পিতার স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
গোটা বিশ্বকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন ফুটবলের রাজপুত্র ডিয়েগো মারাদোনা। যিনি সবুজ মাঠে বাঁ পায়ের তুলিতে আলপনা আঁকতেন। উঠে এসেছিলেন বর্ণনাতীত দারিদ্র্যকে জয় করে। তাঁর ছেলেবেলার কথায় সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
মারাদোনা নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং, বাঁ পায়ের অনবদ্য জাদু আর সম্মোহিত ফুটবলের কোলাজের কথা। আর্জেন্টিনার ফুটবলার হয়েও যিনি তাঁর সহজাত প্রতিভার জোরে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন বিশ্ব ফুটবলের মুখ হিসেবে। একক দক্ষতায় দেশকে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ এনে দেওয়া মোটেই মুখের কথা নয়। সাফল্য তাঁকে এনে দিয়েছে বৈভব, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি। কিন্তু, তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও অত্যন্ত কষ্টের মধ্যেই। একাধিকবার নানা সাক্ষাৎকারে এবং আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’তেও অকপটেই তিনি তুলে ধরেছেন সেই অতীত সংগ্রামের কথা।
কাজের প্রতি গভীর অনুরাগ, ঐকান্তিকতা ও ভালোবাসা না থাকলে তাতে কখনওই সেরা হওয়া যায় না। সাফল্যের শিখর ছোঁয়া যায় না। মারাদোনা তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। স্যাঁতসেঁতে বস্তির জীবন, নিম্নবিত্ত পরিবারের চরম দারিদ্র্য, পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাকে জয় করে কীভাবে বিশ্ব ফুটবলের একজন রোলমডেল হওয়া যায়, তার সেরা বিজ্ঞাপন বোধহয় ডিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাই। সেই জন্যই তিনি বলেছেন, আমার পুরো জীবন যেন ঠিক সিনেমার মতো। তাঁর সংগ্রাম, উত্থান, সাফল্য— সব যেন এক ঠাসবুনোট চিত্রনাট্য। কিন্তু, এই সাফল্যের হাজার হাজার ওয়াটের আলোর ঝলকানির নেপথ্যে অনেকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে এক অদম্য লড়াইয়ের গল্প, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হতে পারে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, গভীর অনুপ্রেরণা।
১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর। বুয়েনস আইরেসের উপকণ্ঠ লানুসে জন্ম। ভিয়া ফিওরিতো শহরে বেড়ে ওঠা। মারাদোনা ছিলেন আট ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম, পরিবারে প্রথম পুত্রসন্তান। সেই সময় গরিব, বস্তিতে থাকা ছেলেদের বেঁচে থাকার অন্যতম রসদ ছিল ফুটবল। তাঁরা ফুটবল খেলতেন যেন মুক্তির আনন্দেই। ক্ষণিকের জন্য হলেও দুঃখ, দুর্দশা, অভাব-অনটনকে ভুলে থাকতে, হতাশাকে দমিয়ে রাখতে, ছেলেবেলা থেকেই মারাদোনার ধ্যান-জ্ঞান, ভালোবাসা ছিল ফুটবল। অন্যদের থেকে একটু আলাদাই। কারণ, ফুটবল যে ছিল তাঁর রক্তে। বন্ধু এল নেগরো কিংবা তুতো ভাই বেটোর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতেন। অনেকটা যেন সেই ‘ইট ফুটবল, ড্রিঙ্ক ফুটবল, স্লিপ ফুটবল’ স্লোগানের মতো। তিন বছর বয়সে তাঁকে বেটোই প্রথম ফুটবলটি উপহার দেয়। উপহার পেয়ে মারাদোনা এত খুশি হয়েছিলেন, সারা রাত বলটা বুকে জড়িয়ে শুয়েছিলেন। কোনওদিন তিনি উপহার পাওয়া সেই প্রথম ফুটবলটির কথা ভুলতে পারেননি। বারেবারে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আমি পাগলের মতো ফুটবল খেলতে চাইতাম।’ ভাইয়ের দেওয়া এই উপহার তাঁকে ইচ্ছাপূরণের স্বাদ এনে দিয়েছিল। স্কুল থাকলে বিকেল থেকে ফুটবল খেলতে খেলতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত। রাতের অন্ধকারেও তিনকাঠির মধ্যে বল রাখার জন্য ক্রমাগত শট নিয়ে যেতেন। শনি-রবিবার বা ছুটির দিনে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যেত দুপুর থেকেই। ক্লান্ত হয়ে পড়লে মাঠের পাশের বাড়ি থেকে একটু জল চেয়ে খেতেন। তারপর ফের শুরু হতো বল নিয়ে অনুশীলন। চরম দারিদ্র্যে ফুটবলই যে ছিল তাঁর কাছে পরম বন্ধু। মারাদোনা বলতেন, ফুটবল খেলার মাধ্যমে আমি যেন শান্তি খুঁজে পেতাম।
সকাল হলেই বাবা কারখানায় কাজ করতে চলে যেতেন। শরীরে না কুলোলেও এত বড় সংসার টানার জন্য তাঁকে কাজে বেরতেই হতো। বল নিয়ে মেতে থাকলেও বাবার সেই কষ্ট কিন্তু মারাদোনার নজর এড়ায়নি। মাল বইতে গিয়ে বাবার পিঠে খুব ব্যথা হতো। রাতে মা বাবার পিঠে ও ঘাড়ে বরফ ঘষে দিতেন। ভাইবোনেরা অবাক চোখে তা দেখতেন। আসলে পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। পরিবারের অভাব যেন ফুটবলের প্রতি তাঁর জেদ, ভালোবাসা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বপ্নের শিখর ছুঁয়েও সেই সব দিনের কথা তাই তিনি ভুলতে পারেননি। মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলেন, পরিবারের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার কথা। টেবিলের ডানদিকে বসতেন বাবা ও মা। আর বাঁ-দিকে ভাইবোনেরা। এই টেবিলই যে ছিল রান্না, খাওয়া, স্কুলের হোমওয়ার্ক করার জায়গা। বৃষ্টি হলে ঘরের চালের একাধিক ফুটো দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ত। মজা করে বলতেন, সেই জলের ধারা থেকে মাথা বাঁচাতে রীতিমতো ড্রিবল করতে হতো। পেশাদার ফুটবলার জীবনে তাঁর সেই ড্রিবলই সম্মোহিত করে রেখেছিল গোটা ফুটবল বিশ্বকে। শুধু তাই নয়, বাড়ির জন্য জল আনার মাধ্যমেই চলত তাঁর ওয়েট ট্রেনিং পর্ব। জল আনার জন্য বাড়িতে কয়েকটি ২০ লিটারের তেলের ক্যান ছিল। রাস্তার একটি মাত্র কল থেকে সেই ক্যানে করে জল টেনে আনতে হতো। রান্না, খাওয়া, মুখ ধোওয়া, স্নান করা— সবই চলত সেই জলেই। ভারী ওজন তোলার প্রাথমিক অনুশীলন শুরু সেখান থেকেই। হাজার কষ্টের মধ্যেও একবার ছেলের জন্য বাবা একজোড়া জুতো এনে দিয়েছিলেন। সারাদিন ফুটবল খেলে ডিয়েগো একদিনেই সেই জুতো জোড়া ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। তার জন্য বাবার কাছে মার খেতে হয়েছিল। জুতো ছেঁড়ার সেই আক্ষেপ, বাবার সেদিনের শাসন জীবন সায়াহ্নে এসেও একটিবারের জন্য ভোলেননি তিনি। টাকা রোজগারের তাগিদে বাবা ব্যস্ত থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেতেন না। ছেলেবেলার এই চাপা দুঃখ তাঁকে আজীবন তাড়িয়ে বেরিয়েছে। তাই তারকা জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকেও সন্তান ও পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করে নিতেন মারাদোনা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, টেলিফোনে মায়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন।
আর্থিক অনটনের জন্য ছেলেবেলায় কোনওদিন ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালন হয়নি। উপহার বলতে ছিল আত্মীয়, বন্ধু, পরিবারের আদর। কিন্তু, স্নেহের চুম্বনই ছিল মারাদোনার শৈশবের পরম প্রাপ্তি, যা কোনও মূল্য দিয়ে চোকানো যায় না। অর্থের অভাবে একটুকরো পিৎজা কিনে কয়েকজন বন্ধু মিলে ভাগ করে খেতেন। এ সবই যেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার হওয়ার, অর্থ উপার্জনের তাগিদ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
একদিকে চরম দারিদ্র্য,অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সমাজবিরোধীদের দাপট— এরই মাঝে প্রতিদিন নিষ্ঠার সঙ্গে ফুটবল প্রতিভায় শান দিয়ে গিয়েছিলেন মারাদোনা। আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের সঙ্গে প্রথম চুক্তির পরই বুঝেছিলেন, এতদিন অন্ধকারের মধ্যেও ফুটবল অনুশীলন কতটা কার্যকরী হয়েছে। মারাদোনার ঐশ্বরিক ফুটবল প্রতিভা প্রথম নজরে পড়ে কোচ ফ্রান্সিসকো কোরনেয়োর। তিনি পরে বলেছিলেন, ডিয়েগো প্রথম যখন আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসেছিল, ছেলেটির সহজাত প্রতিভা দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মাত্র আট বছর বয়সে কেউ যে এরকম প্রতিভার অধিকারী হতে পারে, তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। একেবারে বড়দের মতো ফুটবল খেলছিল। বয়স ঠিকঠাক বলছে কি না, তা দেখার জন্য ডিয়েগোর কাছে পরিচয়পত্র চেয়েছিলাম। কিন্তু, ওর কাছে সেটা ছিল না। পরে যখন জানতে পারলাম ডিয়েগো বয়স নিয়ে ঠিক কথাই বলেছে, তখনই মনস্থির করেছিলাম, এই ছেলেটির প্রতি বাড়তি মনোনিবেশ করতে হবে। কোচের আস্থাভাজন হতে পারায় ছোট্ট মারাদোনাও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। পরে বহুবার বলেছেন, প্রথম উপার্জনের টাকায় একজোড়া ট্রাউজার্স কেনার কথা। নিজের জন্য সেটাই ছিল তাঁর প্রথম উপহার।
’৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে বিতর্কিত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল, তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্রিটিশ ডিফেন্সকে শরীরের দোলায় ফালাফালা করে সেই অবিশ্বাস্য গোল থেকে শুরু করে পেলের সঙ্গে তুলনা— মারাদোনাকে নিয়ে আলোচনা কখনওই থামার নয়। কিন্তু, সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার এই ফুটবল প্রতিভার সাফল্যের এভারেস্টে ওঠার পিছনে, বিশ্ব ফুটবলের নায়ক হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে ছেলেবেলায় চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ের কাহিনী। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় না থাকলে, ফুটবলের প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে এই লড়াইয়ে হয়তো সফল হওয়া যেত না। একদিন মুক্তির আনন্দেই ফুটবলকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। পরে সেই ফুটবলের মধ্যেই তিনি অমর হয়ে রইলেন।