পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
—জল পড়ছে। আকাশ থেকে। তার শব্দ। সবাই যাকে বৃষ্টি বলে। আর তোমার কাজ হল সেই বৃষ্টি থেকে ছকড়িবাবুর মাথাটা শুকনো রাখা। ঠিক আগের বড় কালো ছাতাটা যেমনটা করত।
—বুঝেছি। কিন্তু কোথায় সে? তাকে দেখছি না তো?
হঠাৎ খানিকটা পাগলাটে ঝোড়ো হাওয়া জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। ভয় পেল জুতো জোড়া। একটু গম্ভীর হল সে।
বলল, ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে।
—ঝড়? সে আবার কী? অবাক হয় ছাতাটা।
জুতো বলল, হাওয়া তখন সাঁই সাঁই করে আকাশকে তোলপাড় করে তোলে। আর বৃষ্টি দরজা জানলায় আছড়ে পড়ে হাতুড়ির মতো। কয়লা কালো আকাশটা ভীষণ আক্রোশে কাঁপতে থাকে গুড়গুড় করে। তাকেই বলে ঝড়।
—ঝড়ে কী করে হারিয়ে গেল আগের ছাতাটা?
—ছকড়িবাবু হাতে নিয়ে সকালে কাজে বেরিয়েছিলেন। তিনি জানলার কাচে চোখ রেখে বলেছিলেন, গতিক সুবিধের ঠেকছে না। মনে হয় আজ কপালে দুর্যোগ আছে। অজানা আশঙ্কায় আমারও চোখ ছলছল করে উঠেছিল। ফিতে নেড়ে বিদায় অবধি জানিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল বন্ধু ছাতাটাকে আর দেখতে পাব না।
ততক্ষণে ছকড়িবাবু ঝড় মাথায় নিয়ে কাজে বেরচ্ছেন। সঙ্গে নিলেন নতুন ছাতাটাকে। পা চালিয়ে চললেন বালিগঞ্জ স্টেশনে। ট্রেনে উঠেই ভেজা ছাতাটাকে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর বাঁশি বাজল। ট্রেন ছাড়ল।
ছাতাটা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল তার মতো বেশ কয়েকটা ছাতা টাঙানো। খানিকটা ভয় কাটল তার, ঝড়ের কবলে পড়েও ওরা দিব্যি আছে। হারিয়ে তো যায়নি। ছকড়িবাবুর আগের ছাতাটাকে তবে ঝড়ে নেয়নি। তাহলে সে এখন কোথায়?
ট্রেন থামল বারুইপুর জংশনে। সবাই নামতে চায় হুড়োহুড়ি করে। কামরা খালি হল নিমেষে। সব ছাতারাই তাদের মালিকের সঙ্গে চলে গিয়েছে। খালি পড়ে রইল কয়েকটা খবরের কাগজ আর ছকড়িবাবুর নতুন ছাতাটা।
একজন টিকিট চেকারের নজরে এল ছাতাটা। অসহায় ছাতাটাকে তিনি নিয়ে এলেন একটা অন্ধকার গুদামঘরে। সেখানে একজন মুরুব্বি গোছের লোকের গলা শোনা গেল, আবার একটা ছাতা। আর পারা যায় না।
ছকড়িবাবুর ছাতাটা সামনেই একটা কালো ছাতাকে দেখতে পেয়ে বলল, আমি এখন কোথায়? এখানে কেন?
—তুমি এখন বেওয়ারিশ। মালিকহীন। কিন্তু তোমাকে তো বেশ চালাক চতুর মনে হচ্ছে। এমন ঝড়বাদলের দিনে নিজেকে বাঁচিয়ে এখানে হাজির হয়েছ।
ছকড়িবাবুর ছাতার জিজ্ঞাসা, ঝড় হবে নাকি?
—হয়েছিল গত সপ্তাহে। কী ভয়ঙ্কর। ভেবেছিলাম চিরকালের মতো হারিয়ে যাব।
—কিন্তু তুমি তো হারাওনি। হারালে কি তোমার দেখা পেতাম?
—তবে শোনো। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল মুশলধারে। মনে হচ্ছিল যেন ছিঁড়ে ফেলবে আমাকে। এবং পুড়ে মরব।
—পুড়ে মরবে? সে কেমন করে?
—আকাশে তখন প্রচণ্ড গর্জন। আর বিদ্যুতের ঝিলিক। তিরের মতো আগুনের ফলা নেমে আসছিল আমার দিকে। হঠাৎ ওদের গল্প থেমে গেল। গুদামঘরে ছকড়িবাবু সশরীরে হাজির। নতুন ছাতা আনন্দে আত্মহারা। ছকড়িবাবু বোধহয় তাকে নিতে এসেছেন।
তক্ষুনি ঘরটা আবার বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠল। এই প্রথমবার ছকড়িবাবুর নতুন ছাতাটা ভালো করে ঠাহর করল সঙ্গী ছাতাটাকে। আন্দাজে ঢিল ছুড়ে বলল, তুমিই কি ছকড়িবাবুর যাওয়া আগের ছাতা?
—তুমি জানলে কী করে?
—তোমার বর্ণনা ছকড়িবাবুর জুতোর কাছে শুনেছিলাম। হুবহু মিলে যাচ্ছে। আমিই তো তোমার বদলে এসেছি। তুমি যখন ঝড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে ঠিক তারপর। কিন্তু তোমার এই অবস্থা হল কী করে?
—বুঝলে ভাই আমি ভয়ে সেদিন কাঁপছিলাম। ছকড়িবাবুর হাত ফসকে হুড়োহুড়ির মধ্যে আমি ছিটকে গিয়েছিলাম সিটের তলায়।
এমন সময় এক রেল কর্মচারী আঙুল দিয়ে ছকড়িবাবুকে নতুন ছাতাটা দেখালেন।
নতুন ছাতা অবাক হয়ে পুরনো ছাতাকে বলল, তুমি ফিরে যেতে চাওনা ছকড়িবাবুর কাছে?
—না ভাই। বেশ আছি এই ঘরে। কোনওদিন ভিজতে হবে না।
নতুন ছাতা ভাবল, এই নোংরা গুদামঘরে না থেকে ঝড় বৃষ্টির স্বাদ নেওয়া অনেক ভালো।
ছকড়িবাবুও মহা খুশি ছাতাটাকে খুঁজে পেয়ে। খুলে ধরলেন মাথার ওপর। ছাতাটার একটু ভয় ভয় করলেও গায়ে লাগল আনন্দের শিহরন। ছকড়িবাবু টুপটাপ বৃষ্টিতে পা বাড়ালেন আর নতুন ছাতাও একটা গভীর শ্বাস নিল বাইরে বেরিয়ে।
অঙ্কন : সুব্রত মাজী