পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
—কই না তো?
—বললে হবে? তুমি দিলদার হাসি নিয়ে তোওবা থাকো পিসে। আজ মনটা একটু বিচলতি যেন!
—হ্যাঁরে। তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না। এতক্ষণ টিভি দেখছিলাম। বলছিল...।
—বুঝেছি ওই টিভিতেই যত গণ্ডগোল। শুধু করোনা আর করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে ডাক্তার-মোক্তার, মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকরা যা শুরু করেছেন যে কী বলব বল! তুমি দেখ না একদম।
—না দেখে উপায় আছে? জানতে হবে না কোথায় কী হচ্ছে? কেমন ছড়াচ্ছে? পরিচিত কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কি না!
—দেখে কী করবে? কিছু করতে তো পারব না। ছোটবেলা থেকে বাবার কাছে মণিকাকুর কথা শুনেছি। খেলার মাঠে ক্যামেরা নিয়ে পড়ে থাকতেন। ভারতবর্ষ তো বটেই ভারতের বাইরের খেলোয়াড়রাও তাকে চিনতেন। আমাকে কত বিখ্যাত ক্রীড়াবিদের অটোগ্রাফ জোগাড় করে দিয়েছেন। অথচ দেখ তার মৃত্যুর পর কিছু জানাই গেল না ঠিক কি হয়েছিল। এক আশ্চর্য দেশ আমাদের।
—ঠিকই তো মণির কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
—কাজেই পিসে অত চিন্তা কর না। মোট কথা আমাদের কিছুকাল সাবধানে থাকতে হবে। নিয়ম করে শরীরচর্চা করতে হবে। আর...
—আর কী? বল!
—না থাক।
—আরে বাবা বলেই ফেল।
—তোমার বাইকের পেছনে বসে গঙ্গার পাড়ে যাব। নিয়ে যাবে?
—তাহলে তো বাড়ি ফিরে বাইকটা বের করতে হয়। তুই এক কাজ কর বাড়িতে বলে আয়।
বাড়িতে এসে মাকে বললাম, ‘এখন তো মা, লকডাউন অনেকটাই শিথিল। এই তিনটে মাস পাড়ার দোকানে দু’ একবার ছাড়া বের হইনি কখনও। আধঘণ্টার জন্য পিসেমশায়ের সঙ্গে একটু নদীর পাড়ে ঘুরে আসব?’ মা বললেন, ‘তোর বাবাও অবশ্য সপ্তাহে তিনদিন করে অফিসে যাচ্ছেন। বাড়ি ফিরে সমস্ত জামাকাপড় সাবান জলে ভিজিয়ে দেন। খেয়াল করেছিস?’
—হ্যাঁ। তারপর স্নানও করেন বাবা।
—তুইও মাস্ক পরে, টুপি এবং হেলমেট পরে হাতে গ্লাভস লাগিয়ে বেরুবি। বাড়ি এসে সমস্ত সাবান জলে দিতে হবে। আর স্নানও করতে হবে।
—অবশ্যই। টেনশন কোরো না।
—কে টেনশন করবে। সজলবাবুর সঙ্গে যাচ্ছিস টেনশন কীসের? বাড়িতে ফেরার সময় এক প্যাকেট দুধ নিয়ে আসবি। এই ব্যাগ আর পঞ্চাশ টাকা দিলাম। ফেরত টাকা আর বাবুলের দোকান থেকে আনতে হবে না। জমা থাকুক। পরে কোনও জিনিস কিনে নেব।
—কেন মা?
—খুচরো টাকা পয়সা থেকেও কোভিড সংক্রমণ হতে পারে। লকডাউনের আগেই বেশ কিছু টাকা খুচরো করিয়ে স্যানিটাইজ করে রেখেছি। তার থেকেই তোকে দিলাম।
—তাই? খুব ভালো করেছ। ওই পিসেমশায়ের বাইকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি যেন। আসছি মা।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই পিসেমশায়ের বাইকে বসলাম। আমাদের বাড়ি থেকে খড়দার গঙ্গার ঘাট ঠিক দু’কিলোমিটার। রাস্তা ফাঁকা। মাঝে বি টি রোডে দু’জন পুলিসবাবু আমাদের বাইক আটকালেন। পিসেমশায়ের এবং আমার মুখে মাস্ক দেখে আর দাঁড় করালেন না। আসলে দু’জনেই হেলমেট পড়ে থাকায় ওঁরা মুখ দেখতে পাননি। পিসেমশাই অবশ্য ড্রাইভিং লাইসেন্সটা একবার দেখাতে ওঁরা হেসে চলে যেতে বললেন।
বাড়ি থেকে রওনা হয়ে মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই গঙ্গার পাড়ে চলে এলাম। লকডাউনের আর সেভাবে কড়াকড়ি নেই বলে অনেকেই বেড়াতে এসেছেন ঘাটে। লঞ্চও চলছে। আমরা দেখলাম। অনেকে যেমন নিয়ম মেনে মাস্ক পরে মুখের সামনে ফেস শিলড লাগিয়ে এসেছেন তেমনি এমন অনেককে দেখলাম মাস্কটা গলার নীচে ঝুলিয়ে দিব্যি কাছাকাছি বসে আড্ডা জুড়েছেন। পিসেমশাই পরিচিত একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হ্যারে রতন মাস্ক পরেছিস মুখের বদলে গলায়? তোরা এমন করলে সাধারণ মানুষ কী করবেন?’ —সরি সজল। বলে রতনকাকু মাস্কটা মুখে ঠিক মতো লাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বোধ হয় একটু হেসে বললেন। তোমার পিসেমশাইকে দেখেছ! এখনও কেমন শাসন করেন। স্কুল মাস্টারিটা তার বন্ধুদের উপরও কেমন প্রয়োগ করেন। আমি হেসে ফেলি।
—একটা জিনিস পিসেমশাই লক্ষ করেছ?
—কী বল তো?
—কথাবার্তা মাস্ক পরে আমরা ঠিক মতো বলতে পারলেও হাসার সময় অন্যের বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছে না? মানে আমরা মাস্কমুখ দেখে কী বুঝতে পারছি সে হাসছে না বিরক্তি প্রকাশ করছে?
—অবশ্যই। ঠিক বোঝা যাচ্ছে। চোখ দেখে বোঝা যায়।
—ঠিকই বলেছ আমারও তাই অনুমান আসলে বাড়িতে তো মাস্ক ব্যবহার করি না। আর স্কুলের ক্লাসে অনলাইনেও মাস্কের প্রয়োজন হয় না। বাড়িতে এতদিন থেকে মাত্র দু’একবার দোকানে যাওয়া ছাড়া এই প্রথম বহুদিন পর কত আমার বয়সি এবং অন্যান্যদের মুখ দেখছি। তাই ব্যাপারটায় ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগবে। ওই দেখ একটা লঞ্চ এল রিষড়া থেকে। কতদিন ফেলু মোদকের দোকানে যাওয়া হয় না বল?
—ঠিকই। পরের দিন যাব।
লঞ্চ থেকে অনেকেই নামল। আমার বয়সি দু’তিন জন ছেলেমেয়েও সিঁড়ি ভেঙে ঘাটের কাছে অটোস্ট্যান্ডের দিকে আসছে। একটি আমারই বয়সি ছেলে আমরা যে পাশটায় বসে আছি সে তার অভিভাবকের সঙ্গে এসে কাছাকাছি বসে পড়ে। ছেলেটির নাম আমার জানা হয়ে গেছে। ওর অভিভাবক যখন ‘অন্তু’ বলে ডেকে একটা কবিতা বলতে বললেন অন্তুকে। অন্তুর মুখেও একদম আমারই মতো গেঞ্জির কাপড়ের মাস্ক। অন্তু আমার দিকে তাকায়, বলে কবিতা শুনবে? আমি বললাম কেন শুনব না। আমি তো কবিতা বলতে পারি না। তুমি যদি সামনের রবিবার ঠিক এই সময়ে ঘাটে আসো তোমাকে একটা ছবি উপহার দেব।
পিসেমশাই এবং অন্তুর কাকু অনেকটাই চমকে গেছেন আমাদের দু’জনের মধ্যে এমন হঠাৎ বন্ধুত্বে। অন্তু শুরু করে কবিতা।
বেড়াল নাকি কুকুর?
কুকুর নাকি পুকুর?
পুকুর নাকি খাল?
মরিচ নাকি ঝাল?
ভূত নাকি ভয়?
ভয় কখনও হয়?
কবিতা শুনে পিসেমশাই আর অন্তুর কাকু হাততালি দিয়ে উঠলেন, আমিও। অন্তুকে বললাম একটা নয়। এই কবিতা নিয়ে আমি দুটো ছবি আঁকব। একটা তোমাকে আর একটা আমার পিসেমশাইকে দেব।
তাহলে সমনের রবিবার ঠিক এই সময়ে দেখা হচ্ছে আমাদের?
পিসেমশায়ের বাইক স্টার্ট নেয়। খড়দহ স্টেশনে বাবুলের দোকান থেকে দুধ কিনে আমরা বাড়ির পথে। মনে হল বাইক চালাতে চালাতে পিসেমশাই অন্তুর আবৃত্তি করা কবিতার একটা লাইনই শুধু আওড়ে যাচ্ছেন।
ভয় কখনও হয়?
ভয় কখনও হয়?
অঙ্কন : সুব্রত মাজী