বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
গাছের ডালে দোল খাচ্ছে বাবুইপাখির বাসা, বাদামগাছের কোটর থেকে উঁকি মারছে কাঠঠোকরা, ডালে ডালে হুটোপুটি করছে কাঠবিড়ালির দল। পাতায় পাতায় উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির সারি, রাতের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে লাল-সবুজ আলো জ্বালিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি ঘিরে আছে বনবাদাড়কে, চোখ বুঁজলেই সেই কৈশোরের অফুরন্ত আনন্দের মুহূর্তগুলি ভেসে ওঠে। একে একে কোথায় হারিয়ে গেল স্বপ্নের দিনগুলি। গাছগাছালি আর সবুজ প্রান্তর আজ যেন অতীত। মিল পাই না কবির কল্পনার সঙ্গে —
‘অবারিত মাঠ, গগন ললাট /
চুমে তব পদধূলি /
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় /
ছোট ছোট গ্রামগুলি...’
আজ সারা বিশ্বের পরিবেশ ভারসাম্যে তারতম্যের একটি প্রধান কারণ গাছ উচ্ছেদ। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের প্রায় অর্ধেক অংশ ছিল অরণ্যাবৃত। হারিয়ে গিয়েছে সেই অরণ্য, মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে চলেছে সবুজের নিধন। কোমর বেঁধে কুঠার বা আধুনিক যন্ত্র সহযোগে গাছ কাটার জন্যে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষজন। জনারণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজায়ন। বন কেটে বসত। পল্লী জীবনের সেই চিরন্তন ছবিটি চোখের সামনে যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমকাঁঠালের বন, দিঘি ভরা জল, ফুলঝরা শিশিরভেজা ভোর এই প্রজন্মের কাছে যেন এক গল্পমালা। আমের বনে জামের বনে কতই না ঘুরে বেড়িয়েছি কৈশোরে। গাছের তলায় ঝরে পড়া আম কোঁচড় ভরে নিয়ে তুলে দিয়েছি মা বা কাকিমার হাতে।
গাছ আমাদের প্রাণের বন্ধু, গাছপালা ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোনও জীবের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। মুক্ত পরিবেশ, সবুজ প্রান্তর, দূষণ প্রতিকার করতে সুন্দর শ্যামল পরিবেশ গড়ে তুলতে, বন সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কথায় বলে, একটি গাছ একটি প্রাণ। সবুজহীন নগরজীবনে জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া এক কবির ব্যাকুল আবেদন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে গাছ। দিন দিন কমে যাচ্ছে গাছপালার পরিমাণ, হারাতে বসেছে পৃথিবীর স্বাভাবিক সৌন্দর্ষ। বিশ্বব্যাপী মানুষ উপলব্ধি করেছে গাছের প্রয়োজন কতখানি, এসেছে তাগিদা, শুরু হয়েছে সবুজ বিপ্লব।
এখন বর্ষাকাল, বর্ষার জলে ভেজা মাটিতে আমরা বৃক্ষরোপণ করতে পারি। সামনে রথযাত্রা, সেই উপলক্ষে নানা অঞ্চলে বসে রথের মেলা। রথের মেলা বলতেই পাঁপড় ভাজা আর গরম গরম জিলিপির দোকান, খেলনাবাটি গয়নার সাজ আরও কত কিছু, তার সঙ্গে আছে হই হই করে নাগরদোলায় ঘুরপাক খাওয়া। এছাড়াও মেলার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল গাছের মেলা, নানা জাতের ফুল ফলের গাছের চারা বিক্রি হয় মেলাতে। সেইসব গাছ সংগ্রহ করে এই বর্ষার মরশুমে বাড়ির আশেপাশে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি পালন করা যেতে পারে। রথযাত্রা উপলক্ষে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিনামূল্যে গাছ বিতরণ করে। প্রতি বছর গড়ের মাঠে ইসকনের বিশালাকারে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সর্বসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে অসংখ্য গাছের চারা বিতরণ করা হয়। আম জাম লিচু বেল বকুল কত রকমই গাছ তাদের ঝুলিতে থাকে। আমিও একবার সেই গাছের চারা সংগ্রহ করে আমাদের বাগানে পুঁতেছিলাম, সে আজ মহীরুহ।
আমার বিদেশ বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা এবার একটু বলি। দেশটি হল আমেরিকা। ব্যস্ত নিউইয়র্ক শহর অতি আধুনিকতার নিদর্শন। গগনচুম্বি অট্টালিকা, গাড়ি ছুটে চলেছে দূর থেকে দূরান্তরে। ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, পরিকল্পনা মতো এসব রাস্তাঘাট গড়ে উঠেছে গাছগাছালি বনানীকে বাঁচিয়ে। রাস্তার দু’ধারে রোপণ করা হয়েছে অসংখ্য গাছের সারি। ফুটপাথে সাজানো রয়েছে বিশাল বিশাল টব, তাতে শোভাবর্ধন
করছে মরশুমি ফুলের গাছ। এ দেশের মানুষরা গাছ বাঁচিয়ে কীভাবে রাস্তাঘাট, জনবসতি গড়ে তুলেছে তা সত্যি দেখার মতো। শহরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বোটানিকাল গার্ডেন। ঘুরতে গিয়ে দেখেছি কত রকমের গাছ আর তার ইতিহাস। ফলের সময় গাছের রং বদলায় প্রকৃতির খেয়ালে, সবুজ থেকে হলুদ আস্তে আস্তে লাল, পাতা ঝরার মর্মর ধ্বনি অকৃত্রিম নীরবতা ভঙ্গ করে। হাওয়ায় হাওয়ায় মিশে যায় ফুলের সৌরভ।
বৃক্ষরোপণ নিয়ে কিছু কিছু মানুষের যে উৎসাহ দেখা যায় তা এক জনৈক কবির কবিতা থেকে উপলব্ধি করা যায় সহজেই—
চল চল ঝটিতি চল রোপিব বৃক্ষ দল। /
বৃক্ষ মেলিবে রোদ্দুরে ছায়া বৃক্ষে ফলিবে ফল।।/
করি তার কোলে বাসা নির্মাণ, শাখে বসে পাখি শুনাইবে গান।/
শ্রান্ত পথিক শুইবে ক্ষণিক ছায়া পেয়ে সুশীতল।।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বহুযুগ আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি শান্তিনিকেতনে আশ্রমবাসীদের সঙ্গে নিয়ে বৃক্ষবন্দনা শুরু করেন। বর্ষার দিনে নিজের হাতে বৃক্ষরোপণ করে বনমহোৎসব পালন করতেন। শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক জীবনের নানা অনুষ্ঠানের উপযোগী বহু সংগীত রচনা করেন। এই অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে তাঁর গানের অর্ঘ্য—
‘আয় আয় আয় আমাদের অঙ্গনে
অতিথি বালক তরুদল
মানবের স্নেহসঙ্গ নে...’
গানটির রচনাকাল ২ শ্রাবণ ১৩৩৬, স্বরলিপি গাঁথলেন দিনু ঠাকুর। আরেকটি গানের সঙ্গে এক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। গুরুদেব ২৫ বৈশাখ গানটি রচনা করেছিলেন তাঁর ৬৫-তম জন্মদিন উপলক্ষে। সেদিন শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণের উত্তরে পথের ধারে পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, আর সমবেতভাবে গাওয়া হয়েছিল সদ্য রচিত সেই গানটি—‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও হে শূন্যে’। নিজের হাতে রোপণ করলেন অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক ও আমলকী গাছের চারা। গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে সঞ্জীবিত করার জন্য চারাগুলিকে নিজের হাতে জল দিয়ে ভেজালেন। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল সবুজায়ন আর কল্পনায় ছিল একটি সবুজ দেশ।
আশ্রমের প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসব উপলক্ষে পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচনা করেছিলেন একটি শ্লোক। রবীন্দ্রনাথ নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই বৃক্ষরোপণ উৎসবে শান্তিনকেতনের পিয়ারসন পল্লিতে নিজের হাতে বকুল গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— তোমার টবের বকুল গাছটিকে নিয়ে অনুষ্ঠান হল। পৃথিবীতে কোনও গাছ এমন সৌভাগ্য কল্পনা করতে পারে না। সুন্দরী বালিকারা পরিচ্ছন্ন হয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞ ক্ষেত্রে এল।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর এই স্বপ্নের বৃক্ষরোপণ উৎসব কবির মৃত্যুদিনেই অনুষ্ঠিত হতে শুরু করল প্রতি বছর এই পবিত্র দিনটিতে। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকা, ভবনের কর্মচারীবৃন্দ সকলেই অংশ নেন এই বৃক্ষবন্দনায়। অনুষ্ঠানটিকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা হয়। তার মধ্যে আছে ফুল সংগ্রহ, অলঙ্কার গড়া, পঞ্চকন্যা ও পঞ্চপুত্র ও ছত্র বাহক। যে চারা গাছটি রোপণ করা হবে সেইটিকে সুসজ্জিত পালকিতে করে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেই স্থানে, যেখানে বৃক্ষরোপণ করা হবে। স্থানটিকে রাঙিয়ে দেওয়া হয় আলপনায় আলপনায়। একসময় আলপনা আঁকতেন নন্দলাল বসু, কী সুন্দর সময় ছিল! সমস্ত শ্রেষ্ঠ মানুষগুলি যেন এক সঙ্গে সমবেত হয়েছিল রবিচ্ছায়ায়।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু বর্ষা। অনুভব করলাম স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই বর্ষণমুখর দিনে জলসিঞ্চিত মাটির বুকে একের পর এক বৃক্ষরোপণ করে চলেছেন। শেষ বর্ষার হাওয়ায় ভেসে আসছে একটি গানের কলি— ‘আয় আয় আয় আমাদের অঙ্গনে। অতিথি বালক তরুদল মানবের স্নেহসঙ্গ নে।’ আর আমাদের চোখে ভেসে উঠলো এক সবুজ দেশের স্বপ্ন।