কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
হিসেব মতো সত্তর বছর আগের পুজোর গন্ধটা ছিল একটু অন্য রকম। মনে পড়লে এখনও যেন মন কেমন করে আমার।
মা ছিলেন এমনিতেই গোটা গ্রামের হাসি-খুশি উমা। আর বাবা ছিলেন গরিব মহাদেব। কলকাতায় কাজ করতেন বড়বাজারের একটা লোহা-লক্কড়ের দোকানে। মাসে বোধ হয় বার দুয়েক আসতেন শনিবার দেখে।
তাই দুটো দিন খুব খুশি থাকতুম বাবাকে পেয়ে।
পাড়ার লোকেরাও তখন ছিল কেমন যেন অন্যরকম। গরিব বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত না কোনও পাড়ায়।
বাড়ির গা-ঘেঁষে থাকা কানা নদীটাও ছিল দারুণ ডাকা-বুকো। বর্ষায় প্রায়ই বন্যা আসত মাঠ-ঘাট ডুবিয়ে।
আহা, বেচারিকে এখন দেখলে কেমন মায়া হয়।
যেমন রোগা-ভোগা হাড় জিরজিরে চেহারা! তেমন ঘোলা জলের দশা। একটা পুঁটি মাছেরও দেখা মেলে না বর্ষাকালে।
তবু তো একটা নদী।
ছোট বেলায় কী দস্যি ছিল বলার নয়।
বর্ষাকালে বন্যা আসত ঘন ঘন।
তখন কী মজা হতো আমাদের।
কথায় কথায় কত রকমের মাছ উঠে আসত ডাঙা জমির ভেতর। গামছা পেতে মায়ের সঙ্গে ধরতুম খুব হইচই করে।
কতরকম নাম ছিল তাদের।
কেউ গাগর তো, কেউ চিতল। কেউ বোয়াল তো কেউ ট্যাংরা, পুঁটি, চিংড়ি। কেউ আবার রুপোয় গড়া ইলিশ।
জলের দামে সে সব মাছ বিকিয়ে যেত পাড়ায় পাড়ায়।
সে সময় মায়ের নাকছাবিটাও যেন কেমন করে হারিয়ে যেত জানতুম না।
বাবাও অবশ্য রাগ করতেন না সে সব নিয়ে।
বরং কথা ঘুরিয়ে দিতেন উঠোনের শিউলি গাছটাকে দেখে।
শরৎকাল এলেই ফুলের গন্ধে যেন উথাল-পাথাল হতো গোটা পাড়া।
মা বলতেন, আর কী— এই তো পুজো এসে গেল। এখন একটু ভোর ভোর উঠবি বাবা। ফুল কুড়িয়ে বকুলতলার মন্দিরে দিয়ে আসবি।
কিন্তু বকুলতলার মন্দির নয়, আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খেত ঢাকের বাদ্যি। আসলে সরকার পাড়ার দিক থেকে সকালবেলার সোনার রোদ এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসত আমাদের বাড়ির দিকে।
তখন কেমন যেন উসখুস করতুম মনে মনে।
নদীর ধারে কাশবনে কী ফুল ফুটছে! চামর দুলবে কখন! তবেই না ঢাক বাজবে দুগ্গা তলায়।
কিন্তু সরকার পাড়ায় দুগ্গা দালানে হরাদিত্য থেকে মিস্ত্রি দাদুটা এসে পড়লেই মনে হতো বুকের ভেতর ছুটির ঘণ্টাটা যেন বেজে উঠেছে ঢং ঢং করে। আর তখন পায় কে?
নীলকণ্ঠ পাখিটাও একদিন দেখি উড়ান দিলে সকাল সকাল।
মা বললেন, জানিস তো— ও যাচ্ছে মায়ের কাছে কৈলাসে। মা-কে আনবে রাস্তা দেখিয়ে।
ওপাড়ার কেষ্টদা, গণেশদা আর দেবুদাই তখন আমার সবচে পছন্দের। ওঁদের কাছেই সাহস করে কিছু বলতুম।
ওঁরাও কেন জানি না একটু বেশি প্রশ্রয় দিতেন আমাকে।
বাতাবি লেবু বলি হলেই কেষ্টদা আগে ছুঁড়ে দিতেন আমার দিকে। পুজোর ফল-পাকড় বিলি করার সময় আমাকে দিতেন আপেল, খেজুর আর কিসমিস। নিজের তিন বোন, শানু, মিন্টু আর সাবি তখন ঠাট্টা করত আমাকে।
বলত, আহারে! কী কপাল তোমার। দাদা এখন আর নিজের বোনেদেরই চিনতে পারছে না। ‘ইস্।’
তবু পুজোর আসল কর্তা ছিলেন ডাক্তারদাদু। ভবানীবাবু বলতে বিরাটির ডাক্তার শরৎ মিত্রও তখন খুব কাছের মানুষ ছিলেন ওপাড়ার।
আর দিদা?
তিনি ছিলেন যেন গোটা গ্রামের মা। কেউ কেউ বলত, জ্যান্ত দুর্গা।
পুজোর ক’দিন কেউ শুধুমুখে ফিরে আসত না ওবাড়ি থেকে।
একটাই ছেলে, ঘোঁতাদা। মাস্টারমশাই হয়েছিলেন আমাদের বড়বেলায়। তবু কেষ্টদার বাবাকে আমরা একটু মান্য করতুম বেশি।
কলকাতার একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। দাদা ছিলেন সেই সময়ের সুখ্যাত গোয়েন্দা লেখক শশধর দত্ত। তাঁকেও খুব কাছে পেয়েছিলুম ছোটবেলায়।
সত্যি বলতে, কলকাতা যেতে তখন হাঁটতে হতো মাইলের পর মাইল। মুণ্ডেশ্বরী আর দামোদরে ব্রিজ হয়নি তখনও। ছোট ছোট কামরার মার্টিন ট্রেন চলত চাঁপাডাঙা থেকে। জানলার ধারে বসে বসে দেখতুম, কী সুন্দর সব স্টেশনগুলির নাম। কোনওটা পিয়াসাড়া, হাওয়াখানা, আঁটপুর।
কোনওটা আবার বড়গাছিয়ায় নেমে মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যেতুম আমতা লাইনে। সেখানেও সব ছোট ছোট স্টেশন। কোনওটা মাজু, দক্ষিণমাজু, জালালসি, তারপর পানপুর। সব শেষে ছিল আমতা।
স্টেশনে নেমে মায়ের সঙ্গে শালতি চেপে বোসপাড়ার দিদার কাছে যেতাম। মামা তো ছিল না। ছিল সাতসাতটা মাসি। ইস্কুলের বন্ধুরা বলত, তাহলে আর মামাবাড়ি— মামাবাড়ি বলিস কেন? বলবি মাসির বাড়ি যাচ্ছি।
তবু আমার রাগ হতো না তখন।
ছান্দ্রা ইস্কুল থেকে তো বেশির ভাগ দিন বাড়ি ফিরতাম না আমি। চলে যেতাম আমগ্রামে।
সেখানেই তখন কামাল, মিরাজ আর মাসুম। খালি গলায় গান শোনাব বলে ভেতর বাড়ি থেকে পর্দার আড়ালে ভিড় জমে যেত যখন তখন।
সত্যি বলতে, সেই থেকেই আর যেমন তেমন রান্না পছন্দ হয় না মন থেকে। পদবি নিয়ে তো একটাও কথা নয়।
কিন্তু ছোটবেলাটা?
শিউলি ফুল ফুটলেই সে যেন কেমন ইশারা করে ডাকে জানলা দিয়ে। চুপি চুপি বলে, চ, পালিয়ে চ।
সরকার পাড়ার সদরপুকুরের সিঁড়িতে এখনই ভিড় জমে গেছে ছোটদের। যখন ঘট উঠবে তখনই শাঁক বাজাবে মেয়েরা। উলু দেবে।
বড়রা বাজাবে কেউ কাঁসর, কেউ ঘণ্টা। ঢাকিরা ছুটির বোল তুলবে ঢাকে।
এইটুকু শুনেই বিরুমপুরের শিশিরদের কী মনখারাপ।
গ্রামে গ্রামে এমন দুগ্গাপুজো হয় না কেন?
তাহলেই তো আর মন খারাপ হতো না ছোটদের।
মায়াপুরের হাটতলায় জমজমাট যাত্রার আসর বসে ক’দিন।
গড়বেতা থেকে নামী দল আসে যাত্রা গাইতে।
তখন কী শুধু প্রতাপনগর?
রাইপুর, রাগপুর, তাজপুর, সিয়াড়া, ঘোলগুড়ো— আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসত অশ্বিনী বাঁড়ুজ্যেকে দেখতে। তাঁর ‘মুচির ছেলে’ আর ‘দুর্গেশনন্দিনী’ দেখে মানুষ তখন আনন্দে আর বাড়ি ফিরত না সে রাতে। শুয়ে থাকত হাটতলায়।
পাড়ার বড়দের সঙ্গেই আমরাও তখন ভিড়ে পড়তুম কেউ কেউ।
শুধু মনটা একটু খারাপ হয়ে যেত শেষকালে।
যাত্রা ভেঙে গেলেই আগে ছুটতাম সাজঘরে।
‘সোনাই দিঘি’র সোনাইকে তখন আর একবার দেখব বলে ছুট দিতুম সাজঘরে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! সোনাই কোথায়? শাড়ি খুলে তখন দেখি একটা লাজুক ছেলে পাজামা পরে সাজের বাক্সের ওপর বসে রং তুলছে মুখের।
পাড়ার পৌরদাদু আর সরকার পাড়ার শৈলরা বললে উনি হচ্ছেন বিজয় মল্লিক! শোন, কলকাতার বড়ফণী আর ছোটফণীরাও ওকে পছন্দ করেন খুব।
না।
সে সময় বেলা সরকার বলে কেউ যাত্রা দলে আসেননি।
চন্দননগরের মনু, যে এখন হাইকোর্টের নামী উকিলবাবু, আমাদের ছোটবেলার বড় বন্ধু সে-ই তাঁকে প্রথম এনেছিলেন আরামবাগে।
হাড়হিম করা শীতে সেদিন ঘুমিয়ে ছিলেন খড়ের বিছানায়।
সত্যি বলতে স্বপ্নের মতো এই ছোটবেলাটার গল্প শুনতে জানি না কার ভালো লাগবে এখন। দাপুটে আর দস্যি সেই কানা নদীটাও বড্ড রোগা আর হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। এখন আর কে চিনতে পারবে তাকে?
চিনুক আর না চিনুক, মায়ের হাতে বসানো সেই শিউলি ফুলের গাছটায় এখনও কী ফুল ফোটে কী বলব!