমাকে দেখতে পাব। তোমার ধার ধরে বেড়াব। আবার আসব আমি। আর বাড়ি বসে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা তোমার ছবিগুলোও দেখব।’