কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
সত্যজিতের সৃষ্টির দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাঁর প্রধান কীর্তি চলচ্চিত্র পরিচালনায়। সেই সঙ্গে তিনি সাহিত্যিক, তিনি আর্টিস্ট।
সত্যজিৎ যখন 'যখন ছোট ছিলাম' লিখছেন, তার মধ্যে নিজেও অনুসন্ধান করেছেন তাঁর নিজের চিত্র-পরিচালক সত্তার বীজ বপনের ইতিবৃত্ত, আর তাঁর সাহিত্যিক এবং শিল্পীর সত্তার উৎসমুখ। ছেলেবেলায় সত্যজিতের নাকি একটা যন্ত্র ছিল। ম্যাজিক ল্যানটার্ন। বাক্সের মত। তার মধ্যে থাকে লেন্স, ফিল্মের রিল। দেওয়ালে চলন্ত ছবি ফেলার খেলনা বলা চলে। সত্যজিৎ নিজেই লিখছেন, ‘কে জানে, আমার ফিল্মের নেশা হয়তো এই ম্যাজিক ল্যানটার্নেই শুরু।’ ঘটনা হলো, ছেলেবেলায় এমন খেলনা তো অনেকেরই থাকে। তাঁরা সকলেই পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র তৈরি করেন না। জীবনের ছোটার পথে অনেক ছোট ছোট ঘটনা থাকে, যার পুরো হিসেব পাওয়া অসম্ভব। আবার অনেক সময় বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনাও বদলে দেয় জীবনের গতিপথ। যেমন, খুব ছোটবেলা থেকে অসাধারণ কিছু হলিউডি ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে সত্যজিতের। 'বেন হার’, 'কাউন্ট অব মন্টেক্রিস্টো’, 'থিফ অব বাগদাদ’, 'আঙ্কল টম্স কেবিন'। এসবের একটা তীব্র প্রভাব তাঁর শিশুমনে দাগ কেটেছে নিশ্চয়ই। তবে অন্য সব বাচ্চারাও এসব দেখে। কিন্তু সবার মনে তো আর সমান ছাপ পড়ে না। আবার সুকুমার রায়ের পিসতুতো ভাই নীতিন বসু ছিলেন গুণী নির্দেশক। তখন নতুন ধরনের বাংলা ছবি তৈরি করে নাম করেছেন। এরও একটা প্রভাব সত্যজিতের উপর পড়া সম্ভব। সত্যজিতের নিজের পিসতুতো দিদি নলিনী দাশ সত্যজিতের উপর বই লিখেছেন 'সাত রাজার ধন এক মানিক' নামে। তিনি লিখেছেন, ‘নানা কথাবার্তার মধ্যে সিনেমার বিষয়েও কথা হতো। বিজলী সিনেমায় কোনও নতুন ভালো ছবি হচ্ছে, আমরা সেটা দেখিনি – শুনলে মানিক উৎসাহিত হয়ে নিজেই টিকিট কিনে এনে আমাদের সেই ছবি দেখিয়েছে, এমনও দু-একবার হয়েছে। কবে থেকে মানিকের মনে ছবি তৈরি করার দৃঢ় সংকল্প গড়ে উঠেছে, সে-বিষয় কিন্তু জানতে পারিনি। প্রথম জানলাম, যখন পথের পাঁচালীর কাজ শুরু হয়েছে।’
বিখ্যাত লোকেদের সাদা-কালো ছেলেবেলা আমাদের কাছে রঙিন হয়ে উঁকি দেওয়ার দুটো প্রধান কারণ থাকে। এক তো একজন নামজাদা লোক তাঁর ছোটবেলা কীভাবে কাটালেন, সেটা আর পাঁচজনের থেকে কতটা আলাদা, সেটা জানার স্বাভাবিক কৌতূহল। সেই সঙ্গে থাকে জানার আগ্রহ— সেই মানুষটি ঠিক কী করে ঝুঁকে পড়লেন তার ভবিষ্যৎ কর্মকান্ডের পরিমণ্ডলে। সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞান বা চলচ্চিত্র অথবা খেলাধুলা— যেটাই তাঁর ভবিষ্যতের ক্ষেত্র হোক না কেন, তার বীজ পোঁতা সেই ছেলেবেলাতেই হয়েছে কিনা সেটা ফেলুদা-সুলভ স্টাইলে 'ইনভেস্টিগেট করার একটা আগ্রহ আমাদের থাকে বইকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেবেলার বর্ণনা লিখতে বসে লেখকের নিজেরও সেই প্রয়াস থাকে।
আসলে এক অসাধারণ পারিবারিক কৃষ্টির উত্তরাধিকার মূর্ত হয়েছে সত্যজিতের মধ্যে। তিনি সুকুমার রায়ের ছেলে, উপেন্দ্রকিশোরের নাতি, সে সময়ের এইচএমভি-র নামকরা গায়িকা কনক দাশ তাঁর মাসি, বাংলার সেরা ক্রিকেটার কার্তিক বোস তাঁর কাকা। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যেমন ঠাকুর পরিবারের যুগসঞ্চিত কৃষ্টির প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর ভবিষ্যতের বিশ্বকবি হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে, সত্যজিতের ক্ষেত্রেও অনেকটা হয়তো সেরকম। উপেন্দ্রকিশোর বাংলার মুদ্রণশিল্পের ভগীরথ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স' তো বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির সঙ্গে প্রযুক্তির ইতিহাসেও পাকা জায়গা করে নিয়েছে। 'সন্দেশ' পত্রিকারও প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রকিশোর, এই ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ছত্রছায়াতেই। উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশের দায়িত্ব নেন সুকুমার। পরিবারে কৃতি লোকের ছাড়াছড়ি। সত্যজিতের এক দাদু (কুলদারঞ্জন রায়) রীতিমত কোনান ডয়েলের গল্পের অনুবাদ করে চলেছেন। পরবর্তীকালে সত্যজিতের ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কুর নির্মাণের ক্ষেত্রে এর মস্ত বড় অবদান থাকাটাই স্বাভাবিক। ফেলুদার মধ্যে কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, আর প্রফেসর শঙ্কুর মধ্যে কোনান ডয়েলের 'দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড' প্রমুখ গল্পগুলির প্রফেসর চ্যালেঞ্জার চরিত্র মূর্তহয়েছে। আবার লীলা মজুমদারের মত লেখিকা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি। এমনই অজস্র প্রতিভা ঘিরে ছিল সত্যজিতের অস্তিত্বকে, তাঁর বেড়ে ওঠাকে। আর এসবের মধ্যে সব চাইতে বড় প্রতিভা নিঃসন্দেহে সুকুমার, সত্যজিতের বাবা। রবীন্দ্রনাথের 'যুবক বন্ধু'। বস্তুত রায় পরিবারের বিস্তীর্ণ শাখাপ্রশাখার মধ্যে এতবড় প্রতিভা আর নেই। সত্যজিতকে হিসেবে ধরেই একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে যে অসাধারণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন সুকুমার, তার তুলনা বাংলার সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে একান্তই বিরল। কার্টুন এবং ক্যারিকেচারে সুকুমারের স্বাভাবিক নৈপুণ্যেরও উত্তরাধিকার পেয়েছেন সত্যজিৎ। একথা ঠিক, মাত্র আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন সত্যজিৎ। তাই সুকুমারের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে তাঁর প্রতিভার আরও কতটা বিচ্ছুরণ সম্ভব ছিল, সে আলোচনা অর্থহীন। তবু, সুকুমারের ছেলে হিসেবে তাঁর এবং রায় পরিবারের কয়েক প্রজন্ম সঞ্চিত এক বিরল সংস্কৃতির উত্তরাধিকার মূর্ত হয়েছে সত্যজিতের মধ্যে। তাঁর চলচ্চিত্রে। তাঁর সাহিত্যে।
‘যখন ছোট ছিলাম' বইতে সত্যজিৎ লিখছেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হবার পর তাঁর মনে হল, এরপর তিনি কলেজে পড়বেন, তিনি আর ছোট নেই। এটা খুবই মজার। মানুষ কতদিন ছোট থাকে? আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মানুষ যতদিন মনে করে সে ছোট আছে, ততদিনই সে ছোট। অনেকটা পিটার প্যানের মত। অবশ্য কলেজে ওঠাই হোক বা নিজের মনে করাই হোক, দুই মানদণ্ডেই সত্যজিৎ বড় হয়ে গেলেন সেদিন থেকে।
কিন্তু তাঁর একটা ছোটদের সত্তা কি বইতে থাকে না সমান্তরালে? 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' কিংবা 'হীরক রাজার দেশে'র মধ্যে যতই রাজনীতির জটিল কথা লুকনো থাক না কেন, ছোটদের মনের মতো হওয়া কিন্তু আটকায় না। কিংবা সাহিত্যিক সত্যজিৎ তাঁর নানা ছোটগল্প, ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার, প্রফেসর শঙ্কুর অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার, কিংবা খানিকটা ঘনাদার আদলে তৈরি তারিণীখুড়োর গল্পের ডালির মধ্য দিয়েও অনাবিল স্রোতে লিখে গিয়েছেন কিশোরদের জন্য। অত্যন্ত অল্প বয়সে ঘুমের ঘোর ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও সুকুমার যে 'তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম' রেখে গিয়েছিলেন উত্তরাধিকার হিসেবে, তাকেই সযত্নে লালন করে গিয়েছেন সত্যজিৎ। শতবর্ষে সত্যজিতের লেগ্যাসির একটা বড় অংশ এটাই, নিঃসন্দেহে।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে