বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
বাবা তখন বাড়ি ফিরে এসেছেন কলকাতা থেকে।
দোকানের চাকরিটা গেছে!
মা-বাবা ভাই-বোন মিলে পাঁচজন।
একফালি জমি নেই গাঁয়ে।
তাই স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়তে পড়তেই খুচখাচ কাজের সন্ধান করত পুনু।
গরিব বাবার যেন একটুও সুখ নেই মনে। বাড়ি ছেড়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ান মাঠেঘাটে। নদীর ধারে।
তখনও এমন ভুটভুটির চল হয়নি।
নৌকোতেই যেতে হয় বালিপুর। সেখানেও একটা বাজার বসে সকাল থেকে।
কাছেই তো উদনো। ফুটবল খেলায় কী নামডাক তখন ওই গ্রামটার! আলমদা যেন মহকুমার পেলে। সঙ্গে ভাগনে জয়নাল। পাশাপাশি বাবুদা, সিদ্দিকদা, নিজাম।
পুনুদের পাড়া পেরলেই মদনপুর। সেখানেও তখন সন্তোষ সামন্ত। ফুটবলের রাজপুত্র। কাছেই তো খামারগোড়ি। তাঁতিশাল। পুনুদের স্কুল।
তখন তো একটাই জামা-প্যান্ট ছিল পুনুর। স্কুল ড্রেস বলে কিছু ছিল না। খালি পা বলে লজ্জা হতো না কারওর।
সেই ছোটবেলা থেকেই আলমদার ভক্ত ছিল পুনু।
পাশের বোসপাড়ায় রেডিও ছিল একটা। সেখানেই যেতে হতো এক এক সময়। বাবা অবশ্য সাবধান করতেন মেয়েকে।
—ও বাড়িতে যাস না বেশি! ওরা তো বড়লোক। তার ওপর—
বাবা খুব নিরীহ গলায় বলতেন, ভোম্বল ছেলেটা খুব বদ। ওর কথা যেন বিশ্বাস করিস না সহজে।
তবু পুনুটা যেন কেমন।
সহজে কারও কথাই শুনতে চাইত না তখন। বিশ্বাস করত সবাইকে। সেই সুযোগেই একদিন বাড়িতে এসে জুটল মিচ্কে। গয়লাবাড়ির বাগাল।
কিন্তু সাজ-পোশাক আর মুখের তোতলা কথার বাহার দেখলে কে বলবে ও ব্যাটার ছেলে গোটা গাঁয়ের কুলাঙ্গার।
পুনুর বাবারও তেমন পছন্দ ছিল না ছেলেটাকে।
তবু বেশি কিছু বলতেন না মুখ ফুটে।
আসলে পুনু আর ওর মা দু’জনেই চাইত মিচ্কে একটু আসুক ওদের বাড়িতে।
কারণটা আর কিছুই নয়, কথায় কথায় গায়ে পড়ে নানারকম ফাইফরমাস খেটে দেয় ছেলেটা!
ঘরে কিচ্ছু না থাকলে তো কথাই নেই, মিচ্কে তখন একাই একশো।
কিন্তু পুনুর বাবাকে যেমন গোটা গাঁয়ের মানুষ ভালোবাসতেন, তেমন পছন্দ করতেন মেয়েটাকেও।
মেয়েটা খুব নরম মনের।
কাউকে একটু দুঃখী দেখলেই নিজের পিঁয়াজ-মুড়ি দিয়ে দিত সবাইকে লুকিয়ে।
গোটা গাঁয়ের গরিব মানুষরা বলত, পুনু আমাদের পুণ্যিমা। ভগবানের মতো ভালো।
ওই কথাটাই একদিন ছড়িয়ে পড়ল এ পাড়ায়-ও পাড়ায়!
সেই হিংসেতেই বুকের ভেতরটা যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠল ভোম্বলের।
একে তো পড়াশুনোয় গাব্বুস!
তারওপর বদবুদ্ধিতেও যেন একটা ধূর্ত শেয়াল।
ওরাই শুধু জানত, পুনুদের মাটির বাড়িটাও কিন্তু ওদের নয়। কাগজে-কলমে বাড়িটা ওর মামার। থাকেন কলকাতায়। তার মধ্যেই কিনা হঠাৎ একটা কাজ জুটে গেল পুনুর। মাইনে কম হোক। সরকারি চাকরি।
খানাকুল থানার বি.ডি.ও সাহেব একদিন ডেকে পাঠালেন নিজের অফিসে।
বললেন, মাইনে কম হোক বোন, চাকরিটা কিন্তু সরকারি।
পুনুর চোখে জল। তবু বলে ফেলল, বড্ড উপকার করলেন স্যার!
— না না, স্যার নয়। তুমি আমাকে দাদা বলবে। কেমন?
তবু ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল পুনু।
বাড়িতে ফিরতেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ল গোটা পাড়া। ভোম্বল দেখল আর একার দ্বারা হবে না।
পুনুদের এবার আচ্ছারকম জব্দ করতে হলে সঙ্গে চাই তোতলা মিচ্কেকে!
একে ও ব্যাটার ছেলে পাঁড় মুখ্যু। তার ওপর লোভ দেখাতে হবে কিছু কাঁচা টাকার। তবেই তো যুদ্ধটা জমবে।
সবে একটু হাত-পা ছড়িয়ে শান্তিতে মায়ের কাছে ঘুমোতে গেছে পুনু— কলকাতা থেকে একটা ছোট্ট চিঠি এল মামার। ভাগনির জন্যে বড্ড মন খারাপ মামার। তবু লিখতে হল,
— কিন্তু কোনও উপায় নেই আমার। বাড়িটা আমি বিক্রি করে দিচ্ছি ভোম্বলদের। ওরা ছাড়া কে আমাকে একসঙ্গে দেবে এত টাকা...।
মামার চিঠি পেয়ে যেন একটা বাজ পড়ল গোটা বাড়িতে।
মাটির বাড়িটাও তখন থর থর করে কাঁপতে লাগল ভয়ে।
বাবার মুখে তখন একটাও কথা নেই।
মা যেন একটা কালো পাথরের খোদাই করা মূর্তি।
তাহলে?
তবু পুনু একবার বাইরের দিকে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
পিছনে পিছনে ডাকু কিছুটা যেতেই ফিরে আসতে হল হঠাৎ! না, ভয়ে কুঁকড়ে গেলে হবে না। তাহলেই ভোম্বলরা পেয়ে বসবে।
তোতলা মিচ্কেটাও টাকার লোভে পা বাড়িয়েছে ওদের দিকে। কিন্তু ডাকুর যেন কোনও ভয়ডর নেই মনের মধ্যে।
ও বোধহয় পুনুদির মুখ-চোখ দেখেই আন্দাজ করে নিয়েছে একটা বিপদ।
দাদুর মুখেও কথা নেই কোনও।
শুধু ঠামমা একবার আকাশের দিকে চেয়ে কাকে যেন প্রণাম করল একটা।
ডাকু তো একটা গেঁয়ো কুকুর! ও ঠিক জানে না, মেঘের আড়ালে ঠিক কে থাকে! তাতে কী সব্বাই ভয় পায়?
কিন্তু কী আশ্চর্য! গোটা গ্রাম কেন, আশপাশের গাঁ থেকেও কোনও সাড়াশব্দ নেই কারও। তাতেই বোধহয় সাহস পেয়ে গেল ভোম্বলরা।
একদিন মাটির দোতলায় মই লাগিয়ে উঠে পড়ল ভোম্বল আর তোতলা মিচ্কেটা।
তারপর তালা-চাবি লাগিয়ে দিলে দুটো ঘরে।
কিন্তু পুনু তো ভয় পাওয়ার মেয়েই নয়।
সেই রাতেই তালা ভেঙে ঢুকে পড়ল দোতলার ঘরে।
ভোম্বলরা তখন সঙ্গে পেয়ে গেল পাশাপাশি বাড়ির বাসিন্দাদের।
যারা মামাবাড়ির সম্পর্কে জ্ঞাতি। খুব কাছের মানুষ।
খানাকুল থানায় নালিশ গেল পাড়া থেকে। বাড়ি তো পুনুদের নয়। মাটির দোতলা বাড়িটা মামার। মিথ্যে চুরির একটা কেস গেল খানাকুল থানায়।
গোটা গ্রাম থ হয়ে দেখল সবচেয়ে নিরীহ, সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটাকে ধরে নিয়ে গেল পুলিস। শেষ পর্যন্ত আরামবাগের আদালত জেলে পাঠালেন পুনুর বাবাকে।
ভোম্বলরা বাজি পোড়ালো পাড়ায়।
আনন্দে দু’হাত তুলে নাচল তোতলা মিচকে।
কিন্তু মিথ্যে মামলা তো সাত দিনের বেশি টিকল না আদালতে। তবু ভোম্বলদের কী আনন্দ! তারপর আস্তে আস্তে যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়লেন নিরীহ মানুষটা!
কুকুর হলেও ডাকু সেসব নিজের কানে শুনেছে।
বদরাগী, জেদি মেয়েটাকে খুব অসহায় গলায় বলেছিলেন, ভোম্বলরা যেন আমাদের বাড়িতে না ঢোকে সেটা দেখিস। কিন্তু পুনু আর সে কথা মনে রাখেনি একটুও।
যত মাইনে বেড়েছে, ততই লোক দেখান্তি বড়লোকি বেড়েছে পুনুর।
ধূর্ত মামাকেও খুশি করেছে টাকা দিয়ে।
মাটির বাড়ি ফেলে দিয়ে বাড়ি করেছে পাকা।
সেই নিয়েও কত হইচই আর ভোজসভা।
কেমন যেন চোখে লাগছিল শুধু ডাকুর।
কুকুর হলেও এই বাড়ির প্রতি কী মায়া তার! কী ভালোবাসা!
এখন তো বয়স হয়েছে বড্ড।
যে মানুষটা একদিন কথায় কথায় ডাকুকে কাছে ডেকে আদর করত— সে মানুষটা এখন নেই।
দিদা অবশ্য আছে। কিন্তু তাতে কী!
পুনুই তো বদলে গেছে এখন।
যে ভোম্বল আর তোতলা মিচ্কেকে গোটা গ্রাম এখনও ঘেন্না করে— সেই দু’জনই এখন শেষ বন্ধু পুনুর।
কিন্তু ডাকু জানে, সেকেন্দারপুর থেকে তাঁতিশাল, মদনপুর, হেলান, আটঘরা, কায়বার কুকুর-বেড়াল থেকে পাখিরাও কিচিরমিচির করে ঠাট্টা করে পুনুকে।
বলে, অসহায় গরিব বাবার সেই অপমান তুমি মনে রাখওনি। তাই না? তাই আমি এবার তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।
বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি আমিও। আসলে আমরা তো রাস্তার কুকুর! শুধু শুধু কে মনে রাখবে আমাদের। তবু যদি তোমরা কেউ কেউ ডাকুকে মনে রাখো— তাহলেই আমার আনন্দ!
হঠাৎ বাড়িটা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল সেই কাঠবেড়ালীটার। উঠোনের আতা গাছ থেকে নামতেই একটা শালিক বললে, ডাকু কোথায় গেল? ডাকু?
কাঠবেড়ালীটাও চমকে উঠল তখন।
দিদা তো কানে শুনতে পায় না ভালো। তাই আন্দাজেই একবার ডেকে উঠলেন। ডাকুকে।
—ও ডাকু, কোথায় গেলি তুই?
শালিকটা তখন কচরমচর করতে লাগল আন্দাজে।
কাঠবেড়ালীটার যেন কেমন সন্দেহ হল একটু।
ডাকু তো দিদাকে বাড়িতে একা রেখে সহজে কোথাও যায় না। তাহলে?
কিন্তু হঠাৎ যেন পুনুর মনটা বদলে গেল কেমন! ভোম্বল আর তোতলা মিচ্কেটা পুনুর সঙ্গে সন্ধেবেলায় আড্ডাটা জমিয়ে দেবার আশায় বাঁধের ধারে এসে দেখলে সব ভোঁ-ভাঁ। মুখটা কেমন লজ্জায় চামচিকির মতো লাগছিল তোতলা মিচকেটার।
ভোম্বলের তো লাজলজ্জার বালাই নেই। বাড়িতে একঘর কুটুম। তাদের ফেলে পুনুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে।
এদিকে খোঁড়া ন্যাং ন্যাং তোতলা মিচ্কে বুড়ো শেয়ালের মতো পুনুকে খুঁজে খুঁজে হাঁপিয়ে উঠেছে তখন।
আর পুনু?
সে অন্ধকারের মধ্যেই ছুটতে ছুটতে তাঁতিশালের কাছাকাছি পৌঁছে ধরে ফেললে ডাকুকে।
ইস! কুকুরটা যেন নিজের ভাই!
এই হচ্ছে সেই মেয়েটা। যেমন মায়াবী, তেমন ডাকাবুকো। কায়বার পেটুক রায় থেকে বাজারপাড়ার ছুঁকছুঁকে হাজরাও মোটর সাইকেলের অনেক তেল পুড়িয়েছে হাসিমুখে, তবু বন্ধু হতে পারেনি কিছুতেই।
আহা!
সবাই কি আর ডাকুর মতো বিশ্বাসী হতে পারে?