বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
সেই শান্তির নিকেতনে ঘোরতর অশান্তি, বাঘ পড়েছিল, ভাবা যায়! বাঘ এসেছিল, হুংকার ছেড়ে একটুআধটু ভয়টয় দেখিয়ে পায়ে পায়ে ফিরে গিয়েছিল ইলামবাজারের জঙ্গলে, না, ব্যাপারটা তেমন জলবৎ তরলং ছিল না! সে-এক শিহরিত হওয়ার মতো সংবাদ, হুলুস্থুল কাণ্ড। আশ্রমের ছাত্ররা দল বেঁধে মেরেছিল বাঘটাকে। হা-রে-রে-রে, সে-এক বিষম লড়াই! মারতে গিয়ে ছাত্ররাও কম-বেশি রক্তাক্ত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন অবশ্য শান্তিনিকেতনে ছিলেন না, ছিলেন ট্রেনে, তৎক্ষণাৎ তাঁর কাছে বার্তা গিয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে বাঘ পড়ার ঘটনাটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গল্পকথা নয়। সে-ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সীতাদেবী। স্বচক্ষে দেখা, লিপিবদ্ধও করে রেখেছেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় একটানা বছর দুয়েক ছিলেন শান্তিনিকেতনে। সীতার ছোট্ট ভাই মুলু পড়তো আশ্রম-বিদ্যালয়ে। হন্তদন্ত হয়ে সেই মুলু এক বিকেলে সীতার কাছে নিয়ে আসে ভয়ংকর সেই বার্তা। ব্যাঘ্রমশায় শুধু আসেননি, দু’জন গ্রামবাসীকে আঁচড়ে কামড়েও আহত করেছে। তাদের ভর্তি করা হয়েছে আশ্রম-হাসপাতালে। মুলুর খবর একেবারেই অতিরঞ্জিত নয়, যা ঘটেছে তাই।
শান্তিনিকেতনের অদূরে এক গ্রাম, সে-গ্রামের নাম তালতোড়। তালতোড়ের ঘটনা সেদিন সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে দিয়েছিল! ছোটভাইয়ের মুখে ভয়ংকর বিবরণ শুনে সীতাদেবী থ বনে গিয়েছিলেন।
গ্রামবাসীরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে, অবিশ্রান্ত-অবিরাম ইট-পাটকেল ছুঁড়েছে। শুধু তালতোড়ের মানুষজনের নয়, আশপাশের গ্রামে যে যেখানে ছিল, সকলেই সন্ত্রস্ত। ভীত মানুষ খবর পাঠিয়েছে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। তাদের বিশ্বাস, দল বেঁধে ছাত্র-শিক্ষক-আশ্রমবাসীরা চলে এলে, যদি সঙ্গে বন্দুক টন্দুক থাকে, তবে বাঘবাবাজিকে নিশ্চিত ঘায়েল করা যাবে!
মানুষেরই কি শুধু ভয়! ভয়ে ভীত বাঘও। চারদিকে মানুষ, মানুষে মানুষে ছয়লাপ, চলছে ইট-বর্ষণ, এসব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বাঘটা কোনও রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড়ে, গাছের আড়ালে।
আশ্রমের অদূরেই যে বাঘ পড়েছে, সে-খবর ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে শান্তিনিকেতন-চত্বরে। চলতে থাকে রকমারি কথার চালাচালি। এক অধ্যাপকপত্নী জানান, ঠিকই তো, আগের দিন রাতে তিনিও বাঘের ডাক শুনেছেন! তাঁর যে কোনও ভুলচুক হয়নি, তা এবার বুঝতে পেরেছেন। কেউ বললেন, গো-শালায় বাঁধা থাকে যে অতিকায় মোষ, সেই মোষটা নাকি শেকল ছিঁড়ে রাতে কাকে যেন তাড়া করেছিল!
সাতসতেরো এসব শুনে সবাই নিশ্চিত হয়, রাতের অন্ধকারে আশ্রমেও বাঘ ঘুরে বেড়ায়! কারও কারও প্রচণ্ড গরমে বাড়ির বারান্দায় উঠোনে শোওয়ার অভ্যেস। ঘরের গুমোট অন্তত বাইরে নেই। আরামে আনন্দে ঘরের বাইরে যারা ঘুমতে অভ্যস্ত, তাদের মুখ নিমেষে শুকিয়ে গেল। মুখে মুখে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ছড়িয়ে পড়লো।
রবীন্দ্রনাথের বন্ধু শ্র্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র সন্তোষচন্দ্র ছিলেন আশ্রমের প্রথমদিকের ছাত্র, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বন্ধু তিনি। কৃষিবিদ্যার পাঠ নিতে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিদেশেও গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কর্মসূ্ত্রেও শান্তিনিকেতন-আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সন্তোষচন্দ্রের উপর নির্ভর করতেন, বেয়াল্লিশ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হওয়ার পর কবি নিজেই নির্ভরতার কথা বলেছিলেন। পা ভেঙে সন্তোষচন্দ্র তখন শয্যাশায়ী। যাঁর সবার আগে যাওয়ার কথা, সেই সাহসী সন্তোষচন্দ্রের ব্যাঘ্র-অভিযানে যাওয়া না-হলেও কয়েকজন অধ্যাপক আর উপরের ক্লাসে পড়ে, এমন কয়েকজন ছাত্র দৌড় দিল তালতোড়ের দিকে।
খালি হাতে কি আর বাঘ শিকার হয়! বড় ছেলেরা সকলেই সশস্ত্র, কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে রামদা-ভোজালি! বড় ছেলেরা বাঘ শিকারে বেরিয়ে পড়ায় ছোট ছেলেদের ধরে রাখা শক্ত হয়ে ওঠে। মাঝারি ছেলেরা তো বটেই, শিশু-বিভাগের পুচকেরাও বাদ যায় না। বেরিয়ে পড়ে সব্বাই। সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা! সবারই লক্ষ্য তালতোড়, উদ্দেশ্য বাঘশিকার, দ্রুত পৌঁছতে চায় গন্তব্যে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, চলেছে যেন যুদ্ধক্ষেত্রে!
সব নিষেধকে তুচ্ছ করে যোদ্ধাবাহিনী এগিয়ে যায়। সীতাদেবীর মতো আশ্রমবাসীদের চিন্তার অন্ত থাকে না। দুশ্চিন্তায় জেরবার হয়, আতঙ্কে আশঙ্কায় বিপন্ন। ঠিক তখনই হাজির হয় মুলু। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নামছে। সেই আলো-আঁধারিতে তার কোথা থেকে আকস্মিক তার আবির্ভাব। চিৎকার করে দিদিকে বলে, বাঘটাকে নাকি মেরে ফেলেছে! কারা মেরেছে, কী বৃত্তান্ত কিছুই বলে না।
ওইটুকু বলেই মুলু কোথায় যেন মিলিয়ে যায়! উৎকণ্ঠিত উদ্বিগ্ন সীতাদেবী পায়ে পায়ে কিছুদূর সবে এগিয়েছেন, আশ্রমের এক ভৃত্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যায়। ‘বাঘটা কে মারল রে?’ প্রশ্নের উত্তরে ভৃত্যটির সগর্বে ঘোষণা করে, ‘কেন, ইস্কুলের ছেলেবাবুরা!’
আরও একটু এগতেই সীতাদেবীর নজরে পড়ে, খোয়াইপারের তালবনের বুক চিরে পিল পিল করে ছেলেরা আসছে। সেই ভিড়ে একটি গরুর গাড়িও রয়েছে। গাড়িটাকে ছেলেরা যেন ছেঁকে ধরেছে। কী আছে সে গরুর গাড়িতে!
গরুর গাড়িটা কাছে আসার পর সীতাদেবীর নজরে পড়ে, একটা গামছাকে বিজয়পতাকা বানিয়ে গাড়িতে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বুঝতে আর বাকি থাকে না যে ওই গাড়িতেই শিকার করা বাঘটা আছে!
আশ্রমের গোয়ালের কাছে, শোনা গিয়েছে যে গোয়ালে আগের দিন রাতে বাঘের আগমন ঘটেছিল, ঠিক সেখানেই ছেলের দল হই-হই করে দাঁড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, আশ্রমের পাঁচ পড়ুয়া টানা আধঘণ্টা লড়াই করে তবেই শেষ পর্যন্ত বাঘটাকে মারতে পেরেছে। তাদের আগে বাঘ মারতে তৎপর হয়েছিল এক জমিদার-পুত্র। হাতে তার বন্দুক ছিল। গুলি ছুঁড়েও বাঘটাকে ঘায়েল করতে পারেনি। নিরাশ হয়ে শেষে নিজের বন্দুকটা আশ্রমের ছেলেদেরই দিয়ে দেয়। ছেলেরা অবশ্য গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করেনি। বন্দুকটা ‘গদারূপে’ ব্যবহার করেছিল। গুলি-বন্দুক নয়, লাঠি আর ভোজালি দিয়ে বাঘের ভবলীলা সাঙ্গ করেছে তারা। সে সব বলতে বলতে গর্ব তাদের ঝরে ঝরে পড়ে।
উল্লাস থামতে চায় না। বাঘটাকে টেনে তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ছেলেরা। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়, মাঝারি সাইজের একটা চিতা। হোক না চিতা, বাঘ তো বটে! বীভৎসভাবে মেরেছে! সে বীভৎসতার মধ্যেই রয়েছে বীরত্বের প্রকাশ। চিতাবাঘের মাথাটা ভোজালির আঘাতে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বাঘ মারতে গিয়ে হাতে পায়ে আঁচড় লেগেছিল কয়েকজন ছাত্রের। একজনকে শুধু আঁচড়ায়নি, কামড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছিল। সে অবশ্য ছিল না সেই কোলাহল-ভিড়ে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে।
এভাবে পশুহত্যা, বাঘ মারা ঘোরতর অন্যায়। সে অন্যায়ের জন্য ওই বীর-ছাত্ররা নিশ্চয়ই কবির কাছে পরে বকুনি খেয়েছিল, বকুনির কথা অবশ্য সীতাদেবী লেখেননি, আমরা অনুমান করছি মাত্র। রবীন্দ্রনাথ সেদিন শান্তিনিকেতনে থাকলে, চিতাবাঘটাকে এভাবে বেঘোরে বোধহয় মরতে হতো না, এমনটি ভেবে নিতে আমাদের ভালো লাগে।