পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
‘বন্দেমাতরম্
সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাম্
শস্য শ্যামলাং মাতরম্।
‘একদিন দেশ মাতবে এই গানে—।’ বলেছিলেন গানটির স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কেমন করে তিনি সাহিত্য-সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন আজ তোমাদের শোনাব সেই কথা। আগামী ২৬ জুন তাঁর জন্মদিন। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম। তাঁর বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মা দুর্গাসুন্দরী দেবী। তাঁদের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিম। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর অসম্ভব মেধার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তিনি মাত্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা পুরোটা শিখে ফেলেছিলেন। গুরুমশাই তাঁদের বাড়িতে এসেই পড়াতেন, তাই ছেলেবেলায় পাঠশালায় যেতে হয়নি তাঁকে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ আয়োজিত এক কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার পান এবং ‘কামিনীর উক্তি’ নামে সেই কবিতাটি ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ ছাপাও হয়।
প্রথমে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল, পরে হুগলি কলেজে তিনি পড়াশুনো করেন। সেখান থেকে যান প্রেসিডেন্সি কলেজে। পাশাপাশি চলতে থাকে দু’রকমেরই লেখা— গদ্য এবং পদ্য। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ আবৃত্তিকারও। জনপ্রিয় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সান্নিধ্য তিনি এই সময় থেকেই পেয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁকে ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছিলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পরের বছর প্রথমবার নেওয়া হয় বি এ পরীক্ষা। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সেই প্রথম ব্যাচের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। এরপর আইন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কারণ, তার আগেই তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর-এর চাকরি পেয়ে চলে যান যশোর জেলায়। বারো বছর পরে অবশ্য চাকরি করতে করতেই ভালোভাবে তিনি আইন পাশ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র হাকিম হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কাছ থেকে মানুষের দুঃখকষ্ট, সমস্যা যত দেখেছেন, ততই গাঢ় হয়েছে তাঁর দেশপ্রেম। ইংরেজদের সঙ্গে ভারতীয়রাও সমান মর্যাদা পাবে সব ক্ষেত্রে, এই ছিল তাঁর নীতি। ইংরেজরা মোটেই পছন্দ করেনি তাঁর এই মনোভাব, আর তাই যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতিও হয়নি তাঁর।
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রাজ মোহন’স ওয়াইফ’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকায়। এটি তিনি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। এর পরের বছর ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয়। একই বছরে প্রকাশিত হয় ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস দুটি। প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম বাংলা সফল ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের স্থান পাকা হয়ে যায়। তাঁর হাত ধরেই বাংলা ভাষা প্রথম সত্যিকারের মর্যাদা
লাভ করতে পেরেছিল। তাই তাঁকে ‘সাহিত্য-সম্রাট’ বলা হয়ে থাকে।
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন, ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’ অর্থাৎ ‘বাংলার নবজাগরণ’-এর অন্যতম মুখ। তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষিত সমাজ না জাগলে জনসাধারণকে জাগানো যাবে না। তাই তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ শুরু করলেন। এখানে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি সব বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হতো। ‘কমলাকান্ত’ ছদ্মনামে এখানে তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ নামে ধারাবাহিক প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তিনি কৃষকদের নানা সমস্যা তুলে ধরেছিলেন। এর কিছুদিন পরেই পাবনা সিরাজগঞ্জে শুরু হয়েছিল প্রজাবিদ্রোহ। এমনি ছিল তাঁর লেখনীর জোর! এই ‘বঙ্গদর্শন’-কে ঘিরে খুব দ্রুত গড়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী সাহিত্যিক গোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন ‘বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় একেবারে লুঠ করিয়া লইল।’ বঙ্কিমের স্বদেশ প্রেম নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে যায়। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস তিনি লেখেন। তাঁর কালজয়ী স্ত্রোত্র ‘বন্দেমাতরম্’—যার জোরে তোলপাড় হয়ে ওঠে ভারতের জাতীয়তাবোধ! দেশভক্তিতে মানুষকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলে এই ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র! বঙ্কিমচন্দ্র লাভ করেন ঋষিতুল্য স্থান। ‘আনন্দমঠ’ তাঁর এক কালজয়ী রচনা! এখানে তিনি জন্মভূমিকে ‘মা’ বলেছেন, জন্মভূমিকে ভালোবাসা ও ভক্তি করা শিখিয়েছেন, জন্মভূমির জন্য যে সর্বস্ব পণ করা যায় তাও তিনিই শিখিয়েছেন! এই কাজ ভারতবর্ষে তাঁর আগে আর কেউ করেনি! তাই তিনি ঋষিতুল্য মানুষ। তিনি মন্ত্রস্রষ্টা— যে মন্ত্র হল ‘বন্দেমাতরম্’। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই মন্ত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘বন্দেমাতরম্’ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার এই ধ্বনি উচ্চারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই ধ্বনি দেওয়ার জন্য বহু স্বাধীনতা-সংগ্রামীকে কারাবরণ করতে হয়!
‘আনন্দমঠ’-এর আদর্শ ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। উপন্যাসের ‘সন্তান দল’ যেভাবে নিজেদের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তৈরি করত সেভাবেই নানান গুপ্ত সমিতিও নিজেদের তৈরি করার ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছেন। যাতে তাঁরা ব্রিটিশরাজের বিরোধিতা করতে পারেন একজোট হয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে নারী জাগরণ ও নারীশক্তির কথাও বলেছেন। মেয়েরাও যে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে পারে সেকথাই তিনি উপন্যাসের চরিত্র— শান্তি, কল্যাণী ও দেবী চৌধুরাণীর মাধ্যম দিয়ে দেখিয়েছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, মাতঙ্গিনী হাজরাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের! সাহিত্য-সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র সার্থক হয়েছিল, দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিল, আর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ‘জাতীয় স্ত্রোত্র’-এর স্বীকৃতি পেয়েছিল ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি! তবে তিনি তা দেখে যেতে পারেনি। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ই এপ্রিল কলকাতায় তাঁর জীবনাবসান হয়।