বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
অবিনাশবাবুর আজ প্রায় দু-সপ্তাহ হয়ে গেল ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আর কিছু না বুঝলেও ওয়ার্কিং পেরেন্টসের কনিষ্ঠ কন্যাটি এই জিনিসটি খুব ভালো করেই বোঝে। ওই যে মার অসুখ-বিসুখ করলেই দিব্যি সংস্থার উচ্চপদস্ত কর্মচারী হওয়ার সুবাদে কেমন দূরালাপের মাধ্যমে জুনিয়র রাখী আন্টিকে জানিয়ে দেয়, ‘এই শোন আজ আমি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করব। তুই একটু সামলে নিস।’ বলাই বাহুল্য মা প্রমিতা সেনও আজ হপ্তা দুয়েক ধরে বাড়িতে। দিদি তো দিব্যি আরামে খেয়েদেয়ে, ঘুমিয়ে, পড়ে বোর্ডের পরীক্ষা দিচ্ছিল। হঠাৎ সেদিন কী যেন একটা খবর দেখাল, ঘরে হইচই পড়ে গেল। পাশের ঘরে হালকা পাখার হাওয়ায় চাদরের তলায় সেঁধিয়ে গিয়েও মিনি স্পষ্ট শুনেছিল চিনিকে সঞ্চারীদির সাথে ফোনে কথা বলতে। আচ্ছা দিদি কি কাঁদছিল? ও তাহলে পরের দিন সকালে কলেজে পড়া হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করলো কেন? মিনিদেরও তো সেই কবে স্কুল বন্ধ হয়েছে। কবে খুলবে সঠিক জানে না। সে অবশ্য খানিক ঝাড়া হাত-পা। পরীক্ষা হয়ে অনলাইনে ফলাফল পেয়েছে। মেধাবী ছাত্রী দ্বিতীয় হয়েছে। তবে ফোরের দিদিরা যে বলতো — ‘ক্লাস ফোরে ওঠ তখন বুঝবি কাকে বলে লেখাপড়া।’ তাহলে স্কুলই বা খুলবে কবে? দিদির ইংরেজি আর ব্যাকরণ বইগুলো ছাড়া অন্যগুলো তো কোনও কাজেই লাগছে না। পাঠ্যক্রম আলাদা। তাহলে কবে থেকেই বা শুরু হবে লেখাপড়া? অতএব মোটের ওপরে সেনবাড়িতে এখন পাড়ার বাকি চারটে বাড়ির মতো এক থমথমে, ভূতুড়ে পরিবেশ।
তবে অনিশ্চয়তার জীবনযাপনের উর্ধ্বে উঠে মিনির মনে বাসা বেঁধেছে অনেকগুলো প্রশ্ন। আচ্ছা বাবা,মা তো কথায় কথায় রাস্তায়, দোকানে-বাজারে, পাড়ায়, বিয়েবাড়িতে কারও সঙ্গে দেখা হলে ‘কেমন আছ?’ প্রশ্নের প্রতুত্তরে কাজের ব্যস্ততা সাতকাহন করে বলত আর ওকে আর দিদিকে সময় দিতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতো। কিন্তু আজ যে মায়ের হাতে অফুরন্ত সময়, বাবা কোমরে হাত দিয়ে পায়চারি করছে — কই ওরা তো খুশি নয়। মিনি তো অত্যন্ত খুশি হয়েছিল যখন ক্লাস টু-এর বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফল করাতে দিম্মা ওকে ‘ক্ষীরের পুতুল’ কিনে দিয়েছিল। ও তো তাই চেয়েছিল। তাহলে বাবা, মার চাহিদা মিটলেও এত হতাশার কারণ হাতড়ে বেড়াতেই ব্যস্ত মিনি। অন্য ছুটির দিনে বাড়িতে থাকলে মা কত কী ভালোমন্দ রাঁধে, বাবা কত মজার গল্প বলে — বসার ঘরটাতে যেন হাসির আওয়াজে কান পাতা যায় না। আর এখন সারাদিন টিভিতে খবর চলছে, ঘন্টায় ঘন্টায় সবাই এসে ভিড় জমাচ্ছে বোকা বাক্সটার সামনে। ওই বোধ হচ্ছে এখন সব থেকে মূল্যবান কথাটা বলছে। বাবা শুধু থলে ভর্তি করে বাজার আনছে আর মা কোলে ল্যাপটপ খুলে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। দিদি সারাদিন দরজা এঁটে কি এত পড়ছে? সেনবাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্যটি বিচক্ষণ হলেও বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের বহরখানা এখনও পর্যন্ত ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি।
গল্পের বই ছাড়া মিনির জীবন এখন অচল। কয়েকটা ছবিও এঁকেছে। তবে মানুষের হাত-পাগুলো তেমন ভালো হয়নি। স্যারই বা আবার কবে আসবেন? জল রঙের ছবিগুলো দেখে বাবা কৌতুকের হাসি হেসে বলেছিল ‘ঠিক করেছিস। মানুষগুলোকে একেবারে ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর মতো লাগছে। খুব শীঘ্রই ওরা আমাদের গ্রহে রাজত্ব করবে।’ অন্য বছর পরীক্ষা শেষে দিম্মা বাড়ি যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, বিকেল হলেই বুলাদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে কত কী খেলা, কোনও কোনও দিন আবার সটান ছাদে উঠে যাওয়া। উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানার প্রতীক হয়ে টানা-টানা,লম্বা ছাদগুলো যেন ওদের হাসি-কান্নার গল্প বলে যায়। তবে এখন সবেতেই বাধা-নিষেধ। ছোট্ট মানুষটা কি আর পেরে ওঠে? ক্লান্তিকর, একঘেয়ে এই জীবনটাতে যা একটু-আধটু বৈচিত্র্য ওই গ্রীষ্মের বিকেলের পড়ন্ত রোদে ছাদে উঠে গিয়ে কাকেদের বিদায়কালীন আবহে কান পাতা আর পাশের ছাদে বুলাদের আসা। তখন যা একটু গল্প করা। তবে বেশিক্ষণ নয়।
তিনটে ছাদ পাশাপাশি। মধ্যিখানেরটা মিনিদের। সদ্য গত বছর গরমের ছুটিতে রঙ হয়েছিল। রোদের ঝিলিকে লাল রঙটা এখনও চকচক করে। সেদিন হঠাৎ ছাদে বুলাই খবরখানা দিল। প্রস্তাব বললেও চলে। স্কুলের সাহানা ম্যাম নাকি গতকাল ওকে ওর মার ই-মেলে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। আন্টির ফোন থেকে গড়গড়িয়ে পড়ে শোনাল চিঠিটা।
‘স্নেহের বুলা আশা করি তোমরা সকলে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। এ হেন বিপদের দিনে আমাদের কিছু সামাজিক দায়িত্ব আছে। কেবলই ঘরবন্দি হয়ে আরোগ্য কামনাতে কতখানি সুফল সম্ভব জানি না। তবে তার মানে কখনওই এই নয় যে আমরা বাধা-নিষেধ অমান্য করে সংক্রমণ বাড়িয়ে তুলব। আমরা খুঁজে বার করব প্রতিকারের পথ। সরকারের পাশে দাঁড়ানোর পথ এবং তা করতে হলে আমাদের নিজেদের অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। আমি ঘরোয়াভাবে কিছু মাস্ক বানানোর কাজ শুরু করেছি। তা তুলে দিচ্ছি সরকারি প্রতিনিধিদের হাতে যাতে তা বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে। আমার এই কাজে তোমরাও যদি আমার সঙ্গে যোগদান করো তাহলে আমরা প্রত্যেকে বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ সাধনে অংশীদার হতে পারব। তোমরা আমার সাহসিকতার সেই লাঠি যার ওপরে ভর করে আমি যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখি। বুলা তুমি আমাদের এই উদ্যেগ সম্পর্কে পার্থ এবং মিনিকেও জানিও যাতে ওরাও যোগদান করতে পারে। তোমাদের মূলত দুটো কাজ— ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাস্ক বানানো এবং কিছু সচেতনতা ভিত্তিক পোস্টার বানানো। সেই পোস্টারে থাকবে এমন কিছু বার্তা যা তোমরা শহরবাসীকে দিতে চাও, তোমাদের চোখ দিয়ে দেখা বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি হবে ওই পোস্টার। মাস্ক বানানো যাবে ঘরে থাকা জিনিস দিয়েই। এর জন্য হয়তো তোমাদের অভিভাবকদের সাহায্য নিতে হতে পারে, মাস্ক বানানোর পদ্ধতি একটি ভিডিওর মাধ্যমে তোমরা শিখে নিতে পারবে। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা কাজ হবে ব্যক্তিগতভাবে, সমষ্টিগতভাবে নয়। তোমরা সম্মত থাকলে আমাকে জানিও তাহলে তোমাদের ঠিকানায় নিৰ্দিষ্ট দিনে সরকারি প্রতিনিধিরা মাস্ক এবং পোস্টার নিতে পৌঁছে যাবে। আশা করি আমার শক্তির উৎসরা আমাকে হতাশ করবে না।
ইতি সাহানা ম্যাম।’
মিনিকে যেন এক অদ্ভত নেশায় পেয়েছে। তিন দিনে দশটা মাস্ক বানিয়েছে। এখন পোস্টার তৈরির কাজ চলছে। নিজেকে সে যেন ইতিহাসের পাতায় অমর কোনও রথী-মহারথীর থেকে কম কিছু ভাবছে না। কমপক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই অগণিত বীরদের সঙ্গে তুলনা করছে যারা হয়তো প্রথাগত ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিতে পারেনি কিন্তু তারাই অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল উজ্জ্বল সম্ভবনার খবর এবং তারাই ছিল বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি।
আজ সে আর নিজেকে কর্মহীন মনে করে না। অন্য বছর পরীক্ষার পর যদি বিদেশ ভ্রমণ হয়ে থাকে তাহলে এবার না হয়ে সে খানিক সামাজিক কাজই করল। মিনির কিন্তু এই বেশ লাগছে। মনে পরে যাচ্ছে মহামারীর সময় নিবেদিতার একনিষ্ঠতার উজ্জ্বল রূপ। জীবনীশক্তিতে জাগ্রত হয়ে ইতিহাসের পাতা ছাড়িয়ে উঠে আসছে সেই সমস্ত ঐতিহাসিক উপাখ্যানগুলি। ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, সুভাষ যেন মিনির শক্তির রসদ। তারা প্রত্যেকেই যেন বলছে ‘লড়াই চাই, লড়াই চাই!’
অন্ধকার হতে মিনিরাই আমাদের আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছে। অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়। তাই কিছু নিষেধাজ্ঞা মেনে চললে যদি বহু মানুষের স্বার্থহীন চেষ্টা সুফল প্রদান করে তাহলে তাই হোক না। মিনির মতোই তাহলে আমরাও সকলে একে একে হয়ে উঠব আলোর দিশারী।